লে. কর্নেল নাজমুল হুদা খান

  ২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২২

আমরা করেছি জয় এক দিনে কোটি ভ্যাকসিন  

দেশব্যাপী এক কোটি মানুষকে করোনা ভ্যাকসিনের প্রথম ডোজ প্রদানের গণটিকা কর্মসূচি শেষ হয়েছে। চলমান কোভিড-১৯ অতিমারি নিয়ন্ত্রণকল্পে মোট জনসংখ্যার ৭০ শতাংশকে ১ম ডোজের আওতায় আনতে দেশব্যাপী অনুষ্ঠিত হয়েছে ‘এক দিনে এক কোটি কোভিড ভ্যাকসিন প্রদান কর্মসূচি’। এই বিশেষ কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে দেশের সবাইকে ১ম ডোজ কোভিড-১৯ টিকা প্রদানের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। পরে দ্বিতীয় ও বুস্টার ডোজ প্রদান কার্যক্রমও জোরদার করা হবে; তবে প্রথম ডোজ প্রদান কার্যক্রমও চালু থাকবে।

প্রায় দুই বছরব্যাপী বাংলাদেশে করোনাযুদ্ধের এই আরেক মহাকর্মযজ্ঞ। করোনা রোগ তত্ত্ব, বিশ্বব্যাপী আবিষ্কৃত ও অনুমোদিত কোভিড ভ্যাকসিনের প্রকার ও কার্যপ্রণালি এবং ভ্যাকসিন প্রয়োগে বয়সের প্রভেদ প্রভৃতি সার্বিক বিবেচনায় প্রয় ১২ কোটি মানুষকে টিকা প্রদানের প্রাথমিক লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত হয়। প্রথম থেকেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অনুমোদিত সব উৎস থেকে ভ্যাকসিন সংগ্রহের প্রচেষ্টা চালায় বাংলাদেশ। এ পর্যন্ত বিশ্বের অন্যতম সেরা সব ভ্যাকসিন যথা : ফাইজার, মডার্না, অ্যাস্ট্রাজেনেকা, সিনোফার্ম, সিনোব্যাক এবং জনসন অ্যান্ড জনসন প্রভৃতি ৬টি ভ্যাকসিন বিভিন্ন বয়স ও শ্রেণির মানুষকে দেওয়া হয়। এখন পর্যন্ত প্রায় সোয়া দশ কোটি মানুষকে প্রথম ডোজ, পৌনে ৮ কোটি মানুষকে ২য় ডোজ, ৩০ লাখের ওপর বুস্টার ডোজ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া ১৫ লাখের ওপর শিক্ষার্থীকে টিকার প্রথম ডোজ এবং প্রায় ৯ লাখ জনকে ২য় ডোজ দেওয়া হয়েছে। ভাসমান জনগোষ্ঠীকেও টিকার আওতায় আনতে এরই মধ্যে প্রায় ৩০ লাখ ছিন্নমূল মানুষকে টিকা প্রদান সম্পন্ন করেছে। শতকরা হিসাবে প্রায় ৭৫ শতাংশ মানুষকে ১ম ডোজ এবং পঞ্চাশ ভাগ মানুষকে ২য় ডোজ প্রদান সম্পন্ন করা হয়েছে।

এরই মধ্যে দেশের সব টিকা প্রদান কেন্দ্রে অনিবন্ধিত সবার ১ম ডোজ টিকা প্রদান শুরু হয়েছে। দেশব্যাপী এ টিকা প্রদান কর্মসূচিকে সফল করতে ব্যাপক পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। দেশের প্রতিটি ইউনিয়নে ৩টি টিকা দল, পৌরসভাগুলোর প্রতিটি ওয়ার্ডে ১টি টিকা দল, সিটি করপোরেশন ওয়ার্ডগুলোর প্রতিটি ওয়ার্ডে ৯টি টিকা দল গঠন ও তাদের মাধ্যমে এ টিকা কর্মসূচি সফল করার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। উপজেলাগুলোর প্রতি ইউনিয়নে ৯০০, পৌরসভাগুলোর প্রতি ওয়ার্ডে ৩০০ এবং সিটি করপোরেশনের প্রতিটি ওয়ার্ডে ৪৫০০ জনকে টিকা প্রদানের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এজন্য ইউনিয়ন পর্যায়ে কমিউনিটি ক্লিনিক, ইউনিয়ন উপস্বাস্থ্য কেন্দ্র, ইউনিয়ন পরিষদ বা স্কুলমাঠ; পৌরসভা ও সিটি করপোরেশনগুলোর কমিউনিটি সেন্টার, মাতৃসদন কেন্দ্র বা সুবিধাজনক স্থানে এ টিকা দেওয়া হয়েছে। প্রতিটি টিকা দলে দুজন করে ভ্যাকসিনেটর এবং তিনজন স্বেচ্ছাসেবী অংশগ্রহণ করেছেন।

নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের নেতৃত্বে শিক্ষক, ধর্মীয় প্রতিনিধি, রাজনৈতিক নেতা, এনজিও প্রতিনিধি, আনসার ভিডিপি, ব্লক সুপারভাইজার, স্কাউট, গার্লস গাইড, স্থানীয় ক্লাব প্রতিনিধি, সাংবাদিক, রেড ক্রিসেন্ট স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান, প্রভাবশালী ব্যক্তি, ব্যবসায়ী, দোকান মালিক সমিতির প্রতিনিধি, সমাজসেবী ও দাতব্য সংস্থার প্রতিনিধি ইত্যাদি ব্যাক্তিদের সমন্বয়ে জনগণকে সচেতন করা এবং এ টিকা কর্মসূচিকে সফল করতে মবিলাইজিং টিম গঠনের নির্দেশ ছিল। উপজেলা পর্যায়ে বিদ্যমান ৮টি সাব-ব্লকের জন্য ৮ জন, পৌরসভায় প্রতিটি ওয়ার্ডে ৫ জন এবং সিটি করপোরেশনে প্রতিটি টিকা দলের সঙ্গে ৫ জন সদস্য মবিলাইজেশন দলে কাজ করেছেন। এ টিমসমূহ সংশ্লিষ্ট এলাকাসমূহের বাড়ি বাড়ি গিয়ে এখনো টিকা পাননি এমন ব্যক্তির খোঁজ করে এবং টিকাদান কেন্দ্রে আসতে উদ্বুদ্ধ করেন।

বাংলাদেশ সব বাধাবিপত্তি পেরিয়ে দেশের বিপুলসংখ্যক প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম ও টিকা সংগ্রহ করেছে। বর্তমান দেশে প্রায় ১০ কোটি টিকা মজুদ রয়েছে। টিকা গ্রহণে প্রান্তিক ও পিছিয়ে পড়া ব্যাপক জনগোষ্ঠীকে সম্পৃক্ত করতে ভাসমান জনগোষ্ঠী, নিম্ন আয়ের জনগোষ্ঠী, পরিবহন ও কলকারখানাসহ সবস্তরের শ্রমিক, গর্ভবতী ও স্তন দানকারী নারী, স্কুল-মাদরাসা-বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীসহ সব বিশেষ জনগোষ্ঠীকে কোভিড-১৯ টিকার আওতায় এনেছে।

বাংলাদেশে অনুমোদিত ও ব্যবহৃত ভ্যাকসিনগুলোর মধ্যে বিশ্বব্যাপী ব্যবহৃত ও অনুমোদিত ভাইরাল ভেক্টর ভ্যাকসিন (যথা : কোভিশিল্ড), মেসেঞ্জার আরএনএ ভ্যাকসিন (যথা : ফাইজার, মডার্না, জনসন অ্যান্ড জনসন) এবং নিষ্ক্রিয় ভাইরাল ভ্যাকসিন (যথা : সিনোফার্ম ও সিনোব্যাক) প্রযুক্তির সফল ব্যবহার হচ্ছে। এসব ভ্যাকসিনই শরীরের প্রতিরোধী কোষগুলোকে উদ্দীপ্ত করে অ্যান্টিবডি সৃষ্টিতে সহায়তা করে। গবেষণায় দেখা গেছে, এসব ভ্যাকসিনের প্রতিটির ২ ডোজ, করোনা প্রতিরোধে ৮০-৯০ শতাংশ কার্যকর। বিশ্বব্যাপী বর্তমানে প্রচলিত ও অনুমোদিত ভ্যাকসিনগুলোর কোনোটিই করোনার সব ধরনের বিরুদ্ধে শতভাগ সুরক্ষা দেয় না, তবে সব ভ্যাকসিনই রোগের তীব্রতা, হাসপাতালমুখিতা এবং মৃত্যুহ্রাসে ভূমিকা রাখে।

বাংলাদেশের খ্যাতনামা গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও হাসপাতালগুলোর প্রায় প্রতিটিতেই গবেষণায় দেখা গেছে, করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছে এমন সবার প্রায় ৮০ ভাগ টিকা নেয়নি, হাসপাতাল ভর্তিদের ক্ষেত্রেও একই তথ্য-উপাত্ত পাওয়া গেছে। বাংলাদেশে করোনা সংক্রমণের ৩য় ঢেউয়ের জন্য দায়ী ওমিক্রন সংক্রমণ ক্ষণস্থায়ী হয়েছে জনগণের মধ্যে ব্যাপক ভ্যাকসিন প্রয়োগের ফলে; গবেষণায় তা উঠে এসেছে। এ ছাড়া বিভিন্ন দেশের গবেষণায় দেখা গেছে, ষাটোর্ধ্ব বয়স্ক, কো-মর্বিডিটি রয়েছে এবং ক্রমাগত করোনা আক্রান্ত ঝুঁকিতে রয়েছে- এমন ব্যক্তিদের টিকা গ্রহণে সংক্রমণ, হাসপাতাল ভর্তি এবং মৃত্যু কমিয়েছে সিংহভাগ।

উন্নত বিশ্বে যেখানে করোনা সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার প্রতিরোধে হিমশিম খাচ্ছে, সেখানে নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যেও করোনা প্রতিরোধে বাংলাদেশের সাফল্য প্রশংসনীয়। তদুপরি এখনো আমাদের সব পর্যায়ে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। ডেল্টা কিংবা ওমিক্রন সংক্রমণকে জয় করার পথে আমরা- এটি সত্য; তবে করোনা এখনো বিদায় নেয়নি। যেকোনো সময় নতুন কোনো ধরনের ভয়ংকর ঢেউয়ের মুখোমুখি হওয়ার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে। তাই সাবধানের কোনো মার নেই। আমরা সাবধান হব- এটাই শেষ কথা।

লেখক : সহকারী পরিচালক কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল, কুর্মিটোলা, ঢাকা

[email protected]

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
ভ্যাকসিন,করোনাভাইরাস,মহামারি
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close