আয়েশা খাতুন
করোনাকালে ই-লার্নিং শিক্ষাপদ্ধতি
করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব মানবজীবনের সব দিককে যেমন অসাড় করে দিয়েছে, ঠিক তেমনি শিক্ষা খাতে আমূল পরিবর্তন ঘটিয়েছে। আমাদের শিক্ষা সম্প্রদায়টি সাম্প্রতিক সময়ে তীব্র চাপের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, যা কি না ই-লার্নিং (ইন্টারনেট/প্রযুক্তিনির্ভর অনলাইন শিক্ষাপদ্ধতির) সূত্রপাত ঘটিয়েছে। এ ধরনের পাঠদান পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীরা তুলনামূলকভাবে নিষ্ক্রিয় থাকে। সেক্ষেত্রে শিক্ষকদের পেশাগতভাবে আধুনিক প্রযুক্তি প্রয়োগের ক্ষেত্রে পারদর্শী হতে হবে। যদিও শহরাঞ্চলে কিছু নামিদামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অনলাইন ক্লাস বেশ দক্ষতার সঙ্গে পরিচালনা করছে। কিন্তু প্রত্যন্ত অঞ্চলে এমনকি শহরের প্রান্তিক অংশের শিক্ষক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো মেশিন লার্নিংয়ের সঙ্গে পরিচিত নয়। তারা প্রযুক্তিতে অনুন্নত, বিশেষ করে আমাদের দেশে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের স্কুল এবং কলেজগুলো অনলাইন ক্লাস কার্যকরীভাবে পরিচালনার জন্য যথেষ্ট দক্ষতাসম্পন্ন নয়। এই নিবন্ধটি অনলাইন ক্লাস পরিচালনার জন্য সহায়ক অ্যাপ্লিকেশনগুলোর দিকে মনোনিবেশ করবে।
প্রথমেই জেনে নেওয়া যাক অনলাইন লার্নিং বা ই-লার্নি কী? ই-লার্নি হচ্ছে প্রযুক্তিনির্ভর শিক্ষা পদ্ধতি, যা কি না ইন্টারনেটের মাধ্যমে পরিচালনা করা হয়। এটিকে ‘অনলাইন শিক্ষা’ বা ‘দূরবর্তী শিক্ষা’ হিসেবে অভিহিত করা হয়; যা প্রচলিত শ্রেণিকক্ষে পাঠদান থেকে ভিন্নতর। একজন শিক্ষক, প্রশিক্ষক এবং গবেষক হিসেবে আমাদের অবশ্যই শ্রেণিকক্ষের শিক্ষা এবং ভার্চুুয়াল শিক্ষা পদ্ধতির মধ্যে পার্থক্য বুঝতে হবে। সে অনুযায়ী কার্যকরীভাবে অনলাইন ক্লাস পরিচালনার জন্য পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। অনলাইন ক্লাসে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মধ্যে সরাসরি সংযোগ বা যোগাযোগ থাকে না। সেখানে নাই কোনো নির্ধারিত সময়সূচি (ক্লাসরুটিন), নাই কোনো বাধানিষেধ নিয়মকানুন। এটা হচ্ছে স্বাধীন এবং নির্ভর শিক্ষা পদ্ধতি; যা কি না ২৪ ঘণ্টা যেকোনো সময় যেকোনো জায়গায় বসে গ্রহণ করা সম্ভব। অনলাইন শিক্ষা পদ্ধতি সরাসরি সম্প্রচার এবং ধারণকৃত দুই পদ্ধতিতেই হতে পারে।
সরাসরি সম্প্রচারিত অনলাইন ক্লাসে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সরাসরি যোগাযোগ, বার্তা আদান-প্রদান, আলোচনা-পর্যালোচনা ও মতবিনিময় হয়ে থাকে। যার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের সব প্রশ্নের সমাধান ক্লাসে দিয়ে দেওয়া যেতে পারে। পক্ষান্তরে পূর্ব ধারণকৃত শিক্ষা পদ্ধতিতে একটি ভিডিওবার্তা অথবা ইউটিউব চ্যানেলের মাধ্যমে ক্লাস পরিচালনা করা হয়। তবে যেখানে তাৎক্ষণিক যোগাযোগ, বার্তা আদান-প্রদান সম্ভব হয়ে উঠে না। সেক্ষেত্রে শিক্ষক একটি নির্দিষ্ট বিষয়বস্তু নিয়ে আলোচনা করে প্রয়োজনীয় তথ্য ও অ্যাসাইনমেন্ট প্রদান এবং পরবর্তী ক্লাসে শিক্ষার্থীদের সমস্যা নিয়ে আলোচনার মাধ্যমে asynchronous learning পদ্ধতিকে ফলপ্রসূ করে তুলতে পারেন। তবে তা ই-লার্নিং মিশ্র শিক্ষা পদ্ধতির মাধ্যমেও করা সম্ভব্। সরাসরি সম্প্রচারণ এবং পূর্ব ধারণকৃত লেকচার এই দুয়ের সমন্বয়ে হয় ব্লেন্ডেড লার্নিং। শিক্ষার্থী কোনো বিষয়ে পাঠদান কালে বুঝতে না পারলে কিংবা দ্বিধাদ্বন্দ্ব থাকলে বারবার সংরক্ষিত ভিডিও/অডিও বার্তা দেখে বুঝে নিতে পারে, যেহেতু সব শিক্ষার্থীর মেধা, দক্ষতা ও জ্ঞান সমান নয়। তাই শিক্ষার্থীরা নিজস্ব গতিতে বিষয়বস্তুগুলো আত্মস্থ করতে পারে এই রেকর্ডকৃত ও সংরক্ষিত অনলাইন ক্লাসের মাধ্যমে। প্রচলিত পাঠদান পদ্ধতি কিংবা অনলাইন ক্লাস যেকোনো প্রকার শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষকরা সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন; তবে অনলাইন শিক্ষাদানে শিক্ষকদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। যেহেতু শিক্ষার্থীদের সরাসরি উপস্থিতি থাকে না, তাই তাদের নিয়ন্ত্রণ করা, দীর্ঘ সময় তাদের মনোযোগ আকৃষ্ট করা সহজতর নয়। সেক্ষেত্রে শিক্ষকদের পূর্ব প্রস্তুতি এবং কিছু হোমওয়ার্ক অবশ্যই করতে হয়। ছোট ছোট ভিডিও ক্লিপ, অডিও রেকর্ড, ছবি স্লাইড শেয়ার, গ্রুপ ডিসকাশন, অ্যাসাইনমেন্ট কুইজ ইত্যাদির সাহায্যে শিক্ষার্থীদের অনুপ্রাণিত করতে পারেন। সর্বদা শিক্ষকদের স্বপ্রণোদিত এবং স্বতঃস্ফূর্ত থাকতে হবে, তবেই তারা শিক্ষার্থীদের এ দুর্যোগপূর্ণ সময়ে আগ্রহী করে তুলতে পারবেন। এখানে কয়েকটি সফটওয়্যার অ্যাপসের পরিচিতি এবং কার্যকারিতা তুলে ধরা হলো; যাতে যথাযথ ব্যবহারের মাধ্যমে প্রত্যন্ত এলাকার শিক্ষকরা উপকৃত হতে পারেন।
জুম : বাংলাদেশসহ বিশ্বের অধিকাংশ দেশে এখন এটি অত্যন্ত পরিচিত। বিশেষ করে অনলাইন ক্লাস পরিচালনার ক্ষেত্রে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা যোগ দিতে পারে। অডিও/ভিডিও বা স্লাইড শেয়ার, প্রশ্ন উত্তর পর্ব, পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশনের মাধ্যমে ক্লাস নেওয়া যেতে পারে।
গুগল ক্লাসরুম : এই পরিষেবার মাধ্যমে স্বতন্ত্র ক্লাস তৈরি, অ্যাসাইনমেন্ট, ফাইল আদান-প্রদান এবং ফিডব্যাক শেয়ার করা যায়। এতে ছোট বড় সব প্রকার প্রশ্নপত্র সেট, সময় নির্ধারণ করে মূল্যায়নের ব্যবস্থা রয়েছে শিক্ষক, প্রশিক্ষক, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কর্তৃক প্রেরিত ই-মেইল আইডি এবং কোডের মাধ্যমে সরাসরি শিক্ষার্থীরা গুগল ক্লাসরুমে প্রবেশ করতে সক্ষম।
মাইক্রোসফট টিম : এটি একটি গ্লোবাল এডুকেশন নেটওয়ার্ক যা সব শিক্ষক শিক্ষার্থী এবং প্রতিষ্ঠানকে সংযুক্ত করতে সক্ষম। শুধু একটি বৈধ ই-মেইল ঠিকানার মাধ্যমে সীমাহীন ভিডিও কল করা যায়; যেখানে শিক্ষার্থীরা অতিথি হিসেবে যোগদান করতে পারে।
সক্রেটিস ডটকম : সক্রেটিস অত্যন্ত কার্যকরী একটি সফটওয়্যার। যেখানে একটি অ্যাকাউন্ট খুলে টিউটোরিয়াল নেওয়া যেতে পারে। আবার কুইজ ডিজাইন এবং দ্রুত প্রশ্নাবলি করাও সম্ভব।
মুুডুল : মুডুল একটি ওপেন রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট। যা আমাদের দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অনেক আগে থেকে প্রচলিত ছিল। এই অ্যাপসটির মাধ্যম কুইজ, রিপোর্ট, শিক্ষার্থীদের তালিকাভুক্তকরণ সব কিছুই সম্ভব।
এডেমডো : এই প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে শিক্ষকরা অতি সহজেই যেকোনো বিষয়বস্তু নিয়ে আলোচনা-পর্যালোচনা, কুইজ, অ্যাসাইনমেন্ট প্রদান, শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করতে পারেন।
গুগল মিট : গুগল ক্লাসরুমের মতোই এর কার্যকারিতা। গুগল মিটে একসঙ্গে ১০০ জন ভিডিও সংলাপে অংশগ্রহণ করতে পারেন শুধু একটি বৈধ ই-মেইলের মাধ্যমে।
প্রিজি : অডিও ও ভিডিও বার্তা উপস্থাপনের মাধ্যমে ক্লাস নেওয়া যেতে পারে।
প্যাডলেট : এটি হচ্ছে ডিজিটাল বোর্ড বা ওয়েব পৃষ্ঠা তৈরির জন্য শিক্ষকদের সাহায্যকারী সরঞ্জাম।
মেন্টিমিটার : এটি একটি পোলিং অ্যাপস। যেখানে সরাসরি ভোটদান, মতামত গ্রহণ, নৈব্যত্তিক পদ্ধতিতে মূল্যায়ন ও পারস্পরিক আদান-প্রদানের ক্ষেত্রে এটি খুবই কার্যকরী।
ওপরে উল্লিখিত অ্যাপসগুলো গুগল প্লে স্টোর অ্যাপ স্টোর থেকে খুব সহজে অ্যান্ড্রয়েড, ল্যাপটপ ও কম্পিউটারের মাধ্যমে কয়েক মিনিটেই ডাউনলোড করা সম্ভব। বর্তমানে মহামারির কারণে জীবনের সংজ্ঞা, সমীকরণ সামাজীকরণ, মানুষের চালচলন প্রতিটি ক্ষেত্রে দ্রুত পরিবর্তন ঘটেছে, যা কি না প্রাদুর্ভাব শেষ হওয়ার পরও বিদ্যমান থাকবে। এমতাবস্থায় ই-লার্নিং এবং ব্লেন্ডেড শিক্ষা পদ্ধতি ব্যবহার আমাদের চালিয়ে যেতে হবে। কারণ প্রতিনিয়তই নতুন নতুন ভাইরাসের আবির্ভাব ঘটছে ভিন্ন নামে ভিন্ন রূপে। এ ছাড়া নদীমাতৃক বাংলাদেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বন্যার কারণে অনেকটা সময়জুড়ে গ্রামাঞ্চলের এমনকি শহরের শিক্ষার্থীদের স্কুল-কলেজ যাতায়াতের বিঘ্ন ঘটে ও আবার অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘট, পরিবহন ধর্মঘট, রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে যখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো যখন লাগাতার বন্ধ থাকে এমতাবস্থায় ই-লার্নিং খুবই সহায়ক হিসেবে কাজ করবে। এর জন্য যথাযথ প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। পাঠদান ও পাঠগ্রহণ প্রক্রিয়াকে সচল রাখতে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে অন্ধকারের হাত থেকে রক্ষা করতে অনলাইন শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। যথাযথ জ্ঞান এবং দক্ষতার অভাবে ইতোমধ্যে অনেক ছোটখাটো স্কুল বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে, তাই সরকারকে ডিজিটাল পদ্ধতিতে পাঠদানের জন্য প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা চালু করতে হবে। প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে শক্তিশালী নেট সংযোগ নিশ্চিত করতে প্রয়োজন শিক্ষার্থীদের জন্য ফ্রি ইন্টারনেট প্যাকেজ চালু করা। যাতে শিক্ষা ক্ষেত্রে ই-লার্নিং প্রক্রিয়াটিকে সচল এবং গতিশীল রাখতে পারে।
লেখক : টিচিং লার্নিং কো-অর্ডিনেটর, আইস্টেম বাংলাদেশ www.Istembd.com
পিডিএসও/হেলাল