জান্নাতুল মাওয়া

  ০৬ সেপ্টেম্বর, ২০২০

করোনায় শিক্ষার্থীদের ওপর চাপ বাড়ছে

নভেল করোনাভাইরাসের মহামারিতে পুরো পৃথিবীই থমকে গেছে। বাংলাদেশও এর বাইরে নেই। ভাইরাসটির বিস্তার রোধের চেষ্টা করছে সরকার। করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি কমাতে গত ১৮ মার্চ থেকে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এদিকে বন্ধের সময়ও অনেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান টিউশন ফি আদায়ে শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকদের নানাভাবে চাপ প্রয়োগ করছে বলে অভিযোগ উঠেছে। যদিও ঢাকা মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড সম্প্রতি এক জরুরি নির্দেশনায় টিউশন ফি ও বেতন আদায়ে শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের চাপ না দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে।

একাডেমিক ক্যালেন্ডার থেকে একটি বছর হারিয়ে যাবে কি না, তা নিয়েও অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। একদিকে বাস্তবতার কারণে শিক্ষা মন্ত্রণালয় যেমন এখনো এইচএসসি পরীক্ষার কোনো সুনির্দিষ্ট তারিখ বলতে পারছে না, তেমনি পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়কেও করোনা পরিস্থিতির উন্নতির জন্য অপেক্ষা করতে হচ্ছে। তথ্য বলছে, ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় ছাড়া সবস্তরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এমন টানা বন্ধের ঘটনা আর ঘটেনি। তবে করোনার কারণে শিক্ষার সংকট এখন পৃথিবীজুড়েই। জাতিসংঘ ইতোমধ্যেই বলেছে, এত বেশিসংখ্যক শিক্ষার্থীর স্কুলে যাওয়া বন্ধ আগে কখনো হয়নি। এমনকি দুটি মহাযুদ্ধের সময়ও শিক্ষা ক্ষেত্রে এ সংকটময় পরিস্থিতি তৈরি হয়নি।

করোনায় প্রথম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার কথা ঘোষণা করেছিল চীন। বাংলাদেশে প্রথম দফায় গত ১৭-৩১ মার্চ পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়। এরপর এখন পর্যন্ত দফায় দফায় বন্ধের মেয়াদ বাড়ছে। এরমধ্যে ১ এপ্রিল থেকে এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা থাকলেও পরীক্ষাসূচি স্থগিত করতে বাধ্য হয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এ ছাড়া শিক্ষার সবচেয়ে বড় অংশের জোগান দেওয়া বেসরকারি খাতের পুরো শিক্ষা এখন মহাসংকটে। অধিকাংশ উদ্যোক্তা, শিক্ষক ও কর্মচারী সমিতির পক্ষ থেকে ইতোমধ্যেই সরকারের কাছে প্রণোদনা প্যাকেজের সুবিধার জন্য আবেদন করা হয়েছে। কেউ কেউ আবেদনের পর সংবাদ সম্মেলনেও দাবির যৌক্তিকতা তুলে ধরেছেন। শিশুদের কিন্ডারগার্টেনসহ বেসরকারি স্কুল, কলেজ থেকে শুরু করে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোক্তা ও শিক্ষক প্রতিনিধিরা সবাই সরকারের সহায়তা চেয়েছেন। সহায়তা চেয়েছেন ইংলিশ মিডিয়াম ও কোচিং সেন্টারের শিক্ষকরাও।

দেশে করোনাকালে শিক্ষার সামনে আসা দীর্ঘমেয়াদি সংকটের কথা মাথায় রেখে পরিকল্পনা গ্রহণের সুপারিশ করেছেন উপাচার্যসহ দেশের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদরা। করোনার ভ্যাকসিন না আসা পর্যন্ত শিক্ষাব্যবস্থা পরিচালনার জন্য একটি জাতীয় শিক্ষা কমিটি গঠনেরও সুপারিশ করেছেন তারা। বেশ কিছু ত্রুটি নিয়ে চলা অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রমের অনেক সমালোচনা থাকলেও এটাকে মন্দের ভালো বলছেন সবাই। এমন সংকটে এর চেয়ে ভালো কোনো পদক্ষেপ নেওয়ার উপায় নেই বলেও স্বীকার করছেন সবাই। দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি পুষিয়ে নিতে আগামীতে ছুটি কমানো, অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম অব্যাহত রাখা, শিক্ষকদের ইনসেনটিভের ব্যবস্থা করে বিশেষ ক্লাস নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন শিক্ষাবিদরা।

করোনাকালে সরকারি নির্দেশনা অমান্য করে টিউশন ফি আদায়ে অভিভাবকদের কাছে বিকাশ নম্বরও পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। অনেক প্রতিষ্ঠান আবার বেতন আদায়ে ফোন করে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের চাপ প্রয়োগ করছে। আবার এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই নিজেদের শিক্ষক-কর্মচারীদের বকেয়া বেতন দিতে টালবাহানা করছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। রাজধানীর প্রায় সবগুলো বেসরকারি বাংলা ও ইংরেজি মাধ্যম স্কুল নিয়ে একই অভিযোগ করছেন অভিভাবকরা। লকডাউনের সময় কোনো ধরনের শিক্ষা কার্যক্রম না থাকলেও বেতন আদায় করতে নিয়মিত বিরক্ত করা হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে অভিভাবকদের কাছে টিউশন ফি চাওয়া অমানবিক। কারণ অনেকেই লকডাউনের কারণে বেকার হয়ে ঘরে বসে আছেন। দোকানপাট বন্ধ হয়ে গেছে। অফিস বন্ধ, আয় বন্ধ। তাই এমন মানসিকতা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। তারা দীর্ঘদিন ব্যবসা করেছে। এ দুঃসময়ে কাবুলিওয়ালা মানসিকতা ত্যাগ করতে হবে।

এদিকে করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে সারা দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের মাসিক বেতন মওকুফ চেয়ে সরকারের কাছে আবেদন করেছেন সুপ্রিম কোর্টের দুই আইনজীবী। আবেদনে সব সরকারি-বেসরকারি স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে আদায়যোগ্য মাসিক বেতনের অর্ধেক পরিমাণ মওকুফ করার জন্য অনুরোধ করা। এদিকে টিউশন ফি মওকুফে অভিভাবকদের দৌড়ঝাঁপের বিপরীতে বসে নেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মালিকরাও। এরই মধ্যে কিন্ডারগার্টেনের শিক্ষক-কর্মচারীদের জন্য ৫০ কোটি টাকার প্রণোদনা চেয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে প্রস্তাব পাঠিয়েছে বাংলাদেশ কিন্ডারগার্টেন অ্যাসোসিয়েশন। সংগঠনের চেয়ারম্যান মনোয়ারা ভূঁইয়া ও মহাসচিব মো. মিজানুর রহমানের সই করা ওই প্রস্তাবে বলা হয়েছে, সম্পূর্ণ শিক্ষার্থীদের বেতনের ওপর নির্ভরশীল হওয়ায় কিন্ডারগার্টেনের ছয় লাখেরও বেশি শিক্ষক-কর্মচারী মানবেতর দিন কাটাচ্ছেন। কিন্ডারগার্টেন যদি না থাকত, তাহলে সরকারকে আরো ২৫ থেকে ৩০ হাজার বিদ্যালয় স্থাপন করে প্রতি মাসে শিক্ষকদের বেতন বাবদ কোটি কোটি টাকা ব্যয় করতে হতো। বর্তমান প্রেক্ষাপটে এ প্রতিষ্ঠানগুলো টিকিয়ে রাখার স্বার্থে প্রধানমন্ত্রীর প্রায় লাখ কোটি টাকার প্রণোদনা থেকে আমাদের জন্য ৫০ কোটি টাকা বরাদ্দের দাবি জানাচ্ছি।

উল্লেখ্য, গত ২৩ এপ্রিল এক জরুরি নির্দেশনায় চাপ দিয়ে টিউশন ফি আদায় না করার আহ্বান জানায় ঢাকা মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড। এতে বলা হয়, দেশে করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতি বিরাজমান থাকায় এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীদের মাসিক বেতন এবং অন্যান্য খাতে গৃহীত ফি আদায়ে এ মুহূর্তে চাপ প্রয়োগ না করার জন্য অনুরোধ করা হলো। পরবর্তী সময়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দিলে বা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরলে বকেয়াসহ মাসিক বেতন ও অন্যান্য ফি আদায়ে নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো। এ নির্দেশনা পাঠদান ও স্বীকৃতিপ্রাপ্ত সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রধানদের জন্য প্রযোজ্য হবে বলেও উল্লেখ করা হয়।

করোনায় শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে ধারাবাহিকতা রক্ষাই আমাদের এখন বড় চ্যালেঞ্জ। আর শিক্ষার ধারাবাহিকতা ধরে রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। উন্নত বিশ্বে এখন দূরশিক্ষণ ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। এমনকি ইরানেও অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রমে প্রধানত জনপ্রিয় অ্যাপ্লিকেশন হোয়াটসঅ্যাপ ব্যবহার করা হচ্ছে। ইরানের শিক্ষা মন্ত্রণালয় শাদ নামে একটি লার্নিং অ্যাপ চালু করেছে। এ অ্যাপে সব শিক্ষার্থীকে রেজিস্ট্রেশন করার জন্য বলা হয়েছে, যাতে তারা অনলাইনে তাদের শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে যেতে পারে। এ ছাড়া গুগল ক্লাসরুম, গুগল হ্যাংসআউট, স্কাইপ, ম্যাসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপসহ বিভিন্ন পদ্ধতি রয়েছে, যার মাধ্যমে সহজেই শ্রেণি কার্যক্রম চালানো যায়। দূরশিক্ষণের আওতায় অসংখ্য শিক্ষাবিষয়ক অ্যাপস আবিষ্কৃত হয়েছে, যা দিয়ে খুব সহজে লকডাউনে থেকেও বাড়িতে বসে শিক্ষাপ্রদান ও গ্রহণ করা যায়। অন্তত এটি শহরের মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর শিক্ষার্থীরা এ সুবিধার আওতায় আসতে পারে। আর আমাদের দেশে দরিদ্র পরিবার অনেক। সেসব পরিবারের শিক্ষার্থীদের কথা মাথায় রেখেই সরকারকে পুরো পরিকল্পনা সাজাতে হবে। পুরো প্রক্রিয়ায় সরকার, শিক্ষাবিদ, প্রযুক্তি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান, টেলিকম এজেন্সি, সুশীল সমাজ এবং এনজিওগুলোর সম্মিলিত উদ্যোগ প্রয়োজন। দেশে যার যে দক্ষতা আছে, এ সময়ে সেগুলো কাজে লাগাতে হবে। যেমন বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের দূরশিক্ষণের প্রযুক্তি রয়েছে। এ সময়েই এটি আমরা কাজে লাগাতে পারি।

করোনার থাবায় আমাদের দেশে ও পুরো বিশ্বে বর্তমানে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, আমরা তা কল্পনাও করিনি। কেউ আগে থেকে তা জানিও না। তাই সমস্যা মোকাবিলায় সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে সম্মিলিত চিন্তা নিয়ে। দরিদ্র ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর শিক্ষার্থী অনেক। সরকারের পক্ষেই কেবল সম্ভব এদের শিক্ষা কার্যক্রম যাতে ব্যাহত না হয়, সেজন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া। আমরা জানি, এ দেশে বহু অনুৎপাদনশীল খাতে, অযথা রাষ্ট্রীয় সম্পদ অনেক সময় ব্যয় করা হয়। অথচ সেগুলোর কোনো প্রয়োজনই নেই। তাই জরুরি এ খাতে সরকার যেন পর্যাপ্ত বরাদ্দ দিয়ে ব্যবস্থা করে দেয়, তা আমরা চাই। কারণ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মহামারি বা জরুরি অবস্থার অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায়, যত বেশি সময় শিশুরা বিদ্যালয় থেকে দূরে থাকে, তাদের বিদ্যালয়ে ফেরার সম্ভাবনা ততটাই কমে যায়। করোনায় শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে এ অবস্থা আমরা কোনোভাবেই চাই না। তাই করোনাকালে শিশুদের লেখাপড়া যাতে ঠিকমতো চলে, তার জন্য সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও বাজেট দিয়ে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে।

লেখক : শিক্ষার্থী, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়

ত্রিশাল, ময়মনসিংহ

[email protected]

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
করোনা,চাপ,শিক্ষার্থী
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close