মোতাহার হোসেন

  ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২০

বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা বিনির্মাণের রূপকার শেখ হাসিনা

যুগে যুগে সাধারণ মানুষের মাঝে ব্যতিক্রমী কিছু মানুষের বিরল উপস্থিতি এ পৃথিবীকে মহিমান্বিত করেছে। এ রকম একজন আলোক প্রদীপ ব্যক্তি হলেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, যার জন্ম না হলে হয়তো এখনো পর্যন্ত আমরা পরাধীন থাকতাম।

বঙ্গবন্ধু একটি আবেগের নাম। বঙ্গবন্ধু একটি চেতনা, সর্বোপরি বঙ্গবন্ধু একটি আদর্শের নাম। তার কথা মনে হলেই আমরা আবেগাপ্লুত হয়ে পড়ি। কারণ বঙ্গবন্ধুর জীবন, তার কর্মস্পৃহা, তার দূরদর্শিতা আর ১০ জন মানুষের চেয়ে ছিল আলাদা। টুঙ্গিপাড়ার রাখাল রাজা শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম হয়েছিল পরাধীন জাতিকে মুক্ত ও স্বাধীনতা দিতে। এই লক্ষ্যে তিনি সুদূর প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে ছাত্রাবস্থায় আন্দোলন, সংগ্রাম শুরু করেছিলেন। ধীরে ধীরে সমগ্র জাতিকে তার স্বার্থ পূরণের সারথি করে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে এগিয়ে গেছেন অভীষ্ট লক্ষ্যে। জেল, জুলুম, হুলিয়া এমনকি মৃত্যু পরোয়ানার কাছেও মাথা নত করেননি জনগণের এই নেতা।

বঙ্গবন্ধু কখনো পাকিস্তানের নেতা বা মন্ত্রী হতে চাননি। তিনি রাজনৈতিক জীবনের শুরু থেকেই পাকিস্তানের অর্থনৈতিক শোষণ, বৈষম্য, নিপীড়ন ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে ছিলেন সোচ্চার এবং আপসহীন কণ্ঠস্বর। তিনি বাঙালির স্বাধীনতা ও অর্থনৈতিক মুক্তি চেয়েছেন। এই লক্ষ্য বাস্তবায়নে আন্দোলনের সূতিকাগার হিসেবে ছাত্রলীগ গঠন, পরবর্তীতে বাঙালি জাতির ঐতিহাসিক মহান মুক্তি সনদ ৬ দফা, পরে ১১ দফা দাবি আদায়ে নগরীর রাজপথ থেকে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মেঠোপথে দুর্বার ছাত্র গণ-আন্দোলন গড়ে তুলে তা ছড়িয়ে দেন দেশময়। এই মহান লক্ষ্য অর্জনের আন্দোলনে সম্পৃক্ত হন দেশের আপামর খেটে খাওয়া মানুষসহ সর্বস্তরের মুক্তিকামী জনগণ। বঙ্গবন্ধুর আপসহীন নেতৃত্বে ’৬৯ সালের গণ-আন্দোলন, ১৯৭০ সালের নির্বাচন, নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের সংখ্যাগরিষ্ঠতায় আকাশচুম্বী বিজয়, নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে গড়িমসি ও আলোচনার নামে প্রহসন। একদিকে বিজয়ী দল আওয়ামী লীগের সঙ্গে লোক দেখানো আলোচনা।

অন্যদিকে, পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকাসহ সব বিভাগীয় শহর, জেলা শহরে সৈন্য সমাবেশ ঘটানো। চট্টগ্রামে, ঢাকায় পাক সৈন্যদের হাতে আন্দোলনরতদের ওপর নির্বিচারে গুলিবর্ষণ। মানুষ হত্যার এক নরকে পরিণত হওয়ার পথে তখন বাংলাদেশ। এমনি অবস্থায় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে লাখো জনতার উপস্থিতিতে কৌশলে স্বাধীনতা ও মুক্তির জন্য মরণপণ আন্দোলনের ঘোষণা দেন। মূলত সেদিন থেকে এই বাংলার শাসন ভার তথা রাষ্ট্র পরিচালিত হয় বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে। ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অবশেষে বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বিশ^ মানচিত্রে ঠাঁই করে নেয়। এজন্য ৩০ লাখ শহীদ, দুই লাখ মা বোনের সম্ভ্রম, অযুত সম্পদ ক্ষতির বিনিময়ে অর্জিত হয় মহান স্বাধীনতা। যুদ্ধককালে পাক বাহিনী দেশের প্রায় সব রাস্তাঘাট, পুল কালভার্ট, ব্রিজ ধ্বংস করে, ব্যাংক লুট করে। বাংলাদেশকে শ্মশানে পরিণত করে।

এমন কঠিন পরিস্থিতিতে সরকার পরিচালনার দায়িত্ব ভার গ্রহণ করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি সদ্য স্বাধীনতা প্রাপ্ত বাংলাদেশকে মাত্র সাত মাসের মধ্যে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করে তুলেছিলেন। আর এ কারণে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রে তাকে জীবন দিতে হয়েছে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শুধু একজন মহান নেতাকে হত্যা করা হয়নি, পুরো বাঙালি জাতিকে হত্যার চেষ্টা হয়েছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ষড়যন্ত্রকারীদের সে স্বপ্ন আজ দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে উন্নয়নের রোল মডেলে পরিণত হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর আজীবনের স্বপ্ন ছিল ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত উন্নত-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ। তবে সেই বাংলাদেশ এখন বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা পরিণত হতে যাচ্ছে। যদিও ঘাতকদের ষড়যন্ত্র এখনো থেমে নেই।

বঙ্গবন্ধু শুধু রাজনৈতিক মুক্তি নয়, অর্থনৈতিক মুক্তিও চেয়েছিলেন। তিনি তার সুদীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের শুরু থেকেই পাকিস্তানের শোষণের বিরোধিতা করেছেন। তিনি চেয়েছেন এ দেশের মানুষ উদ্যোক্তা হবে। এজন্য তিনি স্বাধীনতার পর দ্রুত বিসিক গঠন করেন। বঙ্গবন্ধুর মতো সৎ রাজনৈতিক নেতা পৃথিবীতে বিরল। তিনি সব সময় দেশ ও মানুষের কথা ভাবতেন। আইয়ুব খান তাকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন, কিন্তু তিনি তা গ্রহণ করেননি। ১৯৪৭ থেকে ধীরে ধীরে বাংলার মানুষকে একত্র করেছেন। দীর্ঘ সংগ্রামের মাধ্যমে দেশ স্বাধীন করেছেন। বঙ্গবন্ধুর খুনিদের জিয়াউর রহমান পুরস্কার হিসেবে বিদেশে চাকরি দিয়েছেন। খালেদা জিয়া সংসদে বসিয়েছেন। জিয়া-খালেদা স্বাধীনতাবিরোধীদের হাতে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের রক্তে রঞ্জিত স্বাধীনতার পতাকা তুলে দিয়েছিলেন। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্র্রেনেড হামলা তারাই করেছে।

মনে রাখতে হবে, ১৫ আগস্ট ও ২১ আগস্ট একই সূত্রে গাথা। একটা গোষ্ঠী চেয়েছে বাংলাদেশ হবে অনুন্নত দেশের মডেল। কিন্তু শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের মডেল হয়েছে। বঙ্গবন্ধু প্রসারিত চিন্তা ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন মানুষ ছিলেন। দেশ স্বাধীনের পরে বৈদেশিক মুদ্রা ছিল না। বিনিময়ের (বার্টার) মাধ্যমে আমদানি-রফতানি হতো। তখনই তিনি রফতানি বহুমুখীকরণের চিন্তা করেন। নিরাপদ দিয়াশলাই, বৈদ্যুতিক তার, মধু কীভাবে রফতানি করা যায়; সে বিষয়ে উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তিনি রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনে সব পাটকল জাতীয়করণ করলেও পরিচালনায় আগের মালিক ও কর্মীদের রেখেছিলেন। পরে বাংলাদেশিদের মালিকানার পাটকল বেসরকারি খাতে ফেরত দেওয়ার সিদ্ধান্তও নিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে আশির দশকেই বাংলাদেশ আজকের অবস্থানে চলে যেত।

শুধু ভৌগোলিক স্বাধীনতা নয়, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে বাঙালি জাতির মুক্তি চেয়েছেন। কিন্তু তিনি তা সময়ের অভাবে করতে পারেননি। এখন তারই সুুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দুর্নীতি দমন, কৃষি ও শিল্প উৎপাদন বৃদ্ধি, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে দেশ সেদিকেই যাচ্ছে। এটি ভুলে গেলে চলবে না যে, বঙ্গবন্ধুর মাধ্যমেই বাংলাদেশের সৃষ্টি। স্বাধীনতার পর ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পরবর্তী ২১ বছরে স্বাধীনতাবিরোধী কুচক্রী মহল বাংলাদেশকে পেছনে ঠেলতে চেয়েছে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও শেখ হাসিনার শক্তিশালী নেতৃত্বের কারণে তা সম্ভব হয়নি। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার কথা ছিল। কিন্তু তা আর হয়নি। বঙ্গবন্ধু চাইলে বিলেতে গিয়ে আইনে পড়তে পারতেন। কিন্তু তিনি রাজনীতি করার জন্য লন্ডনে পড়তে যাননি। মানুষের জন্য তিনি ছাত্রজীবন থেকেই নিবেদিত ছিলেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও মানুষের জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করে চলেছেন। এর ফল দেশবাসী পাচ্ছে। বঙ্গবন্ধু কখনো মৃত্যুকে ভয় পাননি। তিনি মানুষকে ভালোবেসেছিলেন। মানুষের জন্য জীবন দিতে সর্বদা প্রস্তত থাকতেন। ১৯৪৮ সাল থেকেই বঙ্গবন্ধু বুঝেছিলেন পাকিস্তান বাঙালিদের জন্য নয়। আজকে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, পায়রা সমুদ্রবন্দর, পদ্মা সেতু ও কর্ণফুলী নদীর তলদেশে টানেল, রাজধানীতে মেট্রোরেল নির্মাণ হচ্ছে। এসবই বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন তার কন্যার মাধ্যমে বাস্তবায়ন হচ্ছে। বঙ্গবন্ধু আমাদের মানচিত্র, পতাকা, জাতীয় সংগীত, মায়ের ভাষায় কথা বলার অধিকার দিয়েছেন। ’৭৫ সালে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ছিল ৭ শতাংশ। আজকের প্রধানমন্ত্রীও দেশকে একইভাবে এগিয়ে নিচ্ছেন। তবে শঙ্কাও আছে। আত্মকলহ, অর্থনৈতিকভাবে নিজেদের উপকৃত করার প্রতিযোগিতা ঝুঁকি সৃষ্টি করছে। ত্যাগী নেতাদের দলে সম্মান দিতে হবে। ষড়যন্ত্র আগেও ছিল, এখনো আছে।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট কিছু বিপথগামী সেনাসদস্য কালের মহানায়ক বঙ্গবন্ধুসহ তার পরিবারের সদস্যদের নৃশংসভাবে হত্যা করে। এমন একজন আদর্শবান ব্যক্তির বুকে গুলি কেমন করে চালানো হয়, তা কল্পনাতীত। হয়তো সেদিন গুলি করে তারা জাতির পিতাকে দৈহিকভাবে নিঃশেষ করেছে, কিন্তু তার আদর্শ? সেটা তো অমর, যে আদর্শে এ দেশ সোনার বাংলায় রূপান্তরিত হতে চলেছে। তাই বলা যায়, এক মুজিব লোকান্তরে লক্ষ মুজিব ঘরে ঘরে। পৃথিবীর বুকে বাঙালি যত দিন বেঁচে থাকবে, শেখ মুজিবুর রহমান প্রত্যেক বাঙালির হৃদয়ে বেঁচে থাকবেন তত দিন। এটি চির সত্য যে, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শুধু আওয়ামী লীগের নেতা নন, তিনি বাংলাদেশের ১৮ কোটি মানুষের নেতা। তিনি বাংলাদেশকে স্বাধীন করেছিলেন এ দেশের মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য।

বঙ্গবন্ধুর জীবন ও আদর্শ বুকে ধারণ করে তার জীবনী থেকে আমরা শিক্ষা গ্রহণ করব এবং দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাব। তাহলেই বঙ্গবন্ধুর বিদেহী আত্মা শান্তি পাবে। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ অন্তরে ধারণ করেই তার সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আমরা এগিয়ে যাব বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা বিনির্মাণে এই হোক আমাদের শপথ।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ জার্নালিস্ট ফোরাম

[email protected]

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
শেখ হাসিনা,সোনার বাংলা,আওয়ামী লীগ
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close