নিগার সুলতানা সুপ্তি

  ০৫ অক্টোবর, ২০২০

দীর্ঘস্থায়ী বন্যা মোকাবিলায় আমরা কতটা প্রস্তুত

গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনার বৃহত্তম বদ্বীপ অঞ্চলে বাংলাদেশের অবস্থান। এই ভৌগোলিক অবস্থানের কারণেই বাংলাদেশ কমবেশি প্রতি বছর বন্যায় প্লাবিত হয়। কখনো এ বন্যা সহনশীল থাকে, আবার অনেক সময়ই ভয়াল আকার ধারণ করে। এবারের বন্যা পরিস্থিতির ক্রমাবনতি উদ্বেগ বাড়াচ্ছে। কেননা, এবার দেশ যখন করোনা মহামারির কশাঘাতে বিপর্যস্ত, তখনই মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে বৃহৎ অঞ্চলে বন্যার প্রকোপ দেখা দেখা যায়।

করোনাভাইরাস প্রকোপের মধ্যেই দেশে বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে যে নতুন শঙ্কা তৈরি হয়েছে, এজন্য আমাদের প্রস্তুতি কতটুকু? এ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেছেন, এবারের বন্যা দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে। কারণ এ বছর বন্যার প্রকোপটা বেশি দেখা দিচ্ছে। বন্যার স্থায়িত্ব আগস্ট-সেপ্টেম্বর পর্যন্তও যেতে পারে। ইতোমধ্যে দেশের উত্তরাঞ্চলে দেখা দিয়েছে চতুর্থ দফায় বন্যা।

বন্যাকবলিত মানুষের পাশে দাঁড়ানো জরুরি; যা আমলে নিয়ে উদ্যোগ নিতে হবে। প্রসঙ্গত, গত ২৭ জুন থেকে ৭ জুলাই পর্যন্ত ছিল বন্যার প্রথম দফা। এরপর ধীরে ধীরে পানি কিছুটা কমতে থাকে। তবে ১১-১৫ জুলাই পর্যন্ত আরেক দফা ঢলের কারণে বন্যার পানি বেড়ে যায়। এরপর চার দিন ধরে পানি কমছিল। কিন্তু এখন যখন বন্যা দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে—এমন পূর্বাভাস আসছে; তখন আমরা বলতে চাই, সামগ্রিক অবস্থা মোকাবিলায় সব ধরনের পদক্ষেপ জারি রাখতে হবে। জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে বন্যার খবর জোরেশোরে প্রকাশ হচ্ছে। খবরের কাগজে বন্যায় আক্রান্ত মানুষের দুঃখকষ্টের কথা তুলে ধরা হচ্ছে এবং ত্রাণ কার্যক্রম ততটা পর্যাপ্ত নয় ইত্যাদি লেখা হচ্ছে। ত্রাণ যতই দেওয়া হোক ঘরে ঘরে ত্রাণ পৌঁছবে এবং মানুষের চাহিদা শতভাগ পূরণ হবে; তা ভাবা হয়তো ভুল হবে। বন্যা বাংলাদেশের জন্য একটি বার্ষিক ঘটনা। প্রতি বছরই আমরা বন্যার কবলে পড়ি। কোনো বছর বেশি মাত্রায়, কোনো বছর কিছুটা কম। কোনো বছর কিছুটা আগে, কোনো বছর কিছুটা দেরিতে আসে। এটা নিয়ে আমাদের পূর্বপ্রস্তুতি বাঞ্ছনীয়।

১৯৮৮ সালের বন্যা বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে মারাত্মক প্রাকৃতিক দুর্যোগগুলোর মধ্যে অন্যতম। সেসময় আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাসে হওয়া বন্যায় দেশের প্রায় ৬০ শতাংশ এলাকা প্লাবিত হয়েছিল। স্থায়িত্ব ছিল ১৫ থেকে ২০ দিন। তখন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও গুরুত্বের সঙ্গে বিষয়টি প্রচার পায়। কিন্তু এবারের প্রেক্ষাপট আমাদের অনুকূলে নয়। করোনাভাইরাসের আগ্রাসন ঠেকাতেই পৃথিবী আজ ব্যস্ত। বিশ্ব অর্থনীতির অবস্থাও নাজুক। সবাই যেন নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত। এরমধ্যে থেকেই আমাদের লড়াই। তাই একটু বাড়তি চিন্তা ও পরিকল্পনার প্রয়োজন। তবে সবার আগে আমাদের বোধকে জাগ্রত করা দরকার। বিগত ৪৯ বছরে আমরা দেশের কাছ থেকে অনেক নিয়েছি। কিন্তু দিয়েছি কতটা! দেশ আমাদের দিয়েছে অনেক। কিন্তু আমরা তার প্রতিদানে কতটুকু দিয়েছি? হিসাব করলে যা দাঁড়াবে, ‘কিছুই পারিনি দিতে’। তাই এটাই সুযোগ, সমর্থবানরা এগিয়ে এলে দুর্যোগ মোকাবিলা অনেকটা সহজ হবে। দেশ উপকৃত হবে। আমরাও মানবিকতার বিচারে উত্তীর্ণ হব।

সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, বন্যা মোকাবিলায় সরকার যথেষ্ট প্রস্তুত। বন্যা মোকাবিলার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাসে আমরা আশ্বস্ত হতে পারি। তবে আমাদের মতো দরিদ্র দেশের একের পর এক সংকট মোকাবিলা করা একটু দুরূহই বটে। বাংলাদেশে এখনো ২২ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। সংখ্যার হিসাবে প্রায় চার কোটি। মৌলিক চাহিদার অনেক কিছুই তাদের অপূর্ণ থেকে যায়। হাড়ভাঙা পরিশ্রমের বিনিময়ে কোনো রকমে খেয়ে-পরে বেঁচে থাকে। করোনা সংকট তাদের রোজগারের পথ বন্ধ করে দিয়েছে। সরকার যে পরিমাণ ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করছে, তাতে চাহিদার ২৫ শতাংশও মিটবে না। ৭৫ শতাংশ বঞ্চিত থেকে যাবে। এ অবস্থায় কী করবে সরকার? অবিলম্বে সরকারের ত্রাণ পরিকল্পনায় আমূল পরিবর্তন আনতে হবে। যত দিন করোনা সংকট থাকবে, তত দিন কাজ হারানো সব অভাবী মানুষের কাছে চালসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য পৌঁছাতে হবে। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ সরকার যদি প্রত্যেক মানুষকে ছয় মাস বিনা পয়সায় চাল দিতে পারে, আমরা কেন পারব না?

আমরা মনে করি, যখন এমন আশঙ্কার বিষয় সামনে আসছে; তখন সার্বিক পরিস্থিতি আমলে নিয়ে সংশ্লিষ্টদের দরকার যথাযথ উদ্যোগ অব্যাহত রাখা। কেননা, বন্যা পরিস্থিতির অবনতি এবং তা দীর্ঘস্থায়ী হলে এতে পানিবন্দি মানুষের দুর্ভোগ বাড়বে। বন্যাদুর্গত এলাকায় স্কুল, হাটবাজার, রাস্তাঘাট, ঘরবাড়িসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা তলিয়ে যায়। এ ছাড়া সেতু ও সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় অনেকে এলাকা থেকে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকে। কোথাও কোথাও দেখা দেয় তীব্র ভাঙন। এ সময় আরেকটি বিষয় উঠে আসে, যা অত্যন্ত উদ্বেগের। অধিকাংশ জায়গায় দেখা দেয় বিশুদ্ধ পানির অভাব। বিশুদ্ধ পানির সংকট সৃষ্টি হলে পানিবাহিত রোগ বাড়বে এমন আশঙ্কা অমূলক নয়। এ ছাড়া দেখা যায় গো-খাদ্যের তীব্র সংকট। ফলে এই বিষয়টি সামনে রেখেও কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। একদিকে করোনা পরিস্থিতিতে কঠিন সময় অতিক্রম করতে হচ্ছে, আবার এরমধ্যে দীর্ঘস্থায়ী বন্যার বিষয়টি অত্যন্ত আশঙ্কাজনক বাস্তবতাকে স্পষ্ট করে।

প্রাকৃতিক দুর্যোগের ব্যাপারে আমরা অনেকটা অসহায়। যেমন ভূমিকম্প বা জলোচ্ছ্বাস ঠেকানোর ক্ষমতা আমাদের নেই। কিন্তু যথাযথ পূর্বপ্রস্তুতি, উদ্ধার তৎপরতা ও দুর্যোগ-পরবর্তী কার্যক্রমের মাধ্যমে ক্ষয়ক্ষতি সহনীয় পর্যায়ে আনা যায়। প্রাকৃতিক দুর্যোগের সম্ভাবনা কমানো ও ক্ষয়ক্ষতি সহনীয় পর্যায়ে আনার জন্য অগভীর নদী ড্রেজিং করতে হবে, ঝুঁকিপূর্ণ নদীর তীরে বাঁধ নির্মাণ করতে হবে, সম্ভাব্য দুর্যোগের ব্যাপারে ব্যাপক প্রচার চালাতে হবে, যথাযথভাবে দুর্যোগ মোকাবিলার পরিকল্পনা করতে হবে, রাস্তাঘাট মজবুত করে বানাতে হবে, জনগণকে দুর্যোগ মোকাবিলায় সচেতন করে তুলতে হবে, দুর্যোগ পরবর্তী ত্রাণ দ্রুত ভুক্তভোগীদের কাছে পৌঁছাতে হবে, প্রয়োজনীয় আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করতে হবে, পর্যাপ্ত খাবার মজুদ রাখতে হবে। ওপরের ব্যবস্থাগুলো গ্রহণ করা হলে দুর্যোগে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ অনেক কমবে বলে আশা করা যায়। এসবের জন্য অবশ্যই জাতীয় দুর্যোগ মোকাবিলার পরিকল্পনা থাকতে হবে। সেই সঙ্গে লাগবে আগাম প্রস্তুতি।

সর্বোপরি বলতে চাই, বাংলাদেশ প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ দেশ। প্রতি বছরই বন্যাসহ নানা ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করতে হয়। বলার অপেক্ষা রাখে না, প্রাকৃতিক দুর্যোগকে রোধ করার কোনো উপায় নেই, কিন্তু প্রস্তুতি ও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিশ্চিত হলে ক্ষয়ক্ষতি অনেকটাই কমানো সম্ভব। সংগত কারণেই বন্যাকবলিত মানুষের দুর্ভোগ ও সার্বিক চিত্র আমলে নিয়ে এ ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ ও তার সুষ্ঠু বাস্তবায়ন নিশ্চিত হোক এমনটি কাম্য।

লেখক : শিক্ষার্থী, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

[email protected]

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
বন্যা মোকাবিলা,প্রাকৃতিক দুর্যোগ,উদ্বেগ
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close