সাহাদাৎ রানা

  ০৮ সেপ্টেম্বর, ২০২০

মাছ উৎপাদনে নতুন রেকর্ড

বিশ্বে মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ দ্বিতীয় অবস্থানে উঠে এসেছে

বিশ্বে চলছে করোনাকাল। অদৃশ্য এই ভাইরাসের বিপক্ষে লড়াই করছে কোটি কোটি মানুষ। এর বাইরে নয় বাংলাদেশও। দেশের মানুষও করোনার মধ্যে বেঁচে আছে নতুন চ্যালেঞ্জ সামনে রেখে। বেঁচে থাকার প্রশ্নে লড়াইয়ের মাঝে তাই বর্তমান করোনাকালে নেই কোনো সুসংবাদ। সবার মধ্যেই কাজ করছে ভয় আর উৎকণ্ঠা। তবে সেই ভয় আর উৎকণ্ঠার মধ্যে একটি সুখবর পেল বাংলাদেশ। বিশ্বে মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন দ্বিতীয় অবস্থানে উঠে এসেছে।

সম্প্রতি জাতিসংঘের ‘দ্য স্টেট অব ওয়ার্ল্ড ফিশারিজ অ্যান্ড অ্যাকুয়াকালচার’ একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। যেখানে ২০১৯ সালে বিশ্বে প্রায় ১৮ কোটি টন মাছ উৎপাদনের তথ্য উঠে আসে। এসব মাছের অর্ধেকেরও বেশি স্বাদুপানির মাছ। আর বাকি মাছ সামুদ্রিক উৎসের। বাংলাদেশ সাফল্য দেখিয়েছে স্বাদুপানির মাছ উৎপাদনের ক্ষেত্রে। জাতিসংঘের দ্য স্টেট অব ওয়ার্ল্ড ফিশারিজ অ্যান্ড অ্যাকুয়াকালচারের প্রতিবেদন অনুযায়ী স্বাদুপানির মাছ উৎপাদনে তৃতীয় থেকে দ্বিতীয় স্থানে উঠে এসেছে বাংলাদেশ। এই তালিকায় প্রথম স্থানে রয়েছে চীন।

অন্যদিকে, স্বাদুপানির মাছের পাশাপাশি চাষের মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ রয়েছে আগের অবস্থানে। অর্থাৎ বর্তমানে বিশ্বে চাষের মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান পঞ্চম। মাছ উৎপাদনের এমন খবর দেশের অর্থনীতির জন্য অবশ্যই ইতিবাচক। কারণ উৎপাদিত মাছ রফতানি করে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা সম্ভব হচ্ছে।

অথচ এমন একটা সময় ছিল, যখন আমাদের দেশে মাছ উৎপাদন হতো শুধু নিজেদের চাহিদা পূরণ করার লক্ষ্যে। কিন্তু সময়ের স্রোতে এখন বদলে গেছে সেই চিত্র। এখন বিশ্বে স্বাদুপানির মাছ উৎপাদনে দ্বিতীয় স্থানে উঠে এসেছে বাংলাদেশ। শুধু তাই নয়, এখন বাংলাদেশ থেকে যেসব পণ্য বিদেশে রফতানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয় হয় তার মধ্যে মাছ উল্লেখযোগ্য একটি পণ্য। দিন দিন বিশ্বে বাংলাদেশের মাছের চাহিদা বাড়ছে। চাহিদা বৃদ্ধির পেছনে অন্যতম কারণ হলো মিষ্টি এবং লোনাজলের মাছ, অন্য মাছের চেয়ে স্বাদে আলাদা। এ কারণে বাংলাদেশের মাছ উৎপাদন ও রফতানিতে আলাদা জায়গা দখল করেছে। বিশেষ করে আমাদের ইলিশ এখন দেশ এবং জাতির অহংকারের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেননা এই ইলিশ আমাদের দেশের জন্য বিশ্ব স্বীকৃত ব্র্যান্ড মালিকানা পণ্য হিসেবে খ্যাত। শুধু তাই নয়, যেকোনো মাছের উৎপাদনে আমরা আমাদের ঘাটতি মোকাবিলা করে আরো রফতানি করতে সক্ষম হয়েছি। এখন রফতানির পরিমাণ দিন দিন বাড়ছে। এটা দেশের অর্থনীতির জন্য আশার খবর।

মাছ চাষ ও মাছ রফতানি নিয়ে আলোচনার পূর্বে আমাদের খাদ্যতালিকায় মাছের প্রয়োজনীয়তার দিকে একটু দৃষ্টি দেওয়া যাক। প্রতিদিন একজন মানুষের প্রায় ৬২ গ্রাম আমিষের প্রয়োজন। আর এই আমিষের প্রধান চাহিদার উৎস হচ্ছে মাছ। আশার খবর হলো, মাছের মাধ্যমে আমরা আমাদের এই আমিষের চাহিদা পূরণ করতে সক্ষম হচ্ছি। কারণ দিন দিন আমরা মাছ চাষ বা উৎপাদনে আমাদের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য ছাড়িয়ে যাচ্ছি। বর্তমানে দ্বিতীয় স্থানে উঠে আসা মাছ উৎপাদনে ব্যাপক সাফল্যের খবর সেটাই প্রমাণ করে। এখন আমরা দেশে মোট কৃষিজ আয়ের শতকরা ২৪ ভাগের বেশি পাই মৎস্য খাত থেকে। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদন কিংবা জিডিপির অবদানেও রয়েছে মৎস্য খাতের অবদান। মাছ উৎপাদনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে, এতে করে সেদিন বেশি দূরে নয়, যেদিন চীনকে পেছনে ফেলে শীর্ষস্থানে পৌঁছে যাবে বাংলাদেশ। এটা সম্ভব হবে সরকারের আন্তরিকতা ও ব্যক্তি পর্যায়ে মৎস্য চাষে উদ্বুদ্ধ হওয়ার কারণে।

এবার একটু পেছনে ফিরে তাকানো যাক। আমাদের দেশের মোট জনগোষ্ঠীর মধ্যে প্রায় পৌনে ২ কোটি মানুষ মৎস্য সংশ্লিষ্ট কাজে নিয়োজিত। মৎস্য খাত থেকে আয়-উপার্জন করে তারা জীবিকা নির্বাহ করছেন। লাভজনক হওয়ায় দিন দিন বেকার যুবক থেকে শুরু করে অনেকে মৎস্য চাষে আগ্রহী হচ্ছেন। আর এটা সম্ভব হয়েছে সরকারের সুচিন্তিত পরিকল্পনা, মৎস্য বিভাগের মাঠপর্যায়ের কর্মীদের নিরলস পরিশ্রমের কারণে। পাশাপাশি মৎস্য চাষের ক্ষেত্রে গবেষণা ও সময় অনুযায়ী জলজসম্পদ ও মাছের বংশ বৃদ্ধির ব্যবস্থা করার ক্ষেত্রেও সাফল্য আশাজাগানিয়া। বিশেষ করে সম্প্রতি দেশের পুকুর ও খালগুলোতে মাছ চাষে নীরব বিপ্লব ঘটেছে। গত তিন দশকে বাংলাদেশে মাছের উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ২৫ গুণ। এটা গেল উৎপাদনের ক্ষেত্রে। অন্যদিকে, মাছ রফতানি করে এখন বাংলাদেশ প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয় করছে। শুধু তাই নয়, দেশে উৎপাদিত মাছের বড় অংশ এখন বাণিজ্যিকভাবে বাজারজাত করা হচ্ছে। বিশেষ করে হিমায়িত মাছ রফতানি করে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ দিন দিন এগিয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এ বিষয়ে সাফল্য এসেছে ব্যাপক।

বিগত কয়েক বছর মাছ রফতানি লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে গেছে আগের বছরগুলো থেকে। ফলে মাছ রফতানির এ খবর আমাদের জন্য অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক। তবে হিমায়িত ও জীবিত মাছ রফতানিতে কিছুটা তারতম্য লক্ষ করা যাচ্ছে। হিমায়িত মাছ রফতানি কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে থাকলেও জীবিত মাছের ক্ষেত্রে সাফল্য আশাব্যঞ্জক নয়। ফলে জীবিত এবং হিমায়িত মাছ রফতানির ক্ষেত্রে এই তারতম্যের বিষয়টি সংশ্লিষ্টদের বিবেচনায় নেওয়া প্রয়োজন। বিশেষ করে ইলিশ, চিংড়িসহ হিমায়িত মাছের পাশাপাশি কাঁকড়া, কুঁচিয়া ইত্যাদি জীবিত মাছ রফতানি হয়ে আসছে। ফলে জীবিত মাছ রফতানি কেন পিছিয়ে পড়ছে, তা খতিয়ে দেখে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। মাছ রফতানির এই ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার কোনো বিকল্প নেই, যদি আমরা মাছ রফতানি করে আরো বেশি আয় করতে সক্ষম হব। মাছ উৎপাদনে অনেক সাফল্য এলেও কিছু কারণে পুরোপুরি সেই সাফল্য আসছে না। বিশেষ করে কিছু মানুষ এখনো মাছ চাষের ক্ষেত্রে গতানুগতিক পদ্ধতি থেকে বেরিয়ে আসছে না। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের সব জায়গায় যদি উন্নত ও আধুনিক পদ্ধতিতে মাছ চাষ করা সম্ভব হয়, তবে উৎপাদন আরো বৃদ্ধি পাবে। বিশেষ করে দেশি প্রজাতির মাছকে বিলুপ্তি থেকে রক্ষা করা যাবে। এর জন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগকে আরো কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।

যেহেতু মৎস্য খাতে উৎপাদন ও রফতানিতে আয় বাড়ছে সেহেতু সংশ্লিষ্টদের দায়িত্ব সামগ্রিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে আরো কার্যকর উদ্যোগ নিশ্চিত করা। যাতে মাছ উৎপাদন ও রফতানি আয়ে ভাটা না পড়ে। কারণ যত বেশি মাছ উৎপাদন করা সম্ভব হবে, ততই রফতানির সুযোগ বৃদ্ধি পাবে। এর ফলে লাভবান হবে দেশের অর্থনীতি। কেননা, রফতানি বাণিজ্য থেকে অর্জিত অর্থ দেশের সমৃদ্ধির জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তাই এটি গভীরভাবে বিবেচনায় নিয়ে মাছ রফতানির সাম্প্রতিক ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে সংশ্লিষ্টদের আরো আন্তরিক হওয়া প্রয়োজন। পাশাপাশি এ ক্ষেত্রে আরো কিছু উদ্যোগও প্রয়োজন। বিশেষ করে সম্ভাবনাময় রফতানিযোগ্য এই পণ্য রফতানির ক্ষেত্রে কিছু প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। যা নিরসন করতে হবে। সঠিকভাবে আমাদের অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব পড়ে সেটা লক্ষ রাখতে হবে। উৎপাদনের পাশাপাশি মাছ রফতানির বিষয়টি বিশেষ বিবেচনায় নিতে হবে। তবেই মাছ রফতানিসহ সার্বিকভাবে দেশের রফতানি আয় বৃদ্ধি এবং কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের মধ্য দিয়ে দেশ আরো সমৃদ্ধি হবে।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট [email protected]

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
রেকর্ড,মাছ উৎপাদন,সাফল্য,ইলিশ
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close