০৮ মার্চ, ২০২১

সেবিকা সাহসিকা রুনু কস্তা

কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের সিনিয়র স্টাফ নার্স রুনু ভেরোনিকা কস্তা

বিশ্বে নভেল করোনাভাইরাস মহামারিতে সবস্তরের মানুষ যখন মৃত্যুভয়ে আতঙ্কগ্রস্ত সে কঠিন সময়েও মানবতার সেবায় এগিয়ে এসেছেন রুনু ভেরোনিকা কস্তা। তিনি কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের সিনিয়র স্টাফ নার্স। দেশে কোভিডপ্রতিরোধী টিকাও প্রথম নিয়েছেন সেবিকা সাহসিকা রুনু কস্তা।

দেশে কোভিডের প্রাদুর্ভাব দেখা দেওয়ার পর পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে সেবার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন এই সেবিকা। প্রতিষ্ঠানের নিয়ম অনুযায়ী প্রতি ১৫ দিন ডিউটি করার পর ১৫ দিন ছুটিতে আইসোলেশনে কাটাচ্ছিলেন। দেশে কোভিডপ্রতিরোধী টিকাদান শুরু হওয়ার আগ মুহূর্তে ছুটিতে ছিলেন বাবার বাড়িতে।

রুনু জানান, গত ২৪ জানুয়ারি দুপুরের দিকে হাসপাতালের নার্সিং সুপারিনটেনডেন্ট তাকে কল করে বলেন, ‘রুনু তুমি কি করোনার ভ্যাকসিন নেবে?’ রুনু জবাবে বলেছিলেন, তার স্বামীর সঙ্গে কথা বলে জানাবেন। বিকালে আবার কল করে জানতে চাওয়া হয় তিনি টিকা নেবেন কি না। তখনো একই উত্তর দেন। এরপর আবার জানতে চাওয়া হলে রুনু কস্তা টিকা নিতে সম্মতির কথা জানান।

রুনু কস্তা প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, ‘এরপর স্বামীর সঙ্গে ভ্যাকসিন নেওয়ার বিষয়ে আলাপ করি। আমার স্বামী পবন কস্তা তখন বলেন, ‘করোনার সময় রোগীদের সেবা দিতে তুমি আমাদের ছেড়ে চলে গেছো। তখন বাধা দিইনি। টিকা তো জীবন রক্ষাকারী অবশ্যই নেবে।’ স্বামীর কথা শুনে আরো সাহসী হয়ে উঠি। কিন্তু আমিই যে প্রথম টিকা নেব তা তখনো জানতাম না।’

অবশেষে গত ২৭ জানুয়ারি দেশে প্রথম কোভিডপ্রতিরোধী টিকা নিলেন রুনু ভেরোনিকা কস্তা। এর জন্য গর্ববোধ করেন তিনি। রুনু বলেন, ‘টিকা নেওয়ার আগ মুহূর্তে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভার্চুয়াল মাধ্যমে যুক্ত হয়ে উৎসাহ দিয়ে বলছিলেন, ‘রুনু তুমি খুব সাহসী।’ এতে আমি এতটাই উদ্দীপ্ত ও উৎফুল্ল হই যে, টিকা নেওয়ার সময় টেরই পাইনি।’

এই মহামারিতে প্রথম টিকা নেওয়ার ক্ষেত্রে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল এবং তার মতো একজন নারীকে নির্বাচন করায় প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানান তিনি।

রুনু কস্তা বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী ভার্চুয়ালি নারায়ণগঞ্জে কুমুদিনী ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব মেডিকেল সায়েন্সেস অ্যান্ড ক্যানসার রিসার্চের ভিত্তি স্থাপন করেন। অনুষ্ঠানে আমাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। সেখানে যাওয়ার পর কুমুদিনীর স্বত্বাধিকারীর অন্যতম রাজিব প্রসাদ সাহার এক দাদা দাঁড়িয়ে আমাকে স্যালুট করেন। তিনি বলেন, ‘তুমি মেয়ে হিসেবে জাতির জন্য যে কাজ করেছ, তা হয়তো তুমি বুঝতেই পারছ না। তুমি ইতিহাসের পাতায় কালের সাক্ষী হয়ে রইলে।’

রুনুর বাবা বার্নাড কস্তা ছিলেন একজন কৃষক আর মা বিনীতা কস্তা গৃহিণী। তার মা ছিলেন শিক্ষানুরাগী। তিনি এলাকার ছোট ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ায় হাতেখড়ি দিতেন। এছাড়া আশপাশের নারীদের পরিবার পরিকল্পনার ওষুধ দিয়ে সহায়তা করতেন। রুনু কস্তা শৈশবে বেড়ে উঠেছেন গাজীপুরের পদহারবাইদ গ্রামে। শৈশবে ছিলেন দুরন্ত-ডানপিটে। বাবা-মায়ের কাছেই পেয়েছিলেন মানবসেবার দীক্ষা। তাদের প্রেরণায় ভর্তি হয়েছিলেন সেবাধর্মী শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান কুমুদিনী নার্সিং কলেজে। সেখান থেকে নার্সিংয়ে ডিপ্লোমা করে মানবসেবায় এগিয়ে এসেছেন।

রুনু দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করে বড় হয়েছেন। তিনি বুঝতে শিখেছিলেন মানুষের দুঃখ-বেদনা। তার মা একপর্যায়ে পাড়ি জমান বিদেশে। সে সময় মোবাইল ফোনের প্রচলন ছিল না। তার মা কথা রেকর্ড করে ক্যাসেট পাঠিয়ে দিতেন। প্রতিবারই সেখানে তাকে উদ্দেশ্য করে একটা কথা থাকত ‘মা, তুমি বিয়ে করো না। লেখাপড়া করো।’

এদিকে ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে ফুপু-চাচারা তাকে বিয়ে দিয়ে দিতে চাইতো। কিন্তু সংসারের অভাব-অনটনকে তুচ্ছ করে এগিয়ে যাওয়ার সংকল্প করেন তিনি। এছাড়া তার মায়ের অনুপ্রেরণায় তিনি লেখাপড়া করতে থাকেন। ১৯৯৮ সালে সেন্ট যোসেফ উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করেন। পরে কুমুদিনীতে নার্সিংয়ে ভর্তি হন। ২০০২ সালে কুমুদিনী নার্সিং ইনস্টিটিউট থেকে নার্সিং পাস করে ভর্তি হন কলেজ অব নার্সিংয়ে। সেখান থেকে বিএসসি পাস করেন ২০১৮ সালে। এমএসসি করে উচ্চতর ডিগ্রি নেওয়ারও ইচ্ছা আছে তার। নার্সিং পাস করার পর প্রথম ২ বছর কুমুদিনী নার্সিং ইনস্টিটিউটে কাজ করেন ২০০৫ সালে ইউনাইটেড হাসপাতালে যোগ দেন। এরপর ২০১৩ সালে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে যোগ দেন। তিনি বলেন, যতই দিন যাচ্ছে ততই পেশার প্রতি ভালো লাগছে।

রুনু বলেন, ‘করোনার শুরুতে প্রথম যেদিন আমি হাসপাতালে যোগদান করলাম সেদিন সহকর্মীদের মুখের দিকে তাকিয়েও মাস্ক-পিপিই পরার কারণে চিনতে পারিনি। হাসপাতাল সুনসান, আগের তুলনায় ফাঁকা, নিজের মধ্যেও আতঙ্ক কাজ করছিল। সেসময় সময় অধিকাংশ রোগীর স্বজনরা হাসপাতালে রোগী রেখে চলে যেত। তারা ফোন করেও খোঁজ নিত না। অনেক রোগী মারা যাওয়ার পর কল করেও তাদের স্বজনদের সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি। তারা ফোন বন্ধ রাখত অথবা কথা বললেও সৎকার করতে আসত না। সেসব রোগীর সৎকার করেছে সরকার। তখন বার বার মনে হতো, যে বাঙালি এত স্বজনপ্রিয়! সেই বাঙালি এই করোনাকালে আপনজনের খোঁজ রাখছে না। অন্য দেশের মানুষের তাহলে কি অবস্থা!’

রুনু আরো বলেন, ‘এক দিন ষাটোর্ধ্ব এক করোনা রোগীর ডায়ালাইসিস করাচ্ছিলাম। ওই সময় রোগী ঘেমে যাচ্ছিল। এসি চালু থাকলে রোগীর সমস্যা হতে পারে বলে রোগীকে পুরোনো কাগজ দিয়ে বাতাস দিচ্ছিলাম আমি। ভদ্রলোক বার বার বলেছিলেন, ‘মা তুমি দূরে যাও। কাছে থেকে বাতাস দিলে তুমিও আক্রান্ত হবে।’ কিন্তু রোগীর গরমে কষ্ট দেখে আমি দূরে না গিয়ে বাতাস দিতে থাকি। তখন তিনি সৃষ্টিকর্তার কাছে আমার জন্য প্রার্থনা করেন। আবার এমনও রোগী পেয়েছি যারা অভিযোগ করেছে নার্সরা দূর থেকে ওষুধ দিচ্ছে। কিন্তু তারা আমাদের সেফটির বিষয়টি চিন্তাও করত না।’

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
রুনু কস্তা,সেবিকা,সাহসিকা,কুমুদিনী নার্সিং ইনস্টিটিউট
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close