এ আর চন্দন

  ২৫ মার্চ, ২০২১

সেই কালরাত : খুলে গিয়েছিল নরকের সব দরজা

একাত্তরের ২৫ মার্চ রাতের গণহত্যা

‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামের নীলনকশা অনুযায়ীই একাত্তরের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনারা ভারী অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল নিরীহ বাঙালি জনগণের ওপর। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর তৎকালীন পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের জনসংযোগ কর্মকর্তা মেজর (পরে ব্রিগেডিয়ার) সিদ্দিক সালিকের ‘উইটনেস টু সারেন্ডার’ গ্রন্থেই ওই অভিযানের ভয়াবহ বিবরণ আছে।

বইটিতে বলা হয়েছে, ‘সেই রক্তাক্ত রাতের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো—অগ্নিশিখা আকাশকে বিদ্ধ করছিল। একসময় অগ্নিবর্ণের শোকার্ত ধূম্রকণ্ডলী ছড়িয়ে পড়ল, কিন্তু পরমুহূর্তেই সেটাকে ছাপিয়ে উঠল আগুনের লকলকে শিখা।’

২৫ মার্চ রাতের অভিযান শুরুর বর্ণনা দিয়ে সিদ্দিক সালিক লিখেছেন, ‘নির্দিষ্ট সময়ের আগেই সামরিক কার্যক্রম শুরু হয়ে যায়। এইচ-আওয়ার তথা আঘাত হানার নির্ধারিত মুহূর্ত পর্যন্ত স্থির থাকার চিহ্ন বিলুপ্ত হয়ে গেল। খুলে গেল নরকের সব দরজা।’ তার ভাষায়, ‘ঢাকাকে এক রাতেই অসাড় করে দেওয়া হলো।’

বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের ঘনিষ্ঠতম মিত্র ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। তারা তখন পাকিস্তানকে অস্ত্রও জোগান দিয়েছে বাঙালির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য। সেই যুক্তরাষ্ট্রেরই তখনকার কনসাল জেনারেল আর্চার কে ব্লাড ঢাকা থেকে পাকিস্তানি সৈন্যদের ভয়াবহ গণহত্যার বিবরণ দিয়ে অসংখ্য টেলিগ্রাম পাঠিয়েছিলেন ওয়াশিংটনে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরে। একটি টেলিগ্রামের শিরোনামই ছিল ‘সিলেক্টিভ জেনোসাইড’ অর্থাৎ বেছে বেছে গণহত্যা। ২৮ মার্চ পাঠানো ওই টেলিগ্রামে বলা হয়—

১. ঢাকায় পাকিস্তানি সেনারা যে-সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করছে আমরা তার নীরব ও আতঙ্কগ্রস্ত সাক্ষী। এ বিষয়ে তথ্য-প্রমাণ ক্রমেই বাড়ছে যে, মার্শাল ল’ কর্তৃপক্ষের কাছে আওয়ামী লীগ সমর্থকদের একটি তালিকা আছে আর সেই তালিকা ধরে ধরে তাদের বাড়ি থেকে ডেকে এনে গুলি করে সুচারুভাবে হত্যা করা হচ্ছে।

২. খতম করার জন্য যাদের চিহ্নিত করা হয়েছে তাদের মধ্যে আওয়ামী লীগের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি ছাড়া আছেন ছাত্রনেতা ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা। এ দ্বিতীয় ক্যাটাগরির মধ্যে আমরা খবর পাচ্ছি যে, দর্শন বিভাগের প্রধান ফজলুর রহমান ও একজন হিন্দু এবং ইতিহাস বিভাগের প্রধান এম আবেদীনকে হত্যা করা হয়েছে। রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের রাজ্জাককেও মেরে ফেলা হয়েছে বলে গুজব আছে। এ তালিকায় আরো আছে জাতীয় পরিষদের বহু নির্বাচিত সদস্য ও প্রাদেশিক পরিষদ সদস্যের নাম।

৩. এ ছাড়া পাকিস্তানি সেনাদের মদদে অবাঙালি মুসলিমরা নিয়ম করে দরিদ্র লোকজনের বাড়িঘর আক্রমণ করছে এবং খুন করছে বাঙালি ও হিন্দুদের।

পরে এক লেখায় আর্চার কে ব্লাড উল্লেখ করেন, ‘আমরা অনুভব করলাম, বাঙালি মুসলমানদের সকল হত্যাকেই ‘গণহত্যা’ বলে বিশেষায়িত করাটা যথাযথ হবে না। লড়াই জোরদার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দুপক্ষই নৃশংসতা চালাচ্ছিল। যদিও বিনা উসকানিতে সেনাবাহিনীর গুলি চালানোর খবর আমরা তখনো পাচ্ছিলাম। তবে মনে হয়েছিল, গ্রামাঞ্চলে নিয়ন্ত্রণ সুনিশ্চিত করতে সামরিক উদ্দেশ্যে সেনাবাহিনী তার সহিংসতা আরো বাড়িয়ে চলেছে। অন্যদিকে, বেছে বেছে হিসাব করে হিন্দুদের ওপর নগ্ন হামলার বর্ণনায় ‘জেনোসাইড’ শব্দটি সবচেয়ে কার্যকর মনে হলো। এরপর থেকে আমাদের রিপোর্টে হিন্দুদের ওপর আক্রমণের বিষয়টি উল্লেখ করার সময় ‘জেনোসাইড’ শব্দটি ব্যবহার করতে শুরু করলাম।’

প্রথমে বাড়িঘরে আগুন, পরে গুলি করে হত্যা : একাত্তরের ২৯ মার্চ ঢাকা থেকে মার্কিন কনসাল জেনারেল আর্চার কে ব্লাড ওয়াশিংটনে পররাষ্ট্র দপ্তরে যে টেলিগ্রাম বার্তা পাঠিয়েছিলেন তাতে উল্লেখ আছে—‘মনে হচ্ছে হিন্দুরাই সামরিক অভিযানের বিশেষ লক্ষ্য, যদিও হিন্দু অধ্যুষিত নয় এমন এলাকাও জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছারখার করে দিচ্ছে।’

আমেরিকান যাজকদের উদ্ধৃতি দিয়ে ব্লাডের ওই টেলিগ্রাম বার্তায় বলা হয়, পুরান ঢাকায় কিছু ব্যারিকেড ছাড়া বাঙালিদের দিক থেকে কোনো উসকানি না থাকা সত্ত্বেও অগ্নিসংযোগ ও গুলিবর্ষণ করে লোকজনকে হত্যা করেছে সৈন্যরা। সৈন্যদের কৌশলটা ছিল, প্রথমে বাড়িঘরে আগুন ধরিয়ে দেওয়া। প্রাণ বাঁচাতে ওইসব বাড়ির বাসিন্দারা বাইরে বেরিয়ে আসতে শুরু করলে তখন তাদের গুলি করে মারা। ২৫ মার্চ রাতে ঢাকায় ১১ সদস্যের একটি পরিবারের সবাইকে গুলি করে মারার তথ্যও আছে ওই টেলিগ্রামে। ১৯৯৮ সালে দলিলটির ওপর থেকে গোপনীয়তা তুলে নিয়ে আর্কাইভে উš§ুক্ত করে দেয় মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর।

ট্যাংকস ক্রাশ রিভল্ট ইন পাকিস্তান : ২৫ ও ২৬ মার্চের ঢাকায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ধ্বংসলীলার চাক্ষুষ বর্ণনা প্রথম বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরেন লন্ডন থেকে প্রকাশিত ‘ডেইলি টেলিগ্রাফ’-এর সাংবাদিক সাইমন ড্রিং। ৩০ মার্চ ১৯৭১ ডেইলি টেলিগ্রাফ ‘ট্যাংকস ক্রাশ রিভল্ট ইন পাকিস্তান’ শিরোনামে প্রকাশ করে সাইমন ড্রিংয়ের প্রথম প্রতিবেদনটি। এতে বলা হয়, ‘আল্লাহ ও অখণ্ড পাকিস্তান রক্ষার নামে ঢাকা আজ ধ্বংস ও ভীতির নগরী। পাকিস্তানি সৈন্যদের ঠান্ডা মাথায় টানা ২৪ ঘণ্টা গোলাবর্ষণের পর ওই নগরীর সাত হাজার মানুষ নিহত হয়েছে। মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে বিস্তীর্ণ এলাকা। আর পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতার লড়াইকে নির্মমভাবে থামিয়ে দেওয়া হয়েছে। দেশটির সামরিক সরকারের প্রধান প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান যদিও দাবি করছেন যে পরিস্থিতি এখন শান্ত, তবু রাস্তাঘাটে দেখা যাচ্ছে গ্রামের দিকে পলায়নরত অযুত অযুত মানুষ। শহরের রাস্তাঘাট ফাঁকা এবং প্রদেশের অন্যান্য স্থানে হত্যাযজ্ঞ চলছে। তবে সন্দেহ নেই যে ট্যাংকের ছত্রছায়ায় সৈন্যরা শহর ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ লোকালয় নিয়ন্ত্রণ করছে।... সামান্যতম অজুহাতে লোকজনকে গুলি করে মারা হচ্ছে। নির্বিচারে গুঁড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে বাড়িঘর। ঠিক কত নিরীহ মানুষ এ পর্যন্ত জীবন দিয়েছে, তার সঠিক হিসাব বের করা কঠিন। তবে ঢাকার সঙ্গে চট্টগ্রাম, কুমিল্লা ও যশোরের হিসাব যোগ করলে এ সংখ্যা ১৫ হাজারে দাঁড়াবে। যা পরিমাপ করা যায় তা হলো সামরিক অভিযানে ভয়াবহতা। ছাত্রদের হত্যা করা হয়েছে তাদের বিছানায়, বাজারে কসাইদের মেরে ফেলা হয়েছে তাদের দোকানের পেছনে, নারী ও শিশুরা জীবন্ত দগ্ধ হয়েছে, একসঙ্গে জড়ো করে মারা হয়েছে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের, জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে বাড়িঘর, বাজার ও দোকানপাট।’

রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে হামলার বর্ণনা দিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘একদিকে যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আক্রান্ত হয়, তখন শহরের অন্যদিকে আরেক দল সৈন্য আক্রমণ করে রাজারবাগ পুলিশ সদর দপ্তর। প্রথমে ট্যাংক থেকে গোলাবর্ষণ করা হয়। পরে সৈন্যরা ঢুকে পুলিশের ব্যারাকগুলো মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেয়, ওইসব ব্যারাকে তখন পুলিশ সদস্যরা ঘুমিয়ে ছিল। এ হামলায় ঠিক কতজন নিহত হয়েছিল তার সঠিক হিসাব যদিও জানা যায়নি, তবে ধারণা করা হয়, ওই সময় সেখানে অবস্থানকারী ১১০০ পুলিশের মধ্যে অল্প কজনই রেহাই পেয়েছিল।’

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
কালরাত,২৫ মার্চ রাত,গণহত্যা,একাত্তর
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close