মনসুর হেলাল

  ১১ অক্টোবর, ২০২০

রসে টস টস রসমালাই

ছবি : সংগৃহিত

রসমালাইয়ের নাম শুনলেই জিহ্বায় পানি চলে আসে। আর সেটি যদি হয় কুমিল্লার মাতৃ ভান্ডারের রসে টস টস রসমালাই, তাহলো তো কথাই নেই। তবে এই রসমালাই তৈরি নিয়ে আছে নানা কাহিনি। যা হয় তো অনেকে জানেন, তার পরও যারা জানেন না, তাদের বলছি, ১৯৩০ সালে ব্রাক্ষণবাড়িয়ার খড়িয়ালার খনিন্দ্র সেন ও মনিন্দ্র সেন নামের দুই ভাই কুমিল্লা শহরে এসে বসবাস শুরু করেন। তারা ছিলেন ঘোষ সম্প্রদায়ের। ফলে আগে থেকেই মিষ্টান্ন তৈরির নানা কৌশল ছিল তাদের রপ্ত। তারা ভাবলেন, এমন কিছু তৈরি করতে হবে যা প্রকৃত অর্থেই হবে গুনে মানে অনন্য ও স্বাদে ভরপুর। যেই ভাবনা সেই কাজ। প্রথম দিকে তারা দুধ জ্বাল দিয়ে ঘন করে ক্ষীর তৈরি করে তাতে ছোট আকারের শুকনো ‘ভোগ’ বা রসগোল্লা ভিজিয়ে এক ধরনের মিষ্টান্ন তৈরি করেন, তার নাম দেন ‘ক্ষীরভোগ’। ধীরে ধীরে এই ক্ষীরভোগই রসমালাই নামে পরিচিত হয়ে উঠে। দিনে দিনে এর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে দেশে-বিদেশে। শুধু তাই নয়, রসমালাই একদিকে যেমন কুমিল্লার ইতিহাস ও ঐহিত্যকে সমৃৃদ্ধ করেছে, তেমনি সুস্বাদু মিষ্টি হিসেবে বিদেশিদের কাছেও বাংলাদেশের সুনাম বৃদ্ধি করেছে।

কুমিল্লা শহরের মনোহরপুরের রাজরাজেশ্বরী কালীমন্দিরকে ঘিরে প্রতিষ্ঠিত মাতৃ ভান্ডারেই সর্বপ্রথম রসমালাই বিক্রি শুরু হয়। ১৯৪০ সালে খনিন্দ্র সেন মারা গেলে তার একমাত্র ছেলে শংকর সেন মাতৃ ভান্ডার পরিচালনা করা শুরু করেন। মনে রাখতে হবে, আসল রসমালাইয়ের স্বাদ পেতে চাইলে আপনাকে এই ঐতিহ্যবাহী দোকানেই যেতে হবে। যেখান থেকে অমৃত স্বাদের রসমালাই যাত্রা শুরু করেছিল। কারণ, কুমিল্লা শহরকে ঘিরে বর্তমানে অসংখ্য নকল রসমালাইয়ের দোকান গড়ে ওঠেছে। তাই, সত্যিকারের তৃপ্তির ঢেঁকুর তখনই তুলতে পারবেন যদি সঠিক জায়গা থেকে সঠিক জিনিসটা কিনতে পারেন।

২০০৭ সালের ১১ নভেম্বর বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের রাষ্ট্রদূত গীতা পার্সি বাংলাদেশ সফরে আসলে তার দুই সহযোগি কুমিল্লার মাতৃ ভান্ডারে এসে রসমালাই খেয়ে যাওয়ার সময় গীতা পার্সির ইচ্ছাতেই তার জন্য ২ কেজি রসমালাই ও দেড় কেজি ক্ষীর কিনে নিয়ে যান। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশে ঘুরতে আসা বিদেশি পর্যটকরাও বেড়াতে এসে কুমিল্লার রসমালাই কিনে নিয়ে যান। পাক-ভারত তথা উপমহাদেশে কুমিল্লার রসমালাইয়ের সুখ্যাতি সর্বজনবিদিত। দেশে পারিবারিক, সামাজিক, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের যে কোনো অনুষ্ঠানেই মেন্যুর শেষ পর্বে থাকে কুমিল্লার রসমালাই। এমন কি ঢাকায় অনুষ্ঠিত সার্ক শীর্ষ সম্মেলনেও অতিথি আপ্যায়নে বিশেষ মেন্যু হিসাবে ছিল মাতৃ ভান্ডারের রসমালাই। প্রতিদিন ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত মাতৃ ভান্ডারের সামনে ক্রেতাদের ভিড় লেগেই থাকে। কেউ বাড়ির জন্য, কেউবা মেহমানদের আপ্যায়নের জন্য কেউবা অফিসের বসদের উপহার দেওয়ার জন্য নিয়ে যান এই রসমালাই। মজুর থেকে শুরু করে সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ ভিড় জমায় রসমলাই কেনার জন্য। ক্রেতাদের মধ্যে এক প্রকার প্রতিযোগিতা দেখা যায় গরম গরম রসমালাই কার আগে কে কিনবে। তখন ক্রেতাদের ভিড় সামাল দিতে হিমশিম খেতে হয় দোকানের কর্মচারীদের।

যে ভাবে তৈরি হয় :

কুমিল্লার মাতৃ ভান্ডারের ঐতিহ্যবাহী রসমালাই তৈরির প্রক্রিয়া খুবই সহজ। একটি পাতিলে বা করাইয়ে একমণ দুধ দুই ঘণ্টা ধরে জ্বাল দিলে তা ঘন হয়ে ১৩/১৪ কেজি ক্ষীর তৈরি হয়। এর দুধ থেকে পাওয়া ছানার সঙ্গে কিছু ময়দা দিয়ে খামির তৈরি করে বানানো হয় ছোট ছোট গুলি বা রসগোল্লা। এক কেজি ছানাতে এক ছটাক পরিমাণ ময়দা দিয়ে এই গুলি বানানো যায়। কুমিল্লার ঐতিহ্যবাহী মাতৃ ভান্ডারের কারিগর উত্তম দে জানান, এক মণ দুধ জ্বাল দিয়ে ঘন ক্ষীর তৈরি করে তাতে ছোট গুটি বা শুকনো রসগোল্লা দিয়ে ১৪ কেজির মতো রসমালাই বানানো যায়। এক মণ দুধে এর বেশি তৈরি করলে রসমালাইয়ের আসল স্বাদ আর থাকে না।

তিনি জানান, দুধ বলতে যা বোঝায় তা এখন সেভাবে পাওয়া যায় না। সে কারণে পরিমাণ কম বেশি হয়। দুধ আসল হলে ক্ষীরও ঘন হয় এবং স্বাধও অটুট থাকে।

সতর্কতা:

রসমালাইয়ের ঐতিহ্য আর সুখ্যাতিকে পুঁজি করে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী নেমে পড়েছে রসমালাই বিক্রিতে। ঐতিহ্যবাহী রসমালাইয়ের উদ্ভাবক মাতৃভান্ডারের নামের সামনে নানা ধরনের চটকদার শব্দ ব্যবহার করে তারা মূলত ক্রেতাদের ঠকাচ্ছে। তাদের ব্যাপারে অবশ্যই সতর্ক থাকতে হবে। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পাশে কুমিল্লার পদুয়ার বাজার থেকে শুরু করে আলেখারচর, ময়নামতির টিপরা বাজার, চান্দিনা, মাধাইয়াসহ আরও অনেক স্থানে এসব নকল রসমালাই চোখে পড়বে। তাদের সবারই দাবি তাদের দোকানে কুমিল্লার আসল রসমালাই পাওয়া যায়। দোকানগুলোর সাইনবোর্ডে কোনোটিতে লেখা আছে ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার অনুমোদিত’, কোনোটিতে লেখা ‘আমাদের একমাত্র শাখা এটি’, কোনোটিতে আছে ‘আমাদের দ্বিতীয় শাখা’। সত্যি কথাটা হলো, এসব অসাধু ব্যবসায়ীরা মাতৃ ভান্ডারের নাম ব্যবহার করে ভেজাল রসমালাই তৈরি করে সাধারণ মানুষকে প্রতারিত করছে। সেই সঙ্গে তারা নষ্ট করছে কুমিল্লার আসল ও অতুলনীয় স্বাদের রসমালাইয়ের সুনাম। মনে রাখবেন, কুমিল্লা শহরের মনোহরপুরে অবস্থিত মাতৃ ভান্ডারেই পাবেন উৎকৃষ্ট ও সুস্বাদু রসমলাই।

কুমিল্লার আরও কয়েকটি প্রসিদ্ধ রসমালাইয়ের দোকান :

মাতৃ ভান্ডার ছাড়াও কুমিল্লার শহরের আরও কয়েকটি মিষ্টান্নের দোকানে রসমালাই পাওয়া যায়, এগুলোর মধ্যে ভগবতী পেড়া ভান্ডার, শীতল ভান্ডার, জলযোগ, পোড়াবাড়ি, জেনিস, অমৃত মিষ্টি ভান্ডার, কুমিল্লা মিষ্টি ভান্ডার, মিষ্টিমেলা উল্লেখযোগ্য। তারা নকল দোকানগুলোর মতো মাতৃভান্ডারের নাম ভাঙিয়ে রসমালাই বিক্রি করে না, কিংবা প্রতারণার ফাঁদ পেতে ক্রেতাদের ঠকাচ্ছেন না। বরং নিজেদের সুনাম অক্ষুণ্ন রেখেই রসমালাই বিক্রি করছেন।

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
রস,টস টস,রসমালাই
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close