জান্নাতুন নিসা

  ০৬ অক্টোবর, ২০২০

মুজিববর্ষে সরকারের বই ক্রয়ে বঙ্গবন্ধুকন্যার হস্তক্ষেপ দাবি

ভাঙাচোরা অহংকারের লিকলিকে যাত্রায় মহামারির ভয়াবহতা মানবের অলক্ষ্যে নিঃশেষিত হয়েছে প্রতিনিয়ত। তাইতো দিকভ্রান্ত হয়ে থেমে যায়নি মানুষ বরং দুঃসাহসের মায়াবী আরশিঘেরা বেদনার বুক চিরে মরমি জ্যোৎস্নায় নেয়ে উঠেছে বারংবার। রচনা করেছে সাহিত্য, প্রকাশ করেছে বই কিংবা পুস্তক। আর যুগান্তরের পিঠে বেঁধে দিয়েছে কালের দর্পণ। যে দর্পণে মানুষ খুঁজে নিয়েছে আপন অস্তিত্ব। সে অস্তিত্বের অংশীদারত্বে রাষ্ট্র এগিয়ে থেকেছে সর্বসাকুল্যে। দেশ কিংবা বিশ্বব্যাপী বইয়ের প্রচারণায় এবং সর্বস্তরে পাঠোন্নতির জন্য ব্যক্তি কিংবা সরকারের উদ্যোগে গড়ে উঠেছে পাঠাগার। সে পাঠাগারে সরকারের পক্ষ থেকে বই কিংবা পুস্তক ক্রয় খুবই আশাব্যঞ্জক বিষয়। অন্তত একবিংশ শতাব্দীতে এসে মহামারি করোনার ভয়াবহতায় তো বটেই!

বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ, বাংলাদেশ একই সুতোয় গাথা। আর এই সেতুবন্ধনের বহিঃপ্রকাশ বই। যার কারিগর লেখক-প্রকাশক সর্বোপরি প্রকাশনা শিল্প। যে শিল্পের বৃন্তচ্যুত অভীপ্সা করোনার ভয়াবহতায় অনন্ত শূন্যের দাপুটে মহিমায় বর্ণহীন হয়ে পড়েছে। যদিও মুজিববর্ষ ঘিরে বাংলাদেশের প্রকাশকদের মধ্যে আনন্দ আমেজের বৃহস্পতি শুরু হয় অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০২০ থেকেই। কারণ বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০২০ উৎসর্গ করা হয় সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। আর একুশের পরেই অর্থাৎ ১৭ মার্চ থেকেই শুরু হওয়ার কথা ছিল স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিটি বাঙালির স্বপ্নের উৎসব মুজিববর্ষের যত আয়োজন। সে হিসেবে মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু বিষয়ক বই প্রকাশের বিশাল কর্মযজ্ঞটি প্রকাশকদের অনেকেই শুরু করেন ২০১৯ সালে আয়োজিত একুশে গ্রন্থমেলার পর থেকেই। কারণ মেলা কিংবা নিজস্ব বাজার ব্যবস্থাপনায় বই বিক্রয়ের বাইরেও সবার আশা ছিল অন্তত সরকারি কোনো প্রকল্পে হয়তো সবার বই ক্রয় করা হবে। কারণ মুজিববর্ষ উদ্যাপনের লক্ষ্যে সারা দেশে বিভিন্ন প্রকাশনা, বঙ্গবন্ধু কর্নার স্থাপন থেকে শুরু করে সব মিলিয়ে বিশাল অঙ্কের বাজেটও ঘোষিত হয় সরকারের পক্ষ থেকে।

স্বাধীন বাংলাদেশের বুকে বাঙালি জাতির কালের আয়নায় অস্তিত্বের ঐন্দ্রজালিক উপস্থিতির নাম মুজিববর্ষ। অর্থাৎ সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনের মাহেন্দ্রক্ষণ। যার ক্ষণগণনা শুরু হয় ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের দিন, ১০ জানুয়ারি ২০২০ থেকে। আর প্রকাশকদের ব্যস্ততাও চরমে পৌঁছে তখন। কিন্তু বিশ্বব্যাপী করোনার ভয়াবহতার কথা ভেবে বঙ্গবন্ধুকন্যা গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা মুজিববর্ষ উদযাপনকে সীমিত করার নির্দেশ দেন। সর্বোপরি মার্চের শেষ সপ্তাহ থেকে শুরু হয় লকডাউন। তবে করোনার প্রকোপে যাবতীয় সব অনুষ্ঠান কিংবা আয়োজন সীমিত পরিসরে হলেও সরকারের বই কেনার বিভিন্ন প্রকল্প থাকে সচল। তাতে করে মুজিববর্ষে জাতির পিতার নাম ব্যবহার করে শুরু হয় ব্যক্তিস্বার্থ হাসিল করার অনিয়মের প্রলেপ; যা সাহসী করে তোলে মুজিববর্ষে বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক বই নিয়ে নজিরবিহীন অনিয়ম ও দুর্নীতিকে। আর এ অনিয়ম ও দুর্নীতির সূচনা হয় প্রাথমিক এবং গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন দেশের সব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বঙ্গবন্ধু কর্নারের জন্য বই কেনা দিয়ে। এ ক্ষেত্রে দেশের ৬৫৭০০টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ‘বঙ্গবন্ধু কর্নারের’ জন্য প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের বই কেনা প্রকল্পে হরিলুট শুরু হয়।

কোনো দরপত্র ছাড়া বঙ্গবন্ধু কর্নারের জন্য ১৫০ কোটি টাকার বই ক্রয়ের বিষয়টি লেখক ও প্রকাশকদের প্রতিবাদ এবং আলোচনা-সমালোচনার পর গণমাধ্যমে সাড়া ফেলে। কেবল তাই-ই নয়, বিষয়টি নিয়ে হাসান আজিজুল হক, নির্মলেন্দু গুণ, মুনতাসীর মামুন, রামেন্দু মজুমদার, সেলিনা হোসেন, আবুল মোমেন, মুহম্মদ জাফর ইকবাল, সুব্রত বড়ুয়া, মোরশেদ শফিউল হাসান, অসীম সাহা, আবুল আহসান চৌধুরী, ফরিদুর রেজা সাগর, ইমদাদুল হক মিলন, আমীরুল ইসলাম এবং আনিসুল হকের মতো ১৫ জন প্রথিতযশা কবি-সাহিত্যিক-সংস্কৃতজন বিবৃতি দেন। যেখানে তারা মুজিববর্ষ উপলক্ষে বাংলাদেশে এই প্রথমবারের মতো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আন্তরিকতায় প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের মাধ্যমে ১৫০ কোটি টাকার বই ক্রয়ের এ উদ্যোগকে অভিনন্দন জানান। সেসঙ্গে তারা প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বই ক্রয়ের এ ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা কামনা করেন।

তারা বলেন, ‘করোনাকালে সৃজনশীল প্রকাশকদের এই দুরবস্থার মধ্যে বই ক্রয়ের এ সংবাদ লেখক, প্রকাশক সবার জন্য আশীর্বাদস্বরূপ। বই ক্রয়ের পদ্ধতি নির্ধারণের এখতিয়ার মন্ত্রণালয়ের, কিন্তু স্বচ্ছতা থাকা বাঞ্ছনীয়।’ বিবৃতিতে তারা আরো বলেন, ‘আমরা মনে করি, অন্যান্য মন্ত্রণালয়, বিশেষ করে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় গণগ্রন্থাগার অধিদফতর ও জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের জন্য প্রতি বছর যে পদ্ধতিতে বই ক্রয় করে, সেই পদ্ধতি অনুসরণ করা হোক। অর্থাৎ সৃজনশীল প্রকাশকদের নিকট উপযুক্ত বইয়ের তালিকা ও নমুনা কপি জমা নেওয়া হোক এবং দেশের বিশিষ্ট লেখক, বুদ্ধিজীবী, প্রকাশক সমিতির প্রতিনিধি এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা সমন্বয়ে বই নির্বাচন কমিটি গঠন করে নির্বাচন সম্পন্ন করে বই ক্রয় করা আবশ্যক। দেশের সচেতন নাগরিক হিসেবে করোনাকালীন দুঃসময়ে কোনো ধরনের অনিয়ম ও অস্বচ্ছতা আমাদের কাম্য নয়।’

এ ছাড়া বাংলাদেশ জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক সমিতি থেকে এই বই ক্রয় প্রক্রিয়া স্থগিত করে সব প্রকাশককে বইয়ের তালিকা জমা দেওয়ার সুযোগ দিয়ে স্বচ্ছতার ভিত্তিতে বই নির্বাচন করে দ্রুত বই ক্রয় করার জন্য পত্র দেওয়া হয়। কেবল তাই নয়! প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবর প্রেরিত চিঠির কপি প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য পিএস বরাবর মেইল করা হয়। এসব কিছুর পরিপ্রেক্ষিতে তখন বরাবরের ন্যায় পদাসীন ব্যক্তিদের অক্ষমতাকে ঢাকতে গিয়ে বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুস্পষ্ট নির্দেশনায় বঙ্গবন্ধু কর্নারের জন্য বিতর্কিত প্রাথমিক ৩৯টি বইয়ের তালিকা সংশোধিত হয়। কিন্তু জননেত্রীর আশপাশের আমলাতান্ত্রিক মারপ্যাঁচে বহু বিতর্কিত ১৫০ কোটি টাকার বইয়ের মধ্যে প্রায় ৩০ কোটি টাকার আটটি বই কেনে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতর। যেখানে একই ব্যক্তি সংশ্লিষ্ট একাধিক প্রকাশনা মাত্র আটটি বইয়ের এই সংক্ষিপ্ত তালিকায় জায়গা পায় এবং এই ক্রয়তালিকার সম্পূর্ণ মূল্যের দুই-তৃতীয়াংশেরও বেশি একজনকেই বরাদ্দ করা হয়।

বিভিন্ন গণমাধ্যম সূত্রে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, বড় কয়েকটি প্রতিষ্ঠান তাদের বিলও আদায় করে নেয় সন্তর্পণে। আর বিতর্কিত এই তালিকায় মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ জেল থেকে প্রকাশিত বঙ্গবন্ধু বিষয়ক দুটি বইয়ের (‘বঙ্গবন্ধু মানেই স্বাধীনতা’ এবং বঙ্গবন্ধুর জেলজীবন নিয়ে বই ‘৩০৫৩ দিন’) গ্রন্থস্বত্ব চুরির মাধ্যমে ১৭ কোটি ৫৭ লাখ ৫৬ হাজার ৫০০ টাকা হাতিয়ে নেয় একটি প্রকাশনা সংস্থা। এ ছাড়া একেবারেই নতুন একটি প্রকাশনা হাতিয়ে নেয় আরো ৩ কোটি ১৩ লাখ ৩৮ হাজার ৯০০ টাকা। আর অবাক হলেও সত্যি প্রায় ২৮ কোটি ৭৮ লাখ ১২ হাজার ২০০ টাকার মধ্যে প্রায় ২০ কোটি ৭০ লাখ ৮৬ হাজার ৪০০ টাকাই নিয়ে নেয় এই দুটি প্রকাশনা সংস্থা। প্রকল্পের শুরুতে বিতর্কিত তালিকা ও অনিয়ম নিয়ে লেখক-প্রকাশকদের আন্দোলন এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপের পরও বন্ধ হয়নি অপতৎপরতা। তবে কি সত্যিই অধিদফতরের কিছু অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজশে মুজিববর্ষে বঙ্গবন্ধুর নামে চলছে নজিরবিহীন অনিয়ম ও দুর্নীতির মহড়া!

মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্নের অপচেষ্টায় রত স্বার্থান্বেষী কুচক্রী মহলের দৌরাত্ম্যে সরকারের বই কেনা পদ্ধতিতে দুর্নীতির শেষ নেই। তবে বিষয়টি নিয়ে আমাদের বোদ্ধামহল মুখ খুলতে নারাজ। আর লেখক-প্রকাশকদের মধ্যে দু-একজন যাও এ বিষয়ে কথা বলেছেন, কিন্তু বেশির ভাগ সবার নীরব ভূমিকা পালনের কারণ বঙ্গবন্ধু বিষয়ক বই ক্রয়-বিক্রয়ের বিপক্ষে যাওয়া মানে সরকারের বিরোধিতা করা। আর আমার মতো অনেক লেখক-প্রকাশকের ভয়, এই ক্রয়-বিক্রয়ের বিরোধিতা করলে পরবর্তী সময়ে আমার কিংবা আমাদের প্রকাশনীর বই নেওয়ার ব্যাপারে হয়তো নিষেধাজ্ঞা বা কালো তালিকাভুক্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকবে। তবে সব কিছু ছাপিয়ে আমি বোধের কুঠারাঘাতে নিজেকে আটকে রাখতে না পেরে কালের আয়নায় নিজেকে দাঁড় করিয়ে বঙ্গবন্ধুকন্যার কাছে নিবেদন করছি, অন্যসব বিষয়ের মতো মুজিববর্ষে সরকারের বই ক্রয় প্রকল্পে আপনার সরাসরি হস্তক্ষেপ এখন সময়ের দাবি। তা না হলে বিষয়টি ঘটবে ‘মামুরা রাঁধবে আর মামুরাই খাবে!’ অথচ আমরা চাই সবাইকে নিয়ে পথচলার সংস্কৃতি গড়তে। আর বাঙালি তো বরাবরই স্নিগ্ধ ধ্বংসের অসমাপ্ত হাত ধরে ছুটে চলা স্বাপ্নিক জাতি। তাই আবারও নিবেদন, বঙ্গবন্ধুকন্যা আপনার সুদৃঢ় হস্তক্ষেপই এখন পারে বাংলাদেশের প্রকাশনা শিল্পের সূর্যকে বিস্তৃতির মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশের আকাশে উদিত করতে। তা না হলে গুটিকয়েক বিত্তবান প্রকাশকের হাতেই সীমাবদ্ধ হয়ে নতুন কিংবা কম সামর্থ্যবান প্রকাশকদের সূর্য অস্তমিত হবে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের ডিজিটাল বাংলাদেশে।

লেখক : কথাসাহিত্যিক, সাংবাদিক

সভাপতি, বাংলাদেশ নারী প্রকাশক সমিতি (বানাপ্রস)

[email protected]

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
হস্তক্ষেপ,বই ক্রয়,মুজিববর্ষ,বঙ্গবন্ধু
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close