মাহবুবুল আলম

  ২৮ জুলাই, ২০২০

হুমকির মুখে দেশের প্রাইভেট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান

প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস প্যান্ডেমিকে লকডাউন অবস্থা বিরাজ করছে বিশ্বে। এই ভাইরাসের ভয়াল থাবা থেকে নিষ্কৃত পায়নি বাংলাদেশও। দিন দিন বেড়েই চলেছে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা। করোনার সংক্রমণ রোধে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখেছে সরকার। ফলে দেশের প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের আয়ের সুযোগও এখন একেবারে বন্ধ রয়েছে। করোনার কারণে সৃষ্ট বৈশ্বিক দুর্যোগ বিশ্বের শিক্ষাব্যবস্থাকে চরমভাবে ধাক্কা দিয়েছে। বাংলাদেশের অবস্থা আরো করুণ ও হতাশাজনক। কোনোভাবেই শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে টিউশন ফি আদায় করা সম্ভব হচ্ছে না। এ সময়ে টিউশন ফি আদায়কে অমানবিকতার পর্যায়ে পড়ে বলে বেশির ভাগ অভিভাবক মনে করেন! কিছুতেই তারা বেতন দিতে রাজি নন। এর ফলে প্রতিষ্ঠানগুলো শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন দিতে পারছে না। অনেক প্রতিষ্ঠান অভিভাবকদের কাছে মানবিক আবেদন জানিয়ে এসএমএস পাঠিয়েও কোনো সদুত্তর পাচ্ছে না। এই অবস্থায় প্রবল হুমকির মুখে দেশের প্রাইভেট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো। তা থেকে একমাত্র সরকারই তাদের রক্ষা করতে পারে।

বাংলাদেশ কিন্ডারগার্টেন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ঐক্য পরিষদের সভাপতি ইকবাল বাহার চৌধুরী বলেছেন, করোনার ক্রান্তিলগ্নে আমরা প্রায় ৬০ হাজার প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ২০ লাখ শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারী পরিবার মানবেতন জীবনযাপন করছি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় আমরা কোনো ধরনের ফি আদায় করতে পারিনি। তাই শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন পরিশোধ করা সম্ভব হচ্ছে না। তবে এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যদি না থাকত তাহলে সরকারকে ২৫ থেকে ৩০ হাজার বিদ্যালয় স্থাপন করে প্রতি মাসে কোটি কোটি টাকা ব্যয় করতে হতো। সেদিক থেকে বলতে গেলে বছরে প্রায় ৫০০ কোটি টাকা আমরা সরকারের বাঁচিয়ে দিচ্ছি। পরোক্ষভাবে দেশের বেকার সমস্যা সমাধানেও বিরাট অবদান রেখে চলেছে এসব প্রতিষ্ঠান। কিন্ডারগার্টেনগুলো দেশের প্রাথমিক শিক্ষার দুরবস্থার মধ্য দিয়ে গড়ে উঠেছে। প্রাথমিক শিক্ষায় অর্ধেক প্রতিষ্ঠান (৬৫৫০০টি) রাষ্ট্রীয় পক্ষ থেকে পরিচালনা করা হয়। কিন্তু সেখানে শিক্ষকদের চাকরি সরকারি। এ ছাড়া অন্যান্য ব্যতিক্রম ছাড়া আমরা সবাই জানি, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো কীভাবে চলছে, কী শিখছে সেখানকার খুদে শিক্ষার্থী তথা ভবিষ্যৎ নাগরিকরা।

সংবাদমাধ্যমে দেখতে পেলাম বকেয়া বাড়িভাড়া এবং শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন দিতে না পেরে দেশের অনেক জায়গায় কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিতে হয়েছে। আবার কোথাও কোথাও বন্ধ করে দেওয়ার উপক্রম হয়েছে। এজন্য কিন্ডারগার্টেনের শিক্ষক, পরিচালক কিংবা মালিকদের কেউ দোষারোপ করতে পারবে না। কারণ প্রাথমিক শিক্ষার দুর্বলতার কারণেই এগুলো গড়ে উঠেছে। এখন তাদের পাশে দাঁড়ানোর দায়িত্বও অভিভাবক, সমাজ ও রাষ্ট্রের। পরিস্থিতির বিবেচনায় সিদ্ধান্ত এমনই হতে বাধ্য, কিন্তু লাখ লাখ শিক্ষক যারা শিক্ষা প্রদান করছেন আমাদের সন্তানদের অথচ তারা রাষ্ট্রীয় কোনো সুযোগ-সুবিধা পান না তাদের কী হবে? কিন্ডারগার্টেন জাতীয় বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানই ভাড়াবাড়িতে পরিচালিত হয় (৯৯ শতাংশ) কিংবা একটু সচ্ছল অথচ বেকার কোনো ছেলে বা মেয়ে নিজের বাসায় এ জাতীয় প্রতিষ্ঠান চালু করেন। কিন্তু করোনাকালীন বন্ধেও প্রতিষ্ঠানগুলোর বাড়িভাড়া ঠিকই দিতে হয়। এমনকি অন্যান্য বিলও প্রতিষ্ঠানগুলোকে বাণিজ্যিক হারে পরিশোধ করতে হয়; যা এখনো অব্যাহত আছে।

কিন্ডারগার্টেন ও প্রাইভেট বিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষক প্রতিষ্ঠান থেকে নামমাত্র বেতন পান, তারা নির্ভর করেন মূলত প্রাইভেট টিউশনির ওপর। করোনাকালে দীর্ঘ ও অনিশ্চিত এই বন্ধে তাদের টিউশনি যেমন বন্ধ রয়েছে, তেমনি অনিশ্চিত হয়েছে তাদের উপার্জন। কাজেই এই দুঃসময়ে তাদের জীবন এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে সংসার চালানো তাদের জন্য দুরূহ হয়ে পড়েছে। গত ১৭ মার্চ থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ শুরু হয়েছে এবং কয়েক দফায় বাড়িয়ে তা ৬ আগস্ট ২০২০ পর্যন্ত নেওয়া হয়েছে। এর পরও যে খুলবে তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই। কিন্তু নিজস্ব আয়ে চলা বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো যেমন কিন্ডারগার্টেন, স্বীকৃত অথচ নন-এমপিওভুক্ত, বলতে গেলে একেবারেই ব্যক্তিগতভাবে চলা এসব প্রতিষ্ঠানে কর্মরত শিক্ষক-কর্মচারীদের দিন কীভাবে কাটছে, কেউ কি তাদের নিয়ে ভাবছেন?

প্রধানমন্ত্রী আগেই বলেছেন, ‘যখন করোনার প্রকোপ থাকবে না, তখনই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা হবে। আমরা এখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলব না। অন্তত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত স্কুল-কলেজ সবই বন্ধ থাকবে, যদি করোনাভাইরাস অব্যাহত থাকে।’ অপরদিকে এ বিষয়ে শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন, ‘বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পুরোটাই টিউশন ফিনির্ভর। আমি অভিভাবকদের অনুরোধ করব, এখন তাদের খরচও একটু কম। তাই তারা যেন টিউশন ফির ব্যাপারটা বিবেচনা করেন। তবে যারা সমস্যায় আছেন তাদের কথা ভিন্ন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষকেও বলব, প্রয়োজনে কিছুটা ফি কম নেওয়া বা কিস্তিতে ফি নেওয়ার ব্যবস্থাও করা যেতে পারে। যার মধ্য দিয়ে অভিভাবকরাও কিছুটা স্বস্তি পেলেন, স্কুল শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা দিতে পারল, বড় আকারের কোনো সমস্যায় পড়ল না। কিন্তু এখন সরকারের পক্ষ থেকে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে বলার সুযোগ নেই যে তোমরা ফি নেবে না।’

শিক্ষক নেতারা বলেছেন, শিক্ষার্থীদের মাসিক টিউশন ফির ৪০ শতাংশ বাড়িভাড়া, ৪০ শতাংশ শিক্ষক-শিক্ষিকা, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন, বাকি ২০ শতাংশ গ্যাস বিল, বাণিজ্যিক হারে বিদ্যুৎ ও পানির বিলসহ অন্যান্য খরচ বহন করতে হয়। এমতাবস্থায় প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে টিউশন ফি আদায় না হওয়ায় মার্চ থেকে এ পর্যন্ত স্কুলগুলো সব ধরনের বিলসহ বাড়িভাড়া, শিক্ষক-শিক্ষিকা, কর্মচারী-কর্মকর্তাদের বেতন পরিশোধ করতে পারেনি। বাড়ির মালিক ভাড়ার জন্য চাপ দিচ্ছেন, শিক্ষক-শিক্ষিকা, কর্মকর্তা ও গরিব কর্মচারীরা অর্থকষ্টে মানবেতর জীবনযাপন করছেন।

করোনা মহামারি এখন বিশ্বের মূর্তিমান আতঙ্ক। অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেরও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছে। আর করোনায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত সেক্টর হলো শিক্ষাব্যবস্থা। সরকার লকডাউন তুলে দিয়ে অর্থনীতি চাঙা করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। তাই অনেক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, শিল্প-কারখানাসহ অফিস-আদালত খুলে দেওয়া হয়েছে। স্বাস্থ্যবিধি ও সামাজিক দূরত্ব মেনে এসব প্রতিষ্ঠান তাদের কর্মকান্ড চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু চার মাসেরও অধিক হলো দেশের সব পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ আছে। এমনকি সহসা খোলারও সম্ভাবনা নেই। এমতাবস্থায় দেশের প্রাইভেট শিক্ষাব্যবস্থা ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছে। দেশের বেশির ভাগ প্রাইভেট শিক্ষাব্যবস্থা ভাড়াবাসার ওপর প্রতিষ্ঠিত। করোনার এ সময়ে প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে টিউশন ফি আদায় করতে পারছে না। বাসাভাড়া দিতেই তারা হিমশিম খাচ্ছে। তাই এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কর্মরত শিক্ষক ও কর্মচারীদেরও বেতন দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। ফলে পরিবার-পরিজন নিয়ে ভয়ানক বিপদের মধ্যে দিন অতিবাহিত করছেন এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক ও কর্মচারীদের। সার্বিক ব্যবস্থা বিবেচনায় এ মুহূর্তে একমাত্র সরকারি প্রণোদনাই এ সমস্যার সমাধান করতে পারে। এটা এখন সময়ের দাবি।

গত মার্চ থেকে সব বিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করার পর থেকে আমার স্কুলের কোনো কোলাহল নেই। শিক্ষকতা জীবনের দীর্ঘ সময়ে এমন বাজে অবস্থার মুখোমুখি কখনো হইনি। সরকার বাহাদুর যদিও অনলাইনে ক্লাসের ব্যবস্থা করেছে; কিন্তু প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিক্ষার্থীরা সেসব সুবিধা থেকে বিভিন্ন কারণে বঞ্চিত। অনেক শিক্ষার্থীর ঘরে টেলিভিশন নেই, ইন্টারনেট সুবিধা নেই। সুতরাং তারা হেলাফেলায় সময় অতিবাহিত করছে। লেখাপড়ায় মনোযোগ দিতে পারছে না। বলছে, ক্লাস না হলে, পড়াশোনার চাপ না থাকলে, কীভাবে পড়া এগোয়? এদিকে বছর শেষ হয়ে আসছে অথচ সিলেবাস কমপ্লিট হয়নি। অর্ধবার্ষিক পরীক্ষা গ্রহণ করা সম্ভব হয়নি। কিছুদিন পর বার্ষিক পরীক্ষা গ্রহণ করা যাবে কি না, সেটাও অনিশ্চিত। এমতাবস্থায় শিক্ষক ও শিক্ষার্থী কেউই ভালো নেই। আমাদের সুন্দরতম দিনগুলো কবে ফিরে আসবে, আমরা জানি না।

শেষ করব এই বলে যে, শিক্ষাক্ষেত্রের বিশাল এই সেক্টরকে টিকিয়ে রাখতে এবং অসহায় শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জীবন বাঁচাতে প্রধানমন্ত্রী যেন সদয় হোন। আমরা আশা করছি, এ মুহূর্তে যেকোনো ধরনের আর্থিক সহায়তা দেশের শিক্ষা বিস্তারে বিপুল অবদান রাখা প্রাইভেট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর হাজার হাজার শিক্ষক, কর্মচারী ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মালিক বা পরিচালকদের রক্ষা করতে পারে আর এমনটাই আমাদের প্রত্যাশা।

লেখক : কবি-কথাসাহিত্যিক, কলামিস্ট ও গবেষক [email protected]

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান,হুমকি,প্রাইভেট
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close