সাধন সরকার

  ২৪ জুলাই, ২০২০

অর্থনৈতিক মন্দার মধ্যেও সুসংবাদ

করোনা মহামারিকালে কার্বন নিঃসরণ রেকর্ড পরিমাণ কমেছে। অতি সম্প্রতি অস্ট্রেলিয়ার ইউনিভার্সিটি অব সিডনির একদল বিজ্ঞানীর করা গবেষণার (আন্তর্জাতিক বিজ্ঞানবিষয়ক সাময়িকী ‘প্লস ওয়ানে’ প্রকাশিত) তথ্য এটি। শিল্প-কারখানা বন্ধ, বিমান চলাচল বন্ধ, জ্বালানির ব্যবহার কমে যাওয়ার কারণে বৈশ্বিক কার্বন নির্গমন ৪ দশমিক ৬ শতাংশ কমেছে।

গবেষকরা বলেছেন, এ সময় বিশ্বে সুক্ষ্ম ধূলিকণা দূষণ কমেছে ৩ দশমিক ৮ শতাংশ। অন্য দুই ধরনের বায়ুদূষণ কমেছে ২ দশমিক ৯ শতাংশ। বিশ্বের সর্ববৃহৎ কার্বন নির্গমনকারী দুই দেশ যুক্তরাষ্ট্র ও চীনে রেকর্ড মাত্রায় কার্বন নির্গমন কমেছে। এ থেকে মোটামুটি ধারণা করা যায়, করোনাকালে অর্থনৈতিক মন্দাও কার্বন নিঃসরণে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছে!

প্যারিস জলবায়ু চুক্তি মতে, ২০৫০ সাল নাগাদ বৈশ্বিক উষ্ণায়নের মাত্রা ১ দশমিক ৫ শতাংশের নিচে রাখার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু সেই লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করা কী সম্ভব হবে? যদি করোনাকালের মতো আগামীতেও এমনভাবে কার্বন নিঃসরণ কম রাখা যায় তবুও ওই লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছানো সম্ভব বলে মনে হয় না! প্যারিস জলবায়ু চুক্তির লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছাতে জলবায়ু সংকটের ভয়াবহ প্রভাব থেকে বিশ্বকে বাঁচাতে এবং বৈশ্বিক উষ্ণায়ন সীমিত রাখতে ২০২০ থেকে ২০৩০ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর আরো ৩ শতাংশ করে কার্বন নিঃসরণ কমাতে হবে।

করোনা মহামারির কারণে চলতি বছরের জলবায়ু সম্মেলনও (এ বছর স্কটল্যান্ডের গ্লাসগো শহরে নভেম্বরে হওয়ার কথা ছিল) পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে। ২৬তম জলবায়ু সম্মেলন (কপ-২৬) অনুষ্ঠিত হবে ২০২১ সালের নভেম্বরে। কার্বন নিঃসরণ বেড়ে যাওয়ায় বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ধরিত্রীজুড়েই দাবালন, দাবদাহ, আচমকা ঘূর্ণিঝড় ও খরার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা যাচ্ছে। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি ঠেকাতে প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ২০১৫ সালের প্যারিস জলবায়ু চুক্তির আলোকে একটি রুলবুক বা নির্দেশনা তৈরি এখনো অধরাই রয়ে গেছে। এরই মধ্যে তাপমাত্রা ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে গেছে।

বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন, ২০২১ সালের মধ্যে তাপমাত্রা ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের কাছাকাছি পৌঁছে যেতে পারে! জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, ‘কপ-২৫ সম্মেলন শেষে যে ফল পাওয়া গেল, তাতে আমি হতাশ।’ এর আগেও নিয়ে বলেছিলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের লড়াইয়ে হেরে যাচ্ছে বিশ্ব।’ বাস্তবতাও সে কথা বলছে! কেননা জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব আজ বিশ্বজুড়ে দৃশ্যমান। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) বলছে, দ্রুত জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে পৃথিবীর মানুষ ১০ ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়বে।

তথ্য মতে, গত এক দশকে বরফ গলার হার ৪ গুণ বৃদ্ধি পাওয়ায় সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে পৃথিবীর স্থলভাগ। ফলে জলবায়ু বিপর্যয়ের কারণে যেসব উপকূলীয় দেশ অস্তিত্ব সংকটে রয়েছে সেসব দেশের প্রথম সারিতে রয়েছে বিশ্বের বৃহত্তম বদ্বীপ বাংলাদেশ। সম্প্রতি গবেষণায় উঠে এসেছে, ২০১৯ সালে ‘বৈশ্বিক জলবায়ু ঝুঁকি সূচকে’ বাংলাদেশের অবস্থান নবম। গবেষণায় বলা হয়েছে, ১৯৯৮ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ ৭ নম্বরে। এ সময়ে দেশে প্রায় ৩ কোটি ৭০ লাখ মানুষ প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে প্রত্যেক দেশ কোনো না কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। উপকূলীয় দ্বীপ রাষ্ট্রগুলো সবচেয়ে বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। এর জন্য দায়ী উন্নত দেশগুলোর মাত্রাতিরিক্ত কার্বন নির্গমন।

সম্প্রতি ‘জাতিসংঘ শিশু তহবিল’ (ইউনিসেফ) কর্তৃক প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে ঘূর্ণিঝড়, বন্যাসহ জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগের ঝুঁকিতে রয়েছে বাংলাদেশের প্রায় ২ কোটি শিশু। মানবসৃষ্ট বিভিন্ন কারণে প্রকৃতির স্বাভাবিক বদলে যাওয়ার ধরনও বদলে গেছে। অনেক আগে থেকেই প্রকৃতির আকস্মিক পরিবর্তনের ঝুঁকিতে পড়েছে বিশ্ব। শিল্পবিপ্লব পরবর্তী যুগে উন্নত দেশগুলোর মাত্রাতিরিক্ত জীবাশ্ম জ্বালানির কারণে বৈশ্বিক উষ্ণতার মাত্রা বেড়ে গেছে বহুগুণ। বৈশ্বিক উষ্ণায়নের প্রভাবে ঋতুচক্র বদলে গেছে। হিমবাহের বরফ গলছে, সমুদ্র উত্তপ্ত হচ্ছে, বাড়ছে প্রাকৃতিক দুর্যোগ। দুর্যোগে উপকূলীয় এলাকায় বসবাসরত মানুষের জীবনব্যবস্থা ওলটপালট হয়ে যাচ্ছে। বিভিন্ন দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কৃষি ব্যবস্থা, স্থানচ্যুত হয়ে মানুষ অভিবাসী বা শরণার্থীতে রূপান্তরিত হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের দীর্ঘমেয়াদি প্রভাবে ভুগতে ভুগতে অনেক পরিবার সর্বস্বান্ত হয়ে যাচ্ছে। এসব পরিবার তাদের ও তাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে ব্যর্থ হচ্ছেন। লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হলে পৃথিবীতে ঝড়ঝঞ্ঝা, খরা, বন্যা, অগ্নিকান্ডসহ বিভিন্ন ধরনের আকস্মিক দুর্যোগ আরো বেড়ে যাবে। এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়বে ক্ষুধা, দারিদ্র্য ও সুপেয় পানির সংকট।

সম্প্রতি বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় শত বছরের মহাপরিকল্পনা ‘বাংলাদেশ ডেল্টা প্ল্যান, ২১০০’ বাস্তবায়নে প্রধানমন্ত্রীকে চেয়ারপারসন করে ১২ সদস্যের ‘ডেল্টা গভর্ন্যান্স কাউন্সিল’ গঠন করা হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের সমস্যাকে অভিশাপের বদলে আশীর্বাদে পরিণত করতে এটি একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ। মনে রাখা দরকার, মাত্রাতিরিক্ত তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে দিন দিন বায়ুমন্ডলের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে।

জাতিসংঘের বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থার (ডব্লিউএমও) তথ্য মতে, চলতি শতকে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস থেকে ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে পারে! তাহলে কি জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় একটু একটু করে হেরে যাবে বিশ্ব! সময় দ্রুত ফুরিয়ে আসছে। দেশে দেশে জলবায়ু দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে মানুষ। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে উন্নয়ন টেকসই হচ্ছে না। যাহোক, প্রত্যেক দেশকে নিজস্ব কৌশল অবলম্বন করে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলায় কাজ করে যেতে হবে। উন্নত দেশগুলোর কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায় ও প্রযুক্তিগত সহায়তা পেতে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে এক কাতারে এসে আরো বেশি চাপ তৈরি করতে হবে।

লেখক : পরিবেশকর্মী ও কলামিস্ট

সদস্য, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)

[email protected]

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
সুসংবাদ,অর্থনৈতিক মন্দা,জলবায়ু পরিবর্তন,দূষণ
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close