সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম

  ১১ মে, ২০২১

জেগে উঠছে বাংলাদেশ

১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ কেমন ছিল বাংলাদেশের চেহারা? যারা জীবিত ছিলেন সেই সময় যেমন আমি ছিলাম তাদের কাছে মনে হয়েছিল দিনটি কান্নায় মোড়া, হতাশার মেঘে ছাওয়া। আমাদের মনে হয়েছিল সভ্যতা মুখ থুবড়ে পড়েছে অথবা লজ্জায় মুখ ঢেকে নিয়েছে। এত মানুষ খুন হলো, বেশির ভাগই রাতের অন্ধকারে। আমার এক বন্ধু ওইদিন সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, সে বদলা নেবে। ‘যে সেনাবাহিনী রাতের অন্ধকারে ঘুমন্ত মানুষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, তারা কাপুরুষ,’ সে বলেছিল, ‘এবং কাপুরুষদের মনে ভয় জাগানোর জন্য একটা হুঙ্কার আমাকে দিতে হবে’, আমার বন্ধুর মতো অসংখ্য মানুষ সেদিন ওরকম প্রত্যয়ে জেগে উঠেছিল।

১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসের ১৭ কী ১৮ তারিখ বিকালে সিলেটের সার্কিট হাউস মাঠে আমার বন্ধুটি মাথা উঁচু করে হাঁটছিল। তার পায়ের কাছে বসে থাকা এক দুর্ধর্ষ পাকিস্তানি কর্নেল কাপুরুষের মতো কাঁদছিল এবং প্রাণভিক্ষা করছিল।

মুক্তিযুদ্ধ যে কিছু শিক্ষা আমাদের দিয়েছিল, তার একটি ছিল যুদ্ধে লড়তে হয় বীরের মতো, মাথাটা উঁচু রেখে। মুক্তিযুদ্ধ আমাদের আরো শিখিয়েছিল, আত্মশক্তি অর্জন করলে মাথাটা উঁচু রাখা যায়, শত প্রতিকূলতার মধ্যেও।

এই পঞ্চাশ বছরে মুক্তিযুদ্ধের এ শিক্ষাগুলো কি আমরা মনে রেখেছি? আমরা কি মাঝে মাঝে কাপুরুষের ভূমিকায় নামি না? আত্মশক্তি হারিয়ে ফেলি না? আমরা কি একাত্তরের আদর্শগুলো বুকের ভেতরে নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি, জোর কদমে? আমরা কি বীরত্বের আদর্শগুলো ধরে রেখেছি?

যখন আন্দোলনের নামে বাসভর্তি মানুষকে পেট্রলবোমায় পুড়িয়ে মারা হয়, বোমা ফেলা হয় নিরীহ পথচারীদের ওপর, তখন কি আমাদের আচরণ হয় বীরের? আর যদি রাজনীতির বাইরে নজর দিই আমরা, তাহলে এত যে শিশু নিপীড়ন এবং হত্যার ঘটনা ঘটছে, নারীদের ওপর সহিংসতার মাত্রা বাড়ছে, ঘরের কাজের মেয়েদের নির্যাতন করা হচ্ছে, তখন কোন আচরণটা আমরা করি? কোন আচরণটা আমরা করি যখন আমাদের দেশের সংখ্যালঘুদের মন্দির-প্যাগোডা আমরা পুড়িয়ে দিই, মন্দিরের প্রতিমা-বিগ্রহকে চূর্ণ করে দিই, ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষদের নিপীড়ন করি, তাদের মেয়েদের নির্যাতন করি? এ আচরণ কি বীরের, না কাপুরুষের?

আত্মশক্তির যে উদাহরণ একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধারা, তাদের পরিবারের সদস্যরা দেখিয়েছিলেন, সে সময়কার রাজনৈতিক নেতৃত্ব দেখিয়েছিল, তা কি আমাদের এখনো আছে? আত্মশক্তি ও আত্মবিশ্বাসের মূল ভূমিকাটা হচ্ছে সততা, নিষ্ঠা, একাগ্রতা ও দেশপ্রেম। আমরা কি বুকে হাত দিয়ে বলতে পারি, এগুলোর সবটুকু অবশিষ্ট আছে আমাদের মধ্যে? আমরা কি একাত্তরে ফিরে গিয়ে একাত্তরের আয়নায় নিজেদের দেখতে পেয়ে বলতে পারি, ‘প্রত্যেকে আমরা প্রত্যেকের তরে?’ সেই বৃহৎ ঐক্য প্রচেষ্টাটা কোথায়, যা পঞ্চাশ বছর আগে এক কাতারে নিয়ে এসেছিল ধনী-গরিব, শহুরে-গ্রামীণ, শিক্ষিত-শিক্ষাবঞ্চিত মানুষজনকে?

এই পঞ্চাশ বছরে আমাদের অর্জন অনেক। আমরা কৃষিভিত্তিক সমাজ থেকে শিল্পভিত্তিক সমাজের দিকে যাচ্ছি; আমাদের জাতীয় প্রবৃদ্ধি দুই দশক ধরে ছয় থেকে সাত শতাংশের মধ্যে আছে; শিক্ষায় আমাদের বিস্তার ঘটেছে, নারী শিক্ষায় আমাদের অর্জন অবিশ্বাস্য। আমাদের মেয়েরা চার দেয়ালের ঘেরাটোপ থেকে মুক্তি নিয়ে ঢুকেছেন কর্মক্ষেত্রে; আমাদের খাদ্য উৎপাদন বরাবর আমাদের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার থেকেও বেশি হারে হয়ে আসছে। আমাদের যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নীত হচ্ছে, আমাদের তরুণ উদ্যোক্তারা ব্যবসা-বাণিজ্যবিমুখ বাঙালিকে নতুন এক অভিধায় অভিষিক্ত করেছেন, যা লন্ডনের প্রখ্যাত সংবাদ সাময়িকী দি ইকোনমিস্টের ভাষ্য অনুযায়ী ‘ব্যবসা সফল’। ব্যবসায় আমরা সফলই বটে এখন বাঙালি শুধু দেশে নয়, বিদেশেও ব্যবসা করছে। আমার এক অর্থনীতিবিদ বন্ধু জানালেন, বিদেশে নানা ব্যবসায় বাঙালিরা যে অর্থ বিনিয়োগ করেছে, আর দশ বছরে তার রিটার্ন বা লাভ ফেরত থেকে প্রায় এক বিলিয়ন ডলার দেশে আসবে প্রতি বছর।

এবং এসব উন্নতি হয়েছে ধীরে ধীরে চল্লিশ বছর ধরে। নানা ক্ষেত্রে, নানা উপায়ে। এ উন্নতি বাধাগ্রস্ত করতে পারেনি এক শ ধরনের সেকেলে নিয়মকানুন, উপনিবেশী যুগের সরকারি বিধিবিধান, ব্যাংক ও অন্যান্য ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানের চূড়ান্ত রক্ষণশীল নিয়মনীতি। অর্থাৎ মানুষ আর এখন সরকারের জন্য বসে থাকে না। বরং সরকারকে দূরে রেখেই নিজেদের কাজগুলো করে যাচ্ছে। যদিও সরকারের অবদানকে খাটো করে দেখতে নেই। সরকার যখন মানুষের কথা মনে রাখে, তখন উন্নতিটা নিশ্চিত হয়।

অর্থাৎ একদিকে একাত্তরের বীরত্ব, মাথাটা না নোয়ানো এবং আত্মবিশ্বাসের স্ফূরণ, অন্যদিকে কাপুরুষের মতো আচরণ, আত্মবিশ্বাস হারানো এ দুই বিপরীত স্রোতে দেশটা যখন এক অস্তিত্ব সংকটে, তখন হঠাৎ বাঙালি জেগে উঠেছে। অর্থনীতিই এই জেগে ওঠার মূল কারণ, তবে অর্থনীতির ভিত যারা গড়েছেন সেই কৃষক, শ্রমিক, নারী, উদ্যোক্তা, পেশাজীবী তারাই এ জাগরণের মূল নায়ক। এ জাগরণের পথে বাধা হয়েছিল নানা সংগঠন, প্রতিষ্ঠান, মতবাদ। কিন্তু এদের যে পরাজয় হচ্ছে, সে তো খোলা চোখেই আমরা দেখতে পাচ্ছি। ভাবতে অবাক লাগে, একাত্তরের সেই কৃষক-শ্রমিক-পেশাজীবী এখনো তো সক্রিয়, বন্দুকটা শুধু হাতে নেই, এই যা। একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা এখন একজন প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক, সত্যসন্ধ নির্ভীক সংবাদকর্মী, সংস্কৃতিসেবী, উদ্যোক্তা। এদের সম্মিলিত প্রয়াসে বাংলাদেশ জেগে উঠছে। ২. গত পঞ্চাশ বছরের ইতিহাসটা তাহলে মোটা দাগে আরেকবার দেখা যাক। মুক্তিযুদ্ধ ছিল বীরত্বের, আত্মশক্তিতে জেগে ওঠার এবং আত্মত্যাগের শ্রেষ্ঠ সময় ও উদাহরণ। কিন্তু সেই বীরত্ব ও আত্মপ্রত্যয় আমরা বেশিদিন ধরে রাখতে পারিনি। একাত্তরে একটি ভিন্ন বাহিনীও ছিল, যা ছিল অন্ধকারের, বর্বরতার : যার নানা নাম ছিল, কিন্তু তাদের একটিই পরিচয়, তারা মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশবিরোধী। এই বাহিনী যে কাজ করেছে, তা কাপুরুষের। কিন্তু একাত্তরে হেরে গেলেও তারা হাল ছেড়ে দেয়নি। একাত্তরে পরাজিত হয়েও তারা নানাভাবে তাদের কার্যক্রম চালিয়ে গেছে। এদের কারণে আমাদের জাতীয় জীবনে অনেক ক্ষতি স্বীকার করতে হয়েছে।

কিন্তু এদের পাশাপাশি আমাদের ঘরের ভেতরেই আরো প্রতিপক্ষ ছিল, এখনো আছে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট আমরা বুঝেছিলাম, আরো শত্রু লুকিয়ে আছে ঘরের ভেতর।

অনেক দিন আমরা দিকভ্রান্ত ছিলাম। পাকিস্তানের সহযোগী শক্তি, তাদের অনুসারীরা, স্বাধীনতাবিরোধীরা, স্বৈরশাসকরা আমাদের প্রভূত ক্ষতি করে গেছে। এদের সঙ্গে যোগ হয়েছিল রাজনৈতিক মাস্তানরা, নব্য ধনপতিরা, আদর্শচ্যুত রাজনীতিবিদ আর পেশাজীবীরা। আমাদের বিভ্রান্তি ছিল আমাদের জাতিসত্তা, পরিচিতি, ইতিহাস-সংস্কৃতি নিয়ে। দীর্ঘ দুই-আড়াই দশক ধরে যদি ইতিহাসের সত্যগুলোকে মিথ্যা প্রমাণ করে বিকল্প ইতিহাস পড়ানো হয়, তাহলে বিভ্রান্তি হয় সর্বগ্রাসী। আমাদের রাজনৈতিক ডিসকোর্স, আমাদের মিডিয়ার কণ্ঠ, আমাদের সুশীল সমাজ সর্বত্রই দেখা গেছে এ বিভ্রান্তি। কিন্তু বিভ্রান্তির সুড়ঙ্গ থেকে বেরিয়ে যাওয়াটা যে জরুরি, তাও খুব দ্রুত বুঝেছিল দেশের মানুষ, বিশেষ করে তরুণরা।

এর ফলে এখন এসব বিভ্রান্তিকে অতীতের বিষয় হিসেবেই ভাবার চেষ্টা করছে তরুণরা। তারা জানে সুড়ঙ্গের শেষ মাথায় যে আলো দেখা যায়, তার আরেক নাম বিভ্রান্তি থেকে মুক্তি। এই মুক্তির মানে অনেক, অভিঘাত প্রচুর। এ মুক্তি অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং বুদ্ধিবৃত্তিক, এই মুক্তিতে অংশ নেন নারী ও পুরুষ। এই মুক্তি আমাদের অধিকারও। ৩. এখন যে অবস্থানে আমরা দাঁড়িয়ে আছি, তা স্বাধীনতার পর থেকে চলে আসা ইতিহাসরেখার এক নতুন মোড় ফেরার। এই অবস্থান গত ১০-১৫ বছরেই সবচেয়ে পরিস্ফুট এবং এ পরিস্ফুটন সম্ভব হয়েছে কতগুলো কারণে। এখন মানুষ বুঝেছে, অর্থনৈতিক উন্নয়ন ছাড়া মুক্তি নেই এবং এ অর্থনীতির সঙ্গে জড়িত শিক্ষা, রাজনৈতিক স্থিতি, সামাজিক গতিশীলতা। এখন মানুষ জানে বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে না চললে বাংলাদেশকে পরমুখাপেক্ষী হয়ে পড়তে হবে। এজন্য প্রয়োজন স্বাবলম্বী হওয়া। স্বাবলম্বী হওয়ার জন্য সামাজিক ঐক্য দরকার; এ ঐক্যের মূলে যে দেশপ্রেম, তাও মানুষ বুঝতে পেরেছে, এবং সংকীর্ণ দলীয় রাজনীতি যে স্বাবলম্বী হওয়ার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়, দেশপ্রেমের মহিমাকে আচ্ছন্ন করে দেয়, মানুষ তাও বোঝে, মানুষ আরো বুঝতে পেরেছে নারীদের অর্থাৎ জনসংখ্যার পঞ্চাশ শতাংশকে দূরে রেখে, চার দেয়ালে বন্দি রেখে কোনো উন্নয়ন সম্ভব হয় না। এসবের সঙ্গে আরো আছে সংস্কৃতির শক্তি খোঁজা, নানা বৈষম্য ভাঙার প্রস্তুতি। ধর্ম আমাদের মানুষের একটি বড় আশ্রয়। মানুষ এখন বুঝেছে ধর্ম নিয়ে উগ্রতা এর পবিত্রতাকে ম্লান করে। ধর্মপ্রাণ মানুষ ধর্মের বাণীগুলো গ্রহণ করছে, কিন্তু ধর্ম নিয়ে নানা প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির রাজনীতিকে গ্রহণ করছে না।

মানুষ জাগছে, কারণ এ জাগরণের শব্দ আলস্যের নানা চিন্তাকে, অকর্মণ্যতার নানা অজুহাতকে অকেজো করে দেয়। মানুষ জাগছে, কারণ জাগরণ ছাড়া নতুন ভোরটাকে অনুভব করা যাবে না, এর অংশ হওয়া যাবে না। এই ভোরটা আমরা মুক্তিযুদ্ধের সফল পরিসমাপ্তিতে দেখেছিলাম। তারপর অনেক দিন আমরা অবচেতনের ঘুমে ছিলাম। তারপর অনেক অমানিশা কেটে আরেকটা নতুন ভোর দাঁড়িয়ে আমাদের দরজায়। তরুণরা আমাদের বলছে, এখন ওই ভোরটা, দিনটা বাংলাদেশের।

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
বাংলাদেশ,সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম,একাত্তর
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close