গাজী শাহনেওয়াজ

  ০৬ জুলাই, ২০২১

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. মযহারুল হকের অভিমত

করোনা সংক্রমণ ঠেকাতে দরকার জনসম্পৃক্ততা

নভেল করোনাভাইরাস সংক্রমণের ঊধর্বগতি ঠেকানো, মৃত্যু কমিয়ে আনা এবং শনাক্ত নিয়ন্ত্রণে আনার দেশজুড়ে এই বিরাট কাজ সরকারের একার পক্ষে কখনোই সম্ভব নয় বলে মনে করেন আন্তর্জাতিকমানের জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. মযহারুল হক। জনসম্পৃক্ততা বাড়ানোর মাধ্যমে করোনা সংক্রমণ ও মৃত্যুঝুঁকি কমিয়ে আনা সম্ভব বলে অভিমত ব্যক্ত করেছেন এই জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ। দৈনিক প্রতিদিনের সংবাদের সঙ্গে একান্ত আলাপে তিনি এসব কথা বলেন।

মযহারুল হক বলেন, করোনা থেকে সুরক্ষা পাওয়ার ক্ষেত্রে সহজ সমাধান হচ্ছে লকডাউন এটা বিশ্বের সব দেশই করছে। মৃত্যু শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনতে মাঠপর্যায়ের উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোড রোগীরা কোয়ারেন্টাইন করছেন কি না, সেটা সঠিকভাবে তদারকি করতে হবে। এ ছাড়া আইসোলেশন ওয়ার্ড, রোগীদের চিকিৎসার যন্ত্রপাতি ও দক্ষ জনশক্তি নিশ্চিত করতে হবে। কারণ করোনার চিকিৎসার ক্ষেত্রে ওই অনুষঙ্গগুলো প্রাথমিক পদক্ষেপ। এগুলো যদি না থাকে, তাহলে যে অসুবিধাগুলো দেখা দেয় তা হলো এতে মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে যাবে। ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টে মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে চিকিৎসা শুরু হয় দেরিতে এবং রোগ নির্ণয় হয় বিলম্বে। একটা লোক ভুগছেন এক সপ্তাহ ধরে। অথচ যদি অ্যান্টিজেন টেস্ট করানো হয়, এটা সস্তা টেস্ট, ফ্রি টেস্ট এবং উপজেলাডই করানো হয়, তাহলে সামান্য চিকিৎসায় ওইসব রোগী দ্রুত সুস্থ হয়ে যাওয়ার কথা। কারণ বিনা চিকিৎসায় করোনা ভালো হয়। কিন্তু আমাদের দেশে সেই ব্যবস্থাটা অপ্রতুল।

যথাসময়ে চিকিৎসা শুরুর ওপর তাগিদ দিয়ে ডা. মযহারুল বলেন, করোনা আক্রান্ত হওয়ার পর ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ মানুষের চিকিৎসা লাগে না, এমনিতেই সুস্থ হয়ে যায়। এরমধ্যে বড় একটি অংশ করোনার উপসর্গ দেখা দিলে অ্যান্টিবায়োটিক খাবেন এবং একজন চিকিৎসকের পরামর্শ নেবেন। তাহলে বলা যায়, করোনা চিকিৎসা ছাড়াও ভালো হয় এবং অল্প চিকিৎসায় ভালো হয়, তাহলে তো মরার কথাই না। কিন্তু কিছু লোক দেরিতে চিকিৎসা নেওয়ার কারণে মারা যাচ্ছে।

এক দিনে ১৫০ জনের করোনা শনাক্ত হলেও তার মধ্যে মাত্র ২২ জনের চিকিৎসার প্রয়োজন হবে। এখন এই আক্রান্তদের কী চিকিৎসা লাগবে। এরমধ্যে তিনটি জিনিস গুরুত্বপূর্ণ তা হলো অক্সিজেন থাকতে হবে, অক্সিজেন মাস্ক থাকতে হবে এবং হাইফ্লো ন্যাজাল ক্যানোলা থাকতে হবে।

তিনি বলেন, এই তিনটি জিনিস যদি থাকে এবং র‍্যাপিড অ্যান্টিজেন টেস্ট করে রোগটি শনাক্ত করা হয় এবং প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া যায়, তাহলে মৃত্যুর সংখ্যা একেবারেই কমে যাবে। আর কে মরতে পারে, যার বয়স বেশি বা ষাটের ওপরে এবং হার্টে সমস্যা, কিডনি জটিলতা, ফুসফুস দুর্বল, ব্রেনস্ট্রোক ও লিভারের সমস্যা আছে তাদের মৃত্যুঝুঁকি বেশি এবং এই সংখ্যা ১৫ শতাংশ। এই রোগীরা করোনায় আক্রান্ত হলে শ্বাসকষ্ট ও নিউমোনিয়ায় মারা যেতে পারেন। এই রোগীরা করোনা আক্রান্ত না হলেও মারা যেতে পারেন, যোগ করেন ডা. মযহারুল হক।

তিনি বলেন, এই লোকগুলোর জন্য যেটা দরকার, সেটা হচ্ছে ভেন্টিলেটর, হাইফ্লো ন্যাজাল কযানোলা, অক্সিজেন ও আইসিইউ বেড। এখন এই চিকিৎসাসামগ্রীর সংখ্যাটা অত্যন্ত কম। কিন্তু প্রাথমিক চিকিৎসা যদি না দেওয়া হয়, তাহলে মৃত্যু বেশি বেড়ে যাবে, যেটা বাংলাদেশে হচ্ছে।

আমরা যদি অ্যান্টিজেন টেস্ট করতে পারতাম এবং একজন ব্যাক্তি অসুস্থ হয়েছেন গত তিন দিনে কতজন তার সংস্পর্শে এসেছিলেন ওই লোকগুলোকে কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিত করতে পারতাম, তাহলে করোনার বিস্তার ঘটত না। এরপর তাদের টেস্ট করাতে হবে, এটা র‍্যাপিড অ্যান্টিজেন টেস্ট। দেখা যাবে টেস্ট করার পর করোনা রোগীর সংখ্যাই খুব কম হবে। এদের টেস্ট করার পর আইসোলেট করে চিকিৎসা শুরু করতে হবে। সেই জায়গাই আরটিপিসিআর করে নিশ্চিত করতে হবে। এরপর আপনি করোনার চিকিৎসা শুরু করবেন। তবেই মৃত্যুর সংখ্যা শুধু কমবে না, থাকবেই না। ব্যাতিক্রম ক্রোমোডিজিস রোগী ছাড়া। অর্থাৎ শরীরে ক্যানসারসহ মরণব্যাধি রোগ যাদের আছে করোনায় তাদের মৃত্যুঝুঁকি বেশি। কারণ এ রোগে তাদের ল্যান্স ইনফেকশনটা বেশি হয়। এ কারণে তাদের ভেন্টিলেশন, আইসিইউ বেডে নিতে হয় এবং অক্সিজেন দিতে হয়। এসব ব্যাবস্থা থাকলে সেখান থেকেও সুস্থ হয়ে ফিরে আসতে পারেন। অন্যথায় মারা যাবেন। এ সংখ্যা ১ শতাংশের কম। এটি হলো চিকিৎসার পার্ট।

তিনি বলেন, এবার আসেন প্রতিরোধ অংশে। আপনার রোগ হওয়ার পর চিকিৎসা দেবেন, সেটা হয় না। রোগ না হওয়ার জন্য কী করতে হবে, সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। এরমধ্যে লকডাউন এমন একটা ব্যাবস্থা, যে ব্যাবস্থায় লোকজনকে স্থির করে ঘরে রাখা হয়। সে ঘরের বাইরে যেতে পারবে না। তাহলে তার সঙ্গে বাইরের কোনো লোকের দেখা-সাক্ষাৎ হবে না। তার ঘরেও কেউ আসবে না। সংক্রমণটা হয় মানুষের মাধ্যমে। মানুষ যখন চলাচল করবে না, তখন সংক্রমণ সীমিত হয়ে আসবে। এরপর যদি মানুষের বাইরে যেতে হয়, তাহলে সে অক্সিজেন মাস্ক পরবে, হাত স্যানিটাইজ করবে এবং একজনের কাছাকাছি হাঁটবে না। অন্তত তিন ফুট দূরে দূরে হাঁটবে। সবাইকে মাস্ক পরতে হবে। জনগণকে জানানো, তাদের সম্পৃক্ত করে অর্থাৎ জনগণ স্ব-ইচ্ছায় লকডাউনকে সমর্থন করবে এবং সরকারের দেওয়া বিধিনিষেধ মানবে। কারণ সরকারের একার পক্ষে করোনা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়।

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
সংক্রমণ,করোনাভাইরাস,জনস্বাস্থ্য
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close