মো. তাজুল ইসলাম

  ২২ মার্চ, ২০২১

মুজিববর্ষ

বঙ্গবন্ধুর দর্শনই লক্ষ্যে পৌঁছানোর পাথেয়

মানবতার জন্য জন্ম যার তাকে স্মরণে রাখার প্রয়োজন শত শত বছরের অনাগত মানুষের উন্নত জীবনের জন্য। সমৃদ্ধি, শান্তি ও ন্যায়বিচারের জন্য। শারীরিক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অসম্ভব, কিন্তু আদর্শিক মুজিব চিরন্তন। তার আদর্শকে ধারণ করলে অর্থনৈতিক উন্নয়ন হবে, মানুষের মাঝে সম্প্রীতি বাড়বে, পরস্পরকে মর্যাদা দেওয়ার মানসিকতা সৃষ্টি হবে, ক্ষুধা-দরিদ্রতা দূর হবে। এই মহামানবের আদর্শ আমাদের খুব বড় প্রয়োজন। তিনি আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাকে প্রতিটি ক্ষেত্রেই স্মরণ করি অনেক বেশি।উদযাপন করতে চাই সর্বান্তকরণে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী। নিঃস্বার্থ আর নির্মোহ মুজিবকে তুলে ধরতে চাই জাতির সামনে যেন প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম মানবিক হয়, ন্যায়বোধ সৃষ্টি হয়, অসত্য ও পক্ষপাতিত্বের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর শক্তি সৃষ্টি হয়। পিতৃ-ভ্রাতৃত্বহীন বোনের সম্মান রক্ষায়, সন্তানহীন, স্বামীহারা মায়ের অধিকার ও সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা এবং বৈষম্যহীন দেশ গড়ার যে শিক্ষা পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দিয়েছেন সারাটি জীবন, তা স্বীয় মর্যাদায় রক্ষা করা বড় প্রয়োজন। প্রয়োজন পৌঁছে দেওয়া এই প্রজন্মের কাছে আদর্শিক মুজিবকে; যাতে সবাই বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে ধারণ করে সৎ গুণের অধিকারী হয়।------ যে মানুষটি বেঁচে থাকলে ২০০০ সালের মধ্যেই বাংলাদেশ সিঙ্গাপুর হতো বলে ধারণা করা হয়। আমাদেরও শিক্ষা, স্বাস্থ্য, যোগাযোগব্যবস্থা ও মানুষের জীবনযাপন উন্নত দেশের মতো হতো। দেশ থেকে চিরবিদায় নিত সব অন্যায়-অবিচার ও বৈষম্য। কিন্তু সেই মহান মানুষকে হত্যা করে তার সেই স্বপ্নযাত্রা থমকে দেয় স্বাধীনতার পরাজিত শক্তির দোসররা। আর এ নির্মম হত্যাকান্ডে অংশ নেয় কিছু বিপথগামী জুনিয়র সেনা অফিসার। পুরো বিষয় অজানা ছিল সমগ্র বাহিনীর কাছে। তাদের প্রতি সমর্থন ছিল না ৯৯ ভাগ সেনাসদস্যের। কিন্তু পর্দার অন্তরালে থেকে ওপরের কিছু কর্মকর্তার যে হাত ছিল, তা ওই সময়ের ও পরবর্তী ঘটনা থেকে বোঝা যায় পরিষ্কারভাবে। যেমন ব্রিগেডিয়ার আমিনুল ইসলাম ঘটনার পরপর যখন বড় আশা করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সেনাবাহিনীর উপপ্রধান জেনারেল জিয়ার কাছে গিয়ে বললেন, স্যার ‘প্রেসিডেন্ট কিলড’, তার উত্তর ছিল, ‘লেট ভাইস প্রেসিডেন্ট টুক ওভার দ্য পাওয়ার, উই হ্যাভ নাথিং টু ডু অ্যাবাউট পলিটিকস’। প্রশ্ন হলো এটা কি পলিটিকস ছিল?কিছু বিপথগামী জুনিয়র সেনা কর্মকর্তার নেতৃত্বে জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যা করা হয়, এই কথা যখন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে জানানোর পর এ রকম উত্তর আসে প্রিয় পাঠক, এর অর্থটা কী, তার আর ব্যাখ্যার প্রয়োজন আছে কি? বাংলাদেশের সেনাবাহিনী আমাদের দেশের গর্বিত সন্তানদের গর্বিত প্রতিষ্ঠান। বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার পর দেশের গৌরবোজ্জ্বল এই প্রতিষ্ঠানকে নিজের হৃদয়ের ভালোবাসা দিয়ে গড়ে তুলছিলেন। যে জিয়াউর রহমানকে বঙ্গবন্ধু মেজর থেকে মেজর জেনারেল করে উপ-সেনাপ্রধানের দায়িত্ব দিয়েছিলেন, তিনি বলেন হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া তার দায়িত্ব নয়! প্রশ্ন দাঁড়ায় তাহলে কার দায়িত্ব? জিয়াউর রহমান যে প্রতিষ্ঠানের উপপ্রধান, সেই প্রতিষ্ঠানের অধীন কেউ অপরাধ করলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেওয়ার কথা বলার অর্থ কি দাঁড়ায় না যে, তিনিও ওই অপরাধে জড়িত?পরবর্তী সময়ে চার জাতীয় নেতাকে হত্যার পর হত্যাকারীদের নিরাপদে বিদেশ যাওয়ার সুযোগ এবং ওইসব হত্যাকারীকে বিভিন্ন দূতাবাসে তাদের যোগ্যতার ওপর চাকরি দিয়ে বিলাসী জীবনযাপনের ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়। বঙ্গবন্ধুর এই হৃদয়বিদারক হত্যাকান্ডের বিচার না হওয়ার জন্য হত্যাকারীদের ইনডেমনিটি দিয়ে ছিলেন জিয়াউর রহমান।জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সারা জীবনের ত্যাগ, সংগ্রাম, অবদান মুছে ফেলতে অসত্য বইপুস্তক লেখা হয়েছে। মহান মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের অসম্মানিত করার জন্য স্বাধীনতাবিরোধী শাহ আজিজকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বানানো হয়। যে গোলাম আযম মহান স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় বলেছিলেন, যে জাতি উচ্ছৃঙ্খল হয়ে যায়, সেখানে নারী নির্যাতন জায়েজ আছে। স্বাধীনতার পর লন্ডনে পূর্ব পাকিস্তান পুনরুদ্ধার কমিটি ও এই কমিটির অফিস স্থাপন করে মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুসলমানদের ওপর অত্যাচার ও ইসলাম ধর্ম ধ্বংস করা হচ্ছে বলে বিভিন্ন অপপ্রচার চালিয়ে মুসলিম দেশগুলোকে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার চেষ্টা করান। সেই ব্যক্তিকে জিয়াউর রহমান পাকিস্তানি পাসপোর্টে বাংলাদেশে আসা ও থাকার ব্যবস্থা করে দেন। পরবর্তী সময় বেগম খালেদা জিয়ার সরকার তাকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব দেয়।জাতির পিতার হত্যার পরবর্তীকালে ২১ বছরের ধারাবাহিক অগণতান্ত্রিক শাসনে মানুষ দারিদ্র্য থেকে দারিদ্র্যতম হয়েছিল, খাদ্য ঘাটতি বাড়ছিল। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, যোগাযোগব্যবস্থার উন্নতি হয়নি। প্রশাসনিক ব্যবস্থার মধ্যে সমন্বয়হীনতা সৃষ্টি করে সব জনপ্রতিনিধিত্বশীল প্রতিষ্ঠান ও সরকারি প্রতিষ্ঠানকে ক্ষতিগ্রস্ত করার পাশাপাশি মানবিক মূল্যবোধের পতন ঘটানো হয়।পাঠকদের সহজভাবে বোঝানোর জন্য স্বাধীনতার আগে ও পরে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার কিছু পরিসংখ্যান এখানে তুলে ধরতে চাই। যতটুকু জানি, ১৯৪৭ সালে এ দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় ছিল ৫৭ ডলার। পাকিস্তানের ২৫ বছর (১৯৪৭-১৯৭১) পর যখন বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আমরা স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করি, তখন আমাদের মাথাপিছু আয় ছিল ১৩৩.৫৪ ডলার। ১৯৭২ সালে যুদ্ধবিধ্বস্ত স্বাধীন দেশ যখন গড়ার দায়িত্ব নেন বঙ্গবন্ধু, তখন মাথাপিছু আয় ছিল ৯৪.৩৮ ডলার। কিন্তু ১৯৭৫ সালে যে বছর বঙ্গবন্ধুকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়, তখন মাথাপিছু আয় দাঁড়ায় ২৭৭.৫৭ ডলারে। দেখা যায়, পাকিস্তানের ২৫ বছরে মাথাপিছু আয় (১৩৩.৫৪-৫৭) ৭৬.৫৫ ডলার বৃদ্ধি পেয়েছে। আর জাতির পিতা প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত দেশের দায়িত্ব নিয়ে মাত্র সাড়ে তিন বছরে (২৭৭.৫৬-৯৪.৩৮) ১৮৩.১৮ ডলার বৃদ্ধি করেন। আবার বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ প্রথম ক্ষমতায় আসার আগের বছর ১৯৯৫ সালে মাথাপিছু আয় ছিল ৩২৯.৮২ ডলার অর্থাৎ যেখানে বঙ্গবন্ধু মাত্র সাড়ে তিন বছরে ১৮৩.১৮ ডলার বৃদ্ধি করেন, সেখানে বঙ্গবন্ধুবিহীন বাংলাদেশে ২০ বছরে (১৯৯৫-১৯৭৫) মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি পেয়েছে (৩২৯.৮২-২৭৭.৫৭) ৫২.২৫ ডলার।১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনা সরকার গঠন করার পর খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা, বিদ্যুৎ উৎপাদন বহু গুণ বৃদ্ধি, গ্রামীণ যোগাযোগব্যবস্থার উন্নতি, শিক্ষা এবং মানুষের স্বাস্থ্যসেবার পরিবর্তনসহ নানা ক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নয়নের ফলে অর্থনৈতিক অবস্থার ঊর্ধ্বমুখী পরিবেশ তৈরি হয়। কিন্তু ২০০২ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের অর্থনীতি মন্থরগতিতে চললেও ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে দেশে অর্থনীতির দ্রুত প্রবৃদ্ধি শুরু হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় টানা ১২ বছরে মাথাপিছু আয় প্রায় দাঁড়িয়েছে বর্তমানে ২১০০ ডলারে। ইতোমধ্যে আমরা বিশ্বব্যাংক কর্তৃক নিম্নমধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছি। এ ছাড়া ২০১৮ সালে জাতিসংঘ বাংলাদেশকে প্রাথমিকভাবে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তীর্ণ হওয়ার যোগ্য বলে বিবেচনা করে। উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের জন্য মাথাপিছু আয়, মানবসম্পদ উন্নয়ন এবং অর্থনৈতিক ঝুঁকিÑ এই তিনটি বিষয়ের মধ্যে ন্যূনতম দুটিতে উত্তীর্ণ হলে উন্নয়নশীল দেশ হওয়া যায়। কিন্তু বাংলাদেশ এই তিনটি বিষয়ের সবগুলোতে জাতিসংঘের নির্ধারিত সীমা থেকে অনেক ভালোভাবে উত্তীর্ণ হয়। আর নিয়ম অনুযায়ী ২০২১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশকে জাতিসংঘ কর্তৃক উন্নয়নশীল দেশে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার চূড়ান্ত সুপারিশ করা হয়েছে।বাংলাদেশের এই অভূতপূর্ব উন্নয়নের কারণে বিশ্ব আজ বাংলাদেশকে উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে মনে করছে। বাংলাদেশের উন্নয়ন আজ বিশ্ববাসীর কাছে অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। এই অর্জনের পরিকল্পনা ও নেতৃত্ব দিচ্ছেন জাতির পিতার সুযোগ্য কন্যা, অত্যন্ত মেধাবী, বিরল প্রতিভার অধিকারী বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি দাবি করেন, তার এই অভূতপূর্ব সফলতার পেছনের কারণ হলো বঙ্গবন্ধুর দর্শন, চিন্তা ও চেতনা; যা তিনি বুকে ধারণ করে পথ চলছেন।১৭ মার্চ ২০২১ বঙ্গবন্ধুর শততম জন্মবার্ষিকী। আমরা পুরো জাতি হৃদয়ের সব ভালোবাসা দিয়ে এই দিবস উদযাপন করেছি। এই দিবসটি পালনের মাধ্যমে আগামী প্রজন্মের কাছে বাস্তব বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে তুলে ধরে বিভিন্ন আঙ্গিকে তার জীবনের প্রতিটি অধ্যায় জানার সুযোগ করে দিতে চাই। তাতে নতুন প্রজন্ম বঙ্গবন্ধুকে জানবে, তার আদর্শ ও চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে একজন সৎ, ন্যায়বান দেশপ্রেমিক হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলার সুযোগ পাবে। বিনির্মাণ করবে সুখী, সমৃদ্ধ-উন্নত বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা।

লেখক : মন্ত্রী, স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার

পিডিএসও/এসএম শামীম

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
বঙ্গবন্ধুর দর্শন,লক্ষ্যে পৌঁছানো
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close