লে. কর্নেল নাজমুল হুদা খান

  ২৮ অক্টোবর, ২০২১

কোভিড ভ্যাকসিনে বুস্টার ডোজের গুরুত্ব 

প্রাণসংহারী করোনা অতিমারিতে বিশ্বব্যাপী এ পর্যন্ত আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় ২৪ কোটি, মৃতের সংখ্যা প্রায় ৪৯ লাখেরও বেশি। এ ভয়ংকর অতিমারিকে রুখতে দ্রুতই আবিষ্কৃত হয় এ যুদ্ধের প্রধান অস্ত্র কোভিড ভ্যাকসিন। এ পর্যন্ত প্রায় ১৮টি ভ্যাকসিন বিশ্বব্যাপী অনুমোদিত ও ব্যবহৃত হচ্ছে। এরই মধ্যে ১৮২টি দেশে অক্সফোর্ড অ্যাস্ট্রাজেনেকা, ১৩৬টি দেশে ফাইজার, ৭৬টি দেশে সিনোফার্ম ও মডার্না, ৫৬টি দেশে জনসন অ্যান্ড জনসন, ৪৮টি দেশে স্পুৎনিক-ভি, ৪১টি দেশে সিনোব্যাক, সাতটি দেশে ক্যানসিনো ও ভারত বায়োট্যাক, তিনটি দেশে সিনোফার্ম-উহান, দুটি করে দেশে জেএফ-২০০১, আব্দালা, সোবারানা-০২, স্পুৎনিক লাইট, ইপি ব্যাক করোনা এবং একটি করে দেশে কোভিরান রাবেকাত, কাজব্যাক ও মেডিজেল প্রয়োগ করা হয়েছে।

কোভিড ভ্যাকসিন তৈরিতে মূলত চারটি প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে, যথাÑনিস্ক্রিয় ভাইরাল ভ্যাকসিন, ভাইরাল ভেক্টর ভ্যাকসিন, মেসেঞ্জার আরএনএ ভ্যাকসিন, প্রোটিন ভ্যাকসিন।নিস্ক্রিয় ভাইরাল ভ্যাকসিন তৈরিতে করোনা জীবাণুর মৃত কোষ ব্যবহার করা হয়, যা শরীরে রোগ সৃষ্টি করতে পারে না; কিন্তু প্রতিরোধী কোষগুলোকে উদ্দীপ্ত করে অ্যান্টিবডি সৃষ্টিতে সহায়তা করে। সিনোফার্ম ও সিনোভ্যাক ইত্যাদি এ প্রযুক্তিতে প্রস্তুত করা। এ ভ্যাকসিনগুলোর দুই ডোজ প্রায় ৮০ শতাংশ কার্যকর বলে প্রমাণিত। অক্সফোর্ড- অ্যাস্ট্রাজেনেকা ও স্পুৎনিক-ভি প্রভৃতি তৈরিতেভাইরাল ভেক্টর ভ্যাকসিনপ্রযুক্তি ব্যবহৃত হয়। মানবদেহে ক্ষতিকারক নয় এমন ভাইরাসের কোষে করোনাভাইরাসের উপাদান সংযুক্তির মাধ্যমে তৈরি এ ভ্যাকসিন শরীরে অ্যান্টিবডি সৃষ্টি করে আক্রান্ত ভাইরাস ধ্বংসে সক্ষম। অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার পূর্ণাঙ্গ ডোজ করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে প্রায় ৮৮ ভাগ সুরক্ষা দেয়। করোনাভাইরাসের জেনেটিক উপাদান মেসেঞ্জার আরএনএপ্রযুক্তিব্যবহারের মাধ্যমে ফাইজার ও মডার্না ভ্যাকসিন তৈরি। এসব ভ্যাকসিন প্রায় ৯০ শতাংশের ওপর করোনারোধী হিসেবে কার্যকর। করোনাভাইরাস কোষ প্রোটিনের একাংশ ব্যবহারের মাধ্যমে প্রোটিন ভ্যাকসিন প্রস্তুত করা হয়। নোভাভ্যাক্স ও স্যানফি-জিএসকে এ প্রযুক্তিতে তৈরি ভ্যাকসিন। দুই ডোজের এ ভ্যাকসিনও করোনাভাইরাসকে ৮০ শতাংশ রুখে দেওয়ার সক্ষমতা রয়েছে।

বর্তমানে প্রচলিত ও অনুমোদিত ভ্যাকসিনগুলোর কোনোটিই করোনার বিরুদ্ধে শতভাগ সুরক্ষা দেয় না। তবে রোগের তীব্রতা, হাসপাতালমুখী ও মৃত্যু হ্রাসে ভূমিকা রাখে প্রতিটি ভ্যাকসিন। তাই বলা হচ্ছে এসব ভ্যাকসিনের ঘোষিত প্রতিরোধ ক্ষমতা বা সুরক্ষার কমতি ঘটলে বুস্টার ডোজের প্রয়োজন হতে পারে। কোনো ভ্যাকসিনের প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরির মাত্রা ও নির্দিষ্ট সময় অতিক্রান্ত হওয়ার পর এর স্বাভাবিক কার্য ক্ষমতা কমে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকলে নির্দিষ্ট সময়ের পর বুস্টার ডোজ দেওয়া হয়। সাধারণভাবে হেপাটাইটিস, পোলিও, হুপিং কাশি, ধনুষ্টংকার ইত্যাদি ভ্যাকসিনে বুস্টার ডোজ দেওয়ার বিধান রয়েছে। অন্যদিকে কোনো ভ্যাকসিনের প্রতিরোধ ক্ষমতা সৃষ্টির নির্দিষ্ট সময় অতিক্রান্তের আগেই যদি হ্রাস পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে বা প্রমাণ মেলে তাহলে সুরক্ষার মাত্রা বজায় রাখতে অতিরিক্ত ডোজ ব্যবহার করা হয়।

কোভিড ভ্যাকসিনের বুস্টার ডোজ ব্যবহারের ক্ষেত্রে ভ্যাকসিনের প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস কিংবা প্রতিরোধ ক্ষমতা সৃষ্টি ও বজায় রাখার সময়সীমা গুরুত্বপূর্ণ। তবে করোনাভাইরাসের বিভিন্ন ধরন উদ্ভবের কারণে প্রায় সব ভ্যাকসিনের কর্মক্ষমতা ঝুঁকির মুখে পড়েছে। যদিও ভ্যাকসিনের সর্বোচ্চ কর্মদক্ষতা অনেক উপাদানের ওপর নির্ভর করে যথা-বয়সের প্রভেদ, জনগোষ্ঠীর তারতম্য এবং ভ্যাকসিন উপাদানের শ্রেণি বিভাগ ইত্যাদি। বুস্টার ডোজ প্রয়োগে ভ্যাকসিনের প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাসের বিষয়টি প্রথমে নিশ্চিত করতে হবে। মানবদেহে ভ্যাকসিন কর্তৃক তৈরি অ্যান্টিবডির পরিমাণ কমতে শুরু করলেই ওই ভ্যাকসিনের কার্য ক্ষমতা কম তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। কারণ অ্যান্টিবডি তৈরির ক্ষমতা বয়স, লিঙ্গ, কো-মরবিডিটি ইত্যাদি নানাবিধ বিষয়ের ওপর নির্ভর করে। তবে কোভিড ভ্যাকসিনের দেহে তৈরি অ্যান্টিবডি অন্তত ছয় মাস কার্যকরী থাকে; এ বিষয়ে সব ভ্যাকসিনই প্রায় নিশ্চিত করে বলেছে।

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক এফডিএ ৬৫ বছরের ঊর্ধ্বে যাদের বয়স, কো-মরবিডিটি রয়েছে এবং ক্রমাগত করোনা আক্রান্তের ঝুঁকিতে রয়েছে তাদের পূর্ণাঙ্গ ডোজ ভ্যাকসিন নেওয়ার ছয় মাস পর মডার্না ও ফাইজার ভ্যাকসিনের বুস্টার ডোজ প্রদানের অনুমোদন প্রদান করেছে। সিডিসি ঝুঁকি পূর্ণ পেশায় নিয়োজিত রয়েছে যেমন স্বাস্থ্যকর্মী, অগ্নিনির্বাপক দলের সদস্য, পুলিশ, শিক্ষক, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের স্টাফ, খাদ্য ও কৃষিকর্মী, পরিবহন ও উৎপাদন শ্রমিক, মুদি দোকানদার ইত্যাদি কাজে নিয়োজিতদের বুস্টার ডোজ প্রদানের সুপারিশ করেন। তবে বুস্টার ডোজ প্রদানের আগে ওইসব অঞ্চল বা দেশে সংক্রমণের হার, রোগের তীব্রতা, কো-মরবিডিটি, ঝুঁকির মাত্রা, ভ্যাকসিনের প্রকার ও সংক্রমিত করোনাভাইরাসের ধরনবিষয়ক তথ্যাদি নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে।

যুক্তরাজ্যের ভ্যাকসিন ও ইমিউনাইজেশনবিষয়ক জয়েন্ট কমিটি অ্যাস্ট্রাজেনেকার বুস্টার ডোজের সুপারিশ করেছে সত্যি কিন্তু কখন বা কাদের জন্য এ বুস্টার ডোজ প্রযোজ্য হবে তার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়নি। তবে প্রতিরোধ ক্ষমতায় দুর্বল ব্যক্তিদের তৃতীয় ডোজের বিষয়ে তারা অনুমোদন দিয়েছেন এবং বুস্টার ডোজের বিষয়ে অ্যাস্ট্রাজেনেকা ভ্যাকসিনকে নিরাপদ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। চীন দুর্বল প্রতিরোধক্ষম ব্যক্তিদের দেহে সিনোফার্মের তৃতীয় ডোজ ব্যবহার শুরু করেছেন। সংযুক্ত আরব আমিরাত সিনোফার্ম ভ্যাকসিনের দ্বিতীয় ডোজ নেওয়ার ছয় মাস পর বুস্টার ডোজ নেওয়ার নির্দেশনা প্রদান করেছে সে দেশের নাগরিকদের।

গবেষণায় দেখা গেছে বুস্টার ডোজ গ্রহণকারীদের মধ্যে বুস্টার নেয়নি এমন লোকদের চেয়ে আক্রান্তের হার ১১ গুণ কম এবং রোগের তীব্রতা ১৯ দশমিক ৫ গুণ হ্রাস পায়। আরেক গবেষণায় বুস্টার ডোজ গ্রহণকারীদের দেহে পাঁচ গুণ বেশি অ্যান্টিবডির অস্তিত্ব পাওয়া যায় এবং তৃতীয় ডোজ ব্যবহারে অ্যান্টিবায়োটিকের কার্য ক্ষমতাও বৃদ্ধি পায়। বুস্টার ডোজ ব্যবহারের ক্ষেত্রে বৈশ্বিক ভ্যাকসিন সরবরাহ ও প্রাপ্তির বিষয়টি সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। এটা সত্য যে, বৈশ্বিক করোনা অতিমারির সফল রোধে এ বিশ্বের সব দেশে সব মানুষকে ভ্যাকসিনের আওতায় আনতে হবে। বিশ্বে এ পর্যন্ত মোট জনসংখ্যার ৩৭৫ কোটি অর্থাৎ ৪৮ দশমিক ৭ শতাংশ মানুষ কমপক্ষে একটি ডোজ ভ্যাকসিন গ্রহণে সক্ষম হয়েছে। সম্পূর্ণ ডোজ সম্পন্ন করেছে এমন জনসংখ্যার শতকরা হার ৩৭ ভাগ। বিশ্বের প্রায় ২৫টি দেশে ভ্যাকসিন প্রদানের শতকরা ১০ ভাগের নিচে, প্রায় ২০টি দেশে ২০ শতাংশের নিচে, ১৬টি দেশে ৩০ শতাংশ, ৩২টি দেশে অর্ধেক মানুষ অর্থাৎ ৫০ শতাংশ লোককে ভ্যাকসিন প্রদান করা সম্ভব হয়েছে। বাংলাদেশে পূর্ণ ডোজ সম্পন্ন করেছেন এখন পর্যন্ত শতকরা ১১ ভাগ এবং প্রথম ডোজ শেষ করেছেন প্রায় ২৩ ভাগ। ১৯ অক্টোবর ২০২১ পর্যন্ত বাংলাদেশে ভ্যাকসিনের প্রথম ডোজ সম্পন্ন করেছে ৩ কোটি ৯১ লাখ ৬৮ হাজার ৯৪৮ এবং পূর্ণাঙ্গ ডোজ সম্পন্ন করেছে এমন সংখ্যা ১ কোটি ৯৬ লাখ হাজার ৩২ হাজার ১০৭। সেপ্টেম্বর ২০২১ অবধি যেখানে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশ গড়ে ২০ শতাংশ মানুষ প্রথম ডোজ ভ্যাকসিন সম্পন্ন করেছে, সেখানে উন্নত দেশগুলোর ৮০ ভাগ মানুষ ভ্যাকসিন পেয়েছে। সুতরাং এটি নিশ্চিত যে, বৈশ্বিকভাবে করোনা রোধে বুস্টার ডোজ প্রদানের বাস্তবতা এখনো নেই। তবে এরই মধ্যে ভ্যাকসিনের লক্ষ্যমাত্রা পূর্ণ করে অতিরিক্ত ডোজ কিংবা বুস্টার ডোজ গ্রহণ শুরু করেছেন এমন দেশের সংখ্যাও কম নয়।

বিশ্বের সব দেশের মানুষের ভ্যাকসিন প্রাপ্তি নিশ্চিত করার স্বার্থে ধনী রাষ্ট্রগুলোকে আপাতত বুস্টার ডোজ প্রদান কার্যক্রম স্থগিত রাখার পরামর্শ দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। তারা বলেছে বুস্টার ডোজ প্রয়োগ শুরু হলে বাংলাদেশসহ যেসব দেশের সিংগভাগ মানুষ ভ্যাকসিনের জন্য অপেক্ষায়, সেসব দেশে ভ্যাকসিন সরবরাহে ঘাটতি দেখা দেবে এবং সে ক্ষেত্রে বৈশ্বিক করোনা অতিমারির সফল নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল যুদ্ধটিই দীর্ঘায়িত হবে।

লেখক : সহকারী পরিচালক

কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল, ঢাকা

[email protected]

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
টিকা,করোনাভাইরাস,মহামারি
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close