নিজস্ব প্রতিবেদক

  ০২ জুলাই, ২০২১

জঙ্গিদের সুপথে আনার কাজ কতদূর?

দীর্ঘ ১৭ বছর আগে জঙ্গিবাদে জড়িয়ে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন আব্দুল্লাহ আল তাসনিম ওরফে নাহিদ। সময় গড়িয়েছে অনেক, এরমধ্যে তিনি তার ভুলও বুঝতে পেরেছেন। নিজের কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত নাহিদ নিজেই এখন জঙ্গিবাদ প্রতিরোধেই কাজ করতে চান। কিন্তু তার সুপথে ফেরার কোনো পথও খোলা নেই। কারণ কারাবন্দি জঙ্গিদের সুপথে ফিরিয়ে আনার কোনো কার্যক্রমই এখনো নেওয়া হয়নি।

অথচ জঙ্গিবাদ নিয়ে পর্যবেক্ষণ ও গবেষণাকারীরা বলছেন, জঙ্গিবাদ দমনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর অভিযানের পাশাপাশি জঙ্গিদের সুপথে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করাটা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এত বছর পরও কারাবন্দি জঙ্গিদের সুপথে ফিরিয়ে আনার কোনো কার্যক্রম শুরু না করাটা খুবই আশ্চর্যের বিষয়।

বাংলাদেশে নব্বই দশকের শুরু থেকেই উত্থান শুরু হয়েছিল হরকাতুল জিহাদের নামে ধর্মীয় জঙ্গিবাদের, প্রথমদিকে যার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন আফগানফেরত মুজাহিদরা। এই দশকের শেষভাগ থেকে শুরু হয় জঙ্গিদের সহিংস তৎপরতা। এর মধ্যেই জামআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ বা জেএমবিসহ আরো একাধিক জঙ্গি সংগঠনের আত্মপ্রকাশ ঘটে। জঙ্গিবাদ নিয়ন্ত্রণের জন্য বিভিন্ন সময়ে সরকার কঠোর আইন প্রয়োগ করে এলেও গ্রেপ্তার হওয়া জঙ্গিদের সুপথে ফিরিয়ে আনার প্রাতিষ্ঠানিক কোনো কার্যক্রমই হাতে নেয়নি। অথচ জেলে বসেই জঙ্গিদের আরো বেশি মোটিভেটেড, সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনা, সাধারণ বন্দিদের জঙ্গিবাদে মোটিভেটেড করাসহ অর্থ সংগ্রহের জন্য পেশাদার ডাকাতদের ব্যবহারের তথ্যও পাওয়া যাচ্ছে।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তথ্য বলছে, ২০১৬ সালের ১ জুলাই হলি আর্টিজান বেকারিতে ভয়াবহ হামলার পর থেকেই এখন পর্যন্ত প্রায় আড়াই হাজার জঙ্গিকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। এ ছাড়া আগে থেকেই কারাগারে রয়েছে আরো হাজারখানেক জঙ্গি। যাদের অনেকেই জামিনে বের হয়ে আবারও জঙ্গি তৎপরতায় নাম লিখিয়েছে। তবু কারাবন্দি জঙ্গিদের সুপথে ফিরিয়ে আনার সুনির্দিষ্ট কোনো কার্যক্রম নেই কেন?

‘আমাদের যেসব অফিসার দায়িত্বপ্রাপ্ত থাকেন, তারা অনেকেই (জঙ্গিদের সঙ্গে) কথা বলেন, যদিও সেগুলো ততটা টেকনিক্যাল কথাবার্তা না। কিছুটা তাদের বোঝানোর মতো, সেটি করা হয়। আমিও মনে করি এটা অবশ্যই পর্যাপ্ত না। তাদের (জঙ্গিদের) মোটিভেশনের কাছে আমাদেরটা খুবই অপর্যাপ্ত’ এক প্রশ্নের জবাবে বলছিলেন কারা মহাপরিদর্শক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোমিনুর রহমান মামুন, যিনি গত বছরের ৮ অক্টোবর থেকে কারা মহাপরিদর্শক হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছেন।

শীর্ষ এই কারা কর্মকর্তা জঙ্গিদের সুপথে ফেরাতে প্রাতিষ্ঠানিক কার্যক্রম নেওয়া উচিত মনে করেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের এখানে টেকনিক্যাল পারসন তৈরি করার অবশ্যই দরকার আছে। এটা আমাদের চিন্তাভাবনায় আছে। আপনি জানেন যে, আমাদের কারাগারে অনেক সংস্কারই করা হচ্ছে, সাংগঠনিক কাঠামো চেঞ্জ বা আমরা নতুনভাবে চিন্তাভাবনা করছি এবং কিছু কিছু কাজ হচ্ছে। আমি মনে করি, আমাদের এ ধরনের (জঙ্গি) বন্দি থাকবে। আমাদের সাংগঠনিক কাঠামোয় পরিবর্তন এনে এ ধরনের ইউনিট অর্থাৎ জঙ্গিদের ডির‌্যাডিক্যালাইজড করাটা বাংলাদেশ জেলের জন্য খুবই জরুরি।’

জঙ্গিবাদ প্রতিরোধে গঠিত বিশেষায়িত ইউনিট কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের কর্মকর্তারা বলছেন, তারা কারাবন্দি জঙ্গিদের ডির‌্যাডিক্যালাইজেশন বা সুপথে ফিরিয়ে আনার জন্য একটি প্রকল্প গ্রহণ করেছেন। হার্ড অ্যাপ্রোচ বা আভিযানিক প্রক্রিয়ার বাইরে সফট অ্যাপ্রোচের মাধ্যমে কারাবন্দি জঙ্গিদের সুপথে ফিরিয়ে আনার পরিকল্পনা করেছেন। এই প্রক্রিয়ার মধ্যে ইমাম বা ইসলামিক স্কলারদের সম্পৃক্ত করে জঙ্গিদের যে খণ্ডিত ধর্মীয় ব্যাখ্যা ও মতাদর্শ, তা খণ্ডন করে বোঝানো হবে। সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারাও থাকবেন। ইতোমধ্যে অন্তত আটজন জঙ্গি সদস্যকে জামিনে বেরিয়ে আসার পর কাউন্সেলিং করানো হয়েছে এবং তাদের পরিবারকে পুনর্বাসন করা হয়েছে।

‘বাংলাদেশ পুলিশ অর্থাৎ কাউন্টার টেররিজমের পক্ষ থেকে যে প্রজেক্টটা নেওয়া হয়েছে, তা অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে। আমরা ওনাদের স্বাগত জানিয়ে, ওনাদের যেহেতু এ বিষয়ে এক্সপার্টিজ আছে, প্রজেক্টটা অনুমোদন হলে জঙ্গিদের সুপথে ফিরিয়ে আনার বিষয়ে স্পেসিফিক করে কিছু একটা করা যাবে। আমরাও মানে আমাদের কারা কর্তৃপক্ষও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে উপকৃত হবে’ বলছিলেন কারা মহাপরিদর্শক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোমিনুর রহমান মোমিন।

দীর্ঘদিন ধরে জঙ্গিবাদ পর্যবেক্ষণ করে আসা মানবাধিকারকর্মী নূর খান লিটন বলেন, সহিংস তৎপরতা লক্ষ না করা গেলেও উগ্রপন্থির সংখ্যা বেড়েই চলছে। জঙ্গি মনোভাবাপন্ন মানুষের বেড়ে যাওয়াটা সমাজের জন্য বিশাল হুমকি। যদিও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা অনেক জঙ্গিকে গ্রেপ্তার করছে। কারাগারে হাজার হাজার উগ্রমতবাদের মানুষ বা জঙ্গি সদস্য যারা গ্রেপ্তার হয়েছে, তাদের মূল স্রোতধারায় ফিরিয়ে আনতে হবে। কিন্তু এ-সংক্রান্ত দৃশ্যত স্ট্রং কোনো কার্যক্রম পরিলক্ষিত হচ্ছে না। যা খুবই দুঃখজনক ও আশ্চর্যের বিষয়। তিনি বলেন, কারাগারগুলোয় বন্দি থাকা জঙ্গিদের মূলধারায় ফিরিয়ে আনার জন্য সচেতনতা তৈরি বা কাউন্টার ন্যারেটিভ দিয়ে তাদের বোঝাতে হবে। একই সঙ্গে তাদের ক্লোজলি মনিটরিং করতে হবে। একজন মানুষকে যতটা পারা যায় মূল স্রোতে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করতে হবে।

সমন্বয়হীন জঙ্গিবাদ প্রতিরোধ কার্যক্রম

বাংলাদেশে বহু বছর ধরে জঙ্গিবাদী কার্যক্রমকে অন্যতম প্রধান একটি সমস্যা মনে করা হলেও তা প্রতিরোধের কার্যক্রমে কোনো সমন্বয় নেই। এমনকি এখন পর্যন্ত জঙ্গিবাদ প্রতিরোধে জাতীয় কোনো কৌশলপত্রও তৈরি করা হয়নি। ফলে বিভিন্ন সংস্থা বা বিভাগ নিজের মতো করে জঙ্গিবাদ প্রতিরোধে কাজ করে যাচ্ছে। জাতিসংঘের উন্নয়ন কর্মসূচি বা ইউএনডিপি ও ইউএসএইডের সহায়তায় বেশ কিছু এনজিও জঙ্গিবাদ প্রতিরোধে কিছু কার্যক্রম চালিয়েছে। কিন্তু সমন্বয়হীনতা ও পৃথকভাবে জঙ্গিবাদ প্রতিরোধে কাজ করার ফলে প্রত্যাশামতো ফলাফল পাওয়া যাচ্ছে না বলে মনে করছেন জঙ্গিবাদ পর্যবেক্ষক ও গবেষকরা।

জঙ্গিবাদ প্রতিরোধের এই কার্যক্রমকে দুনিয়াজুড়ে সহিংস উগ্রবাদ প্রতিরোধ বা কাউন্টার বা প্রিভেনশন ভায়োলেটিং এক্সট্রিমিজম সিভিই কিংবা পিভিই নামে অভিহিত করা হয়। যদিও সরকারের পক্ষ থেকে সব সময়ই জঙ্গিবাদ দমনে শূন্য সহনশীলতা বা জিরো টলারেন্স নীতির কথা বলা হয়, কিন্তু সহিংস উগ্রবাদ দমনে জাতীয়ভাবে কার্যকর কোনো নীতিনির্ধারণী বডি বা সাংগঠনিক কাঠামো তৈরি করা হয়নি।

কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের এক কর্মকর্তা বলছেন, তারা জঙ্গিবাদ দমনে একটি ন্যাশনাল স্ট্র্যাটিজি বা জাতীয় কৌশলপত্র তৈরি করছে। যেখানে প্রিভেনশন বা প্রতিরোধ ও আভিযানিক বিষয়ে বিস্তারিত বিষয় উল্লেখ থাকবে। কৌশলপত্রটি তারা দ্রুততম সময়ের মধ্যেই সরকারের শীর্ষপর্যায়ে সাবমিট করবেন।

মানবাধিকারকর্মী নূর খান লিটন বলেন, ‘বাংলাদেশে যখন কোনো জঙ্গি হামলা হয়, তখন অনেক তোড়জোড় শরু হয়। হামলা না হলে সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের ব্যক্তিরা এটি ভুলে যায়। যা জঙ্গিবাদ প্রতিরোধে এটি একটি বড় অন্তরায় হয়ে দাঁড়াচ্ছে। জঙ্গিবাদ প্রতিরোধের জন্য রাজনৈতিক ঐকমত্যের ভিত্তিতে মহাপরিকল্পনা নেওয়া উচিত ছিল। কিন্তু তার বিপরীতে আমরা বিভিন্ন সংস্থার সমন্বয়হীন কিছু কাজ দেখছি। এভাবে জঙ্গিবাদ দমন সম্ভব নয়।’

বাংলাদেশে ২০১৬ সালের ১ জুলাই হলি আর্টিজানে নারকীয় জঙ্গি হামলার পর নড়েচড়ে বসেছিল সরকার। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানের পাশাপাশি সরকারের বিভিন্ন দপ্তর ও বিভাগ তৎপরতা শুরু করেছিল। এরমধ্যে ধর্ম মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে মসজিদে মসজিদে খুতবার আগে ইমামদের দিয়ে জঙ্গিবাদবিরোধী বক্তব্য দেওয়া, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে জঙ্গিবাদবিরোধী কর্মসূচি, ইসলামিক স্কলারদের কাজে লাগিয়ে জঙ্গিবাদবিরোধী ফতোয়া দেওয়া, পাঠ্যপুস্তকে জঙ্গিবাদবিরোধী প্রবন্ধ-নিবন্ধ সংযোজন, কাউন্টার ন্যারেটিভ প্রচার-প্রচারণা অর্থাৎ ইসলাম ধর্মে যে উগ্রবাদ নেই এবং সর্বোপরি অসাম্প্রদায়িক চেতনা প্রচার করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু কার্যত এখন কিছুই চলছে না।

জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তুক বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক নারায়ণ চন্দ্র সাহা বলছেন, ‘আমরা যে একেবারে কিছুই করছি না, তা না। পাঠ্যপুস্তকে জঙ্গিবাদবিরোধী বক্তব্য কিছু কিছু যোগ করা হয়েছে। আরো বিশদভাবে সংযুক্ত করার প্রক্রিয়া চলছে।’ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এক কর্মকর্তা বলছেন, ‘কোণঠাসা হলেও জঙ্গিরা কিন্তু থেমে নেই। তারা নিয়মিত অনলাইনে তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। তারা তাদের মতাদর্শ প্রচার করছে। সদস্য সংগ্রহ করছে। বড় করে আঘাত হানার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। আমরা তাদের নিয়ন্ত্রণের চেষ্ট করছি।’

কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের প্রধান মো. আসাদুজ্জামান বলেন, ‘আমরা হার্ড অ্যাপ্রোচ এবং সফট অ্যাপ্রোচ দুভাবেই কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের অধীনে একটি প্রজেক্ট চলমান রয়েছে। বিশেষ করে জঙ্গিদের ডির‌্যাডিক্যালাইজেশন, রিহ্যাবিলিটেশন, জঙ্গিবিষয়ক গবেষণা, কাউন্টার ন্যারেটিভ অ্যাকটিভিটিস, বিশেষ করে অ্যাওয়ারনেস প্রোগ্রাম সমানভাবেই চলছে।’

তিনি বলেন, ‘আমরা ইতোমধ্যে ৩৪ জেলায় সচেতনতানমূলক কার্যক্রম পরিচালনা করেছি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-শিক্ষার্থী, জনপ্রতিনিধি, প্রতিটি জেলার ইমাম-মুয়াজ্জিন, কারা কর্তৃপক্ষ সবাইকে অন্তর্ভুক্ত করে আমরা সচেতনতামূলক কাজ করেছি। করোনার কারণে কার্যক্রম বর্তমানে কিছুটা কম চলছে, কিন্তু চলমান রয়েছে।’

র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেছেন, ‘আমরা অভিযানের পাশাপাশি এখন পর্যন্ত ১৬ জন জঙ্গিকে পুনর্বাসন করেছি। বিভিন্ন ইসলামিক স্কলারদের সমন্বয়ে কোরআন হাদিস থেকে জঙ্গিবাদবিরোধী ব্যাখ্যা নিয়ে একটি বই প্রকাশ করা হয়েছিল। এ ছাড়া আমাদের আরো অন্যান্য সচেতনতামূলক কার্যক্রম চলছে।’

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
জঙ্গি,সুপথ,জঙ্গিবাদ,আইনশৃঙ্খলা
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close