মীর আবদুল আলীম

  ২৬ জুলাই, ২০২০

সীমিত পরীক্ষায় শিক্ষার্থীদের ক্ষতি

পরিস্থিতি একটু ভালো হলে সীমিত আকারে এইচএসসি পরীক্ষা নেওয়ার কথা ভাবছে সরকার। শিক্ষামন্ত্রী সম্প্রতি এ বিষয়ে বক্তব্যও দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, পরীক্ষার চেয়ে শিক্ষার্থীদের জীবনের মূল্য অনেক বেশি। শিক্ষার ক্ষেত্রে পরীক্ষাই শেষ কথা নয়। এক বছরে সব শেষ হয়ে যাবে তাও নয়। শিক্ষামন্ত্রীর এমন মন্তব্য বেশ ভালো লেগেছে আমাদের। তবে সরকারের ভাবনায় আনা সীমিত পরীক্ষার বিষয়টি আতঙ্কেরই বটে!

এইচএসসি পরীক্ষার ক্ষেত্রে কমসংখ্যক পরীক্ষা নেওয়া, পরীক্ষা কেন্দ্র বাড়িয়ে পরীক্ষা নেওয়া হলে কি দাঁড়াবে? প্রায় ১৪ লাখ পরীক্ষার্থী এবার এইচএসসি পরীক্ষা অংশ নিচ্ছে। যেভাবেই পরীক্ষা হউক নেওয়া হোক না কেন হল থেকে পরীক্ষার্থীকে কিন্তু একসঙ্গে বের হতে হবে। পরীক্ষার্থীদের সঙ্গে থাকবেন আরো এক-দুজন করে অভিভাবক। পরীক্ষা কেন্দ্রের নিরাপত্তার জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য, কেন্দ্রের শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়ে অনেক মানুষের সমাগম ঘটবে। প্রশ্ন হলো ১৪ লাখ শিক্ষার্থী কীভাবে কেন্দ্রে যাবে? কোনো পরিবহন যোগে নিশ্চয়ই। এ ক্ষেত্রে পরিবহনে চড়তে গিয়ে শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকদের করোনা আক্রান্তের সম্ভাবনা কিন্তু থেকেই যায়। এ ছাড়া পরীক্ষা দিতে এসে শিক্ষার্থীরা বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে সামাজিক দূরত্ব কতটা বজায় রাখতে পারবে, তা নিয়েও রয়েছে সংশয়।

শিক্ষার্থী কিংবা অভিভাবকরা করোনা আক্রান্ত হলে এর দায় কে নেবে? তখন জনগণ কিন্তু নিশ্চিতভাবে সরকারকেই দায়ী করবেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ নিয়ে শুরু হবে বিরূপ প্রতিক্রিয়া। তাতে সরকারের ভাবমূর্তি চরমভাবে নষ্ট হবে। আমাদের দেশের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্রচার অপপ্রচার কীভাবে হয় তা কিন্তু আমরা সবাই জানি। গুটিকয়েক দুর্নীতিবাজের কারণে দেশের সব জনপ্রতিনিধির ঢালাওভাবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হেয় করার ঘটনা অতীত নিকটেরই। পদ্মা সেতুতে রক্ত লাগে, মাথা লাগে এমন অপপ্রচারও কিন্তু ফেসবুক-ইউটিউবের মাধ্যমেই হয়েছে। দেখা গেল, কোনো শিক্ষার্থী করোনাভাইরাস ব্যতীত অন্য কোনো কারণে মারা গেলে এটাকেও একশ্রেণির মানুষ ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করবে। তাছাড়া এতসংখ্যক শিক্ষার্থী, অভিভাবক, শিক্ষক, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লোকজনের সমাগমে করোনা ছড়াবেই, এটা নিশ্চিত করে বলা যায়। তা যদি হয় তাতে সরকারকে অনেক বেশি খেশারত দিতে হতে পারে।

উন্নত বিশ্বে করোনাকালীন অটোপ্রমোশন দিচ্ছে এমন খবর আমরা জানি। এশিয়ার মধ্যে মালয়েশিয়া এমন কি পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতও স্কুল কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে অটোপ্রমোশনের ঘোষণা দিয়েছে। সিঙ্গাপুর, কানাডাসহ বহু দেশ অটোপ্রমোশন দিয়ে সামনের শিক্ষাকে গতি দেওয়ার চেষ্টা করছে। চলতি জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে ভারতের এনডিটিভি, আনন্দবাজারসহ বেশ কটি পত্রিকায় দেখলাম, করোনা পরিস্থিতিতে এ বছরের জন্য সব কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা না নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ভারতের রাজস্থান সরকার। তবে এসব শিক্ষার্থী পরীক্ষা ছাড়াই পরবর্তী ধাপে উত্তীর্ণ করা হবে বলে জানানো হয়। রাজস্থানের মুখ্যমন্ত্রী অশোক গেহলট বলেন, করোনা মহামারির কারণে রাজ্য সরকার এ বছরের জন্য সব পরীক্ষা বাতিল করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সব শিক্ষার্থীকে পরীক্ষা ছাড়াই পাস করানো হবে এবং আগামী কয়েক দিনের মধ্যে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশিকা অনুসারে তাদের স্কোর করা হবে বলে তিনি জানান।

এ ক্ষেত্রে আমাদের দেশে অটোপ্রমোশনে সমস্যা কোথায়? এসএসসি পরীক্ষার ফলাফলের ক্ষেত্রে এইচএসসিতে অটোপ্রমোশন হতেই পারে। তা না হলে পিএসসি, জেএসসির ফলাফলও বিবেচনায় আনা যায়। অটোপ্রমোশন হলে লাভ কিংবা লোকসান কী? এতে ৮ থেকে ১০ শতাংশ শিক্ষার্থী ফলাফলে কেবল খুব সামান্য লাভ-লস হতে পারে। তবে কোনো প্রকার ক্ষতি নয়। যেমন: পরীক্ষা হলে যারা এ গ্রেডের নিচে ফলাফল করত তারা হয়তো এ গ্রেড পেয়ে যাবে আগের ফলাফলের কারণে। এ ছাড়া যাদের এসএসসিতে এ গ্রেড ছিল তারা কিন্তু এ+ পেতে পারত। এ ক্ষেত্রে এ ধরনের শিক্ষার্থীর কিছুটা ক্ষতি হয় তো হবে। তবে এর পরিমাণ হবে খুবই কম। এতে অল্পসংখ্যক পরীক্ষার্থী কিছুটা লাভ লেকসানে পড়তে পারে। সংকটকালীন এমন একটু-আধটু সমস্যা কিন্তু মেনে নিতেই হয়। তাছাড়া করোনা মহামারি বিশ^জুড়ে এক মহাসংকট সৃষ্টি করেছে। সেক্ষেত্রে অনেক দেশই যখন এমনটা ভাবছে তখন বাংলাদেশেরও তা ভাবা উচিত। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ফলাফলে খুব একটা তারতম্য হবে না।

তাই শিক্ষার্থীদের সামনের কথা ভেবে তাদের অটোপ্রমোশন দেওয়া হলে তারা নতুনভাবনা শুরু করতে পারবে। ভর্তির বিষয়টা না হয় পরেই ভাবুক সরকার। এটাও কোনো পদ্ধতিতে করে নেওয়া যেতে পারে। করোনা সংকটকালে সব থেমে যাবে তা হতে পারে না। তাছাড়া এ মহামারি যদি ক্ষণস্থায়ী হতো তাহলে হয়তো অপেক্ষা কোনো বিষয় ছিল না। কিন্তু এটাতো সম্পূর্ণ অনিশ্চিত। তাই এইচএসসিতে অটোপ্রমোশনের বিষয়টি নিয়েও ভাবছেন অনেকে। অন্যদেশে সেমিস্টার চালু আছে—এমন কথা বলতে পারেন কেউ কেউ। এমন ভাবনাটা কিন্তু পরেও ভাবা যাবে। অন্তত এইচএসসির দায়মুক্তিটা আগে হউক। এই পরীক্ষার্থীরা কিন্তু বেশ মানসিক চাপে আছে। বিষয়টি সরকারের ভাবনায় নেওয়া দরকার।

গত ২৭ জুন বাংলাদেশ (ইরাব) আয়োজিত ‘করোনায় শিক্ষার চ্যালেঞ্জ এবং উত্তরণে করণীয়’ শীর্ষক ভার্চুয়াল সেমিনারে করোনাভাইরাসের জন্য আটকে যাওয়া এইচএসসি পরীক্ষার বিষয় সংখ্যা কমানো এবং কম সময়ে নেওয়ার চিন্তাভাবনা চলছে বলে জানিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি। শিক্ষামন্ত্রী বলেন, এ বছরের এইচএসসির সিলেবাস কমানোর কোনো যৌক্তিকতা নেই। কারণ তারা তো তাদের সিলেবাস সম্পন্ন করেছে। এখন হতে পারে, পাবলিক পরীক্ষা নেওয়া হবে এবং এতে লাখ লাখ পরিবার, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য, প্রশাসনের লোকজন, শিক্ষক-কর্মচারী সবাইকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলব। তাহলে সেটি আমরা কম সময়ে করতে পারি কি না? কমসংখ্যক পরীক্ষা নিতে পারি কি না? আমরা সবকিছুই ভাবছি। পরীক্ষা কবে হবে, তা নিয়ে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, শিক্ষা পরিস্থিতি অনুকূলে আসার ১৫ দিন পর এই পরীক্ষা নেওয়া হবে। কমসংখ্যক পরীক্ষা আর বেশিসংখ্যক পরীক্ষা যেভাবেই নেওয়া হউক শিক্ষার্থী, অভিভাবক, প্রশাসনের লোকজন আর শিক্ষকদের কিন্তু একসঙ্গেই হল থেকে বের হতে হবে। লিখিত পরীক্ষা মানেই কিন্তু ঘর থেকে বের হওয়ার প্রশ্ন আসে। তাতে ঝুঁকিটা কি একই রকম নয়?

আমরা দেখেছি, এ দেশের অধিকাংশ মানুষ নিয়মনীতির খুব একটা তোয়াক্কা করে না। করোনা সংকটকালে সরকার জনগণের স্বাস্থ্য নিরাপত্তার স্বার্থে কিছু নির্দেশনা দিয়েছে। জীবনযাত্রা যাতে একেবারে থমকে না যায়, এজন্য সীমিত আকারে ব্যবসা-বাণিজ্য, গণপরিবহন চলাচল, অফিস আদালত খোলা রাখা হয়েছে। কিন্তু কি দেখছি আমরা? এ দেশে সীমিত আকার বলে কোনো কথা নেই। যে যার মতো চলে। সরকারের নির্দেশনার মানতে চায়না জনগণ। অবাধ এবং যত্রতত্র স্বাস্থ্যবিধি না মেনে চলা যেন অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। এই হচ্ছে আমাদের অবস্থা। এ অবস্থায় শিক্ষার্থীরা পরীক্ষা দিতে গিয়ে কতটা নিরাপদ থাকতে পারবে তা সরকারের ভাবনায় আনা উচিত।

আমাদের দেশের মানুষের স্বাস্থ্যসচেতনতা খুবই কম। তারা অবিবেচকের মতো আচরণ করেন। করোনা গোটা বিশ্ব ব্যবস্থার সকল সামাজিক ব্যবস্থা তছনছ করে দিয়েছে। আমাদের দেশে প্রতিনিয়ত নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধের ঘাটতি প্রকট হয়ে উঠছে। যেখানে সন্তান তার মাকে জঙ্গলে ফেলে যাচ্ছে। বাবা তার করোনা আক্রান্ত সন্তানকে বুকে জড়িয়ে ধরতে পারছে না। এমন পরিস্থিতিতে পরীক্ষার কথা ভাবনায় আনা কতটা যৌক্তিক। এ ছাড়া পরীক্ষার্থীদের পরীক্ষা থেকে দায়মুক্তির বিষয়টিও রয়েছে। এমনতো নয় তাদের কোনো পাঠ গ্রহণ বাদ ছিল। সব প্রস্তুতি শেষে তারা পরীক্ষা দিতে যাবে এ সময়ই করোনা সব কিছু থমকে দিয়েছে। তারা গত দুই বছর পড়াশোনা করেছে, কলেজের পরীক্ষাগুলোতে অংশ নিয়ে উত্তীর্ণও হয়েছে। এ ক্ষেত্রে অটোপ্রমোশন হলে ক্ষতি কী? শিক্ষা মন্ত্রণালয় তথা রাষ্ট্র বিষয়টি নিয়ে ভাববে এই প্রত্যাশা রইল।

লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট ও গবেষক [email protected]

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
সীমিত পরীক্ষা,শিক্ষার্থী,করোনা
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close