মেহেদী হাসান

  ৩১ জানুয়ারি, ২০২৩

আধুনিককালের সবচেয়ে ভয়াবহ মাদক এলএসডির প্রভাব

ছবি: সংগৃহীত

আধুনিককালের সবচেয়ে শক্তিশালী ও ভয়াবহ মাদকের একটি এলএসডি (লাইসার্জিক অ্যাসিড ডাইইথ্যালামাইড)। বাংলাদেশে এটির নাম আলোচনায় আসে গত বছরের ১৫ মে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হাফিজুর রহমানের অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনা তদন্তের পর। এই অ্যাসিড এক ধরনের সাইকেডেলিক ওষুধ, যা মনস্তাত্ত্বিক প্রভাবের জন্য পরিচিত। এটি প্রধাণত প্রমোদমূলক ওষুধ হিসেবে এবং আধ্যাত্মিক উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয়। এলএসডি সাধারণত জিভের নিচে রেখে ব্যবহার করা হয়।

সে সময় নিজের গলায় নিজেই দা চালিয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন হাফিজুর রহমান। এই মাদক গ্রহণ করার পরই আত্মহত্যা করেন তিনি। পুলিশের দেওয়া তথ্য মতে, ১৫ মে রাত পৌনে ৮টার দিকে ঢামেকের সামনে এক ডাব বিক্রেতার কাছ থেকে দা নিয়ে নিজের গলা নিজেই কাটেন হাফিজুর। তখন উন্মাদের মতো হাফিজুর বারবার বলছিলেন, ‘আমাকে মাফ করে দাও’। তিনি সেখানেই মারা যান। এরপর হাফিজের বন্ধুসহ বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া তিন তরুণকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের কাছ থেকে এলএসডির ২০০টি ব্লট (মেশানো কাগজ) উদ্ধার করা হয়।

এলএসডির আবিষ্কার :

সুইস রসায়নবিদ আলবার্ট হফম্যানই প্রথম পরিচয় করে দেন এলএসডির সঙ্গে। তিনি মোটেও মাদক হিসেবে ব্যবহারের জন্য এটি আবিষ্কার করেননি। ত্রিশের দশকে এরগট নামক এক ধরনের প্যারাসাইটিক ফাঙ্গাস দমনের কার্যকরী ওষুধ হিসেবে এলএসডি আবিষ্কার করেন হফম্যান।

আসলে তিনি কম রক্তচাপ, মস্তিষ্কের কার্যকারিতা ও শ্বাস-প্রশ্বাস উন্নত করার ওষুধ তৈরির জন্য লাইসার্জিক অ্যাসিড নিয়ে কাজ করছিলেন হফম্যান। তখন হঠাৎ করেই নিজের অজান্তে এলএসডি নামক আধুনিককালের সবচেয়ে শক্তিশালী ও ভয়াবহ ড্রাগের প্রভাব আবিষ্কার করেন হফম্যান।

১৯৩৮ সালে হফম্যান এই মাদক আবিষ্কারের পর এটি বিজ্ঞানী এবং ফিজিশিয়ানদের কাছে কোনো গুরুত্ব পায়নি। ৫ বছর পর, হফম্যান আবার এলএসডি-২৫ নিয়ে কাজ করা শুরু করেন। ২৫ মাইক্রোগ্রাম নিজের জিভে স্পর্শ করালেন। এরপরই তিনি চলে যান স্বপ্নের জগতে।

এর পরের দিন হফম্যান তার জিভে নিলেন ২৫০ মাইক্রোগ্রাম এর প্রায় দশগুণ বেশি। ফলাফল একই ছিল, তবে ঘাবড়ে যান হফম্যান। দ্রুত চিকিৎসককে ডেকে নিজের ব্লাডপ্রেশার, হার্টরেট, শ্বাস-প্রশ্বাস সবই পরীক্ষা করান। সবই ঠিক ছিল।

এরপর হফম্যান সহকর্মীরা সবাই স্বাদ, বর্ণ ও রংহীন সেই সাইকেডেলিক ড্রাগ একে একে টেস্ট করলেন। সবাই এটি ব্যবহারের পরপরিই নতুন এক জগতের দেখা পেলেন। যা চিন্তা-ভাবনাকে মুহূর্তেই প্রভাবিত করতে পারে। এভাবেই আবিষ্কৃত হয় ভয়াবহ মাদক এলএসডি।

বিশেষজ্ঞরা জানান, এই মাদক সেবনের পর মস্তিষ্কে খারাপ এবং ভাল দুটি প্রভাবই কাজ করতে পারে। যখন ভালো দিকটি কাজ করে তখন মানুষ স্বপ্নের জগতে চলে যায়। আর যখন এটির খারাপ প্রভাব কাজ করে তখন মানুষ এক ভয়ংকর অন্ধকার জগতে চলে যায়। যার পরিণামে অনেকে অত্মহত্যাও করেন। তাপমাত্রার সঙ্গেও এর এর প্রভাব জড়িত।

এলএসডি সেবনের অভিজ্ঞতা ও প্রভাব :

এ বিষয়ে আমাদের কথা হয় এলএসডি সেবন করা এক বিদেশপড়ুয়া শিক্ষার্থীর সঙ্গে। যিনি ২০১৮ সালে এটি সেবন করেছিলেন। তিনি আমাদের এই মাদক সেবনের তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা জানান।

তিনি বলেন, একবার তিনি বন্ধুদের সঙ্গে এক্সপেরিমেন্টের জন্য এলএসডি সেবন করেন। এরপর এই মাদক তাকে নিয়ে যায় জীবন মৃত্যুর মাঝখানে। তারা কয়েকজন বন্ধু মিলে একটি পাহাড়ি অঞ্চলে ঘুরতে যান। সঙ্গে নিয়ে যান একটি গাড়ি, যা তারা নিজেরাই ড্রাইভ করছিলেন। এরপর রাতের বলায় তারা প্রত্যেকেই ৫ মাইক্রোগ্রাম করে এলএসডি সেবন করেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সেই শিক্ষার্থী জানান, সেটাই ছিল তার জীবনের প্রথম এবং শেষ এলএসডি সেবন। সেবনের কিছুক্ষণ পরই তাদের মস্তিষ্কে এর প্রভাব পরতে শুরু করে। প্রচণ্ড ভয় হচ্ছিল তাদের। এরপর তারা হোটেলে চলে আসেন। সেসময় তার বন্ধুরা ভয়ে চিৎকার করতে শুরু করেন। হোটেল রুম ভাঙচুর করেন। এক পর্যায়ে তারা সিদ্ধান্ত নেন, তারা এই অবস্থায়ই নিজেদের বাসায় ফিরবেন এবং তৎক্ষণাৎ তারা নেশাগ্রস্থ অবস্থায় গাড়ি নিয়ে বাসার পথে রওনা হন। রাস্তাটি ছিল পাহাড়ি এবং খুবই বিপজ্জনক। এসময় তার এক বন্ধু গাড়ি ড্রাইভ করছিলেন, যিনিও এই মাদক সেবন করেছেন। কিন্তু তার পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল।

তিনি বলেন, এসময় গাড়িতে বাসে থাকা তার বন্ধুদের তার কাছে কার্টুন মনে হচ্ছিল। একসময় তারা গাড়ি থামিয়ে প্রশ্রাব করতে নামেন, তখন তার মনে হচ্ছিল আশপাশের দৈত্য দানব তাকে ধরতে আসছে এবং তিনি রক্ত প্রশ্রাব করছেন। প্রচণ্ড ভয়ে তিনি দৌড়ে গাড়িতে চিলে আসেন। কিছুতেই চোখের পাতা এক করতে পারছিলেন না তিনি। তাদের মধ্যে ২ জনের মনে হচ্ছিলÑ তারা মলত্যাগ করে ফেলেছেন। কিন্তু তারা তা করেননি।

বিদেশপড়ুয়া শিক্ষার্থী আরো বলেন, আশপাশের মানুষকে দৈত্য দানব মনে হচ্ছিল এবং নিজেকে চোর, ডাকাত। মনে হচ্ছিল যে, তারা তাকে ধরে নিয়ে যাবে। একসময় তিনি নিজের মৃত্যু কামনা করেন এবং তওবা করতে থাকেন যদি বেঁচে ফেরেন জীবনে আর কোনোদিন এমন ভুল করবেন না। ১৬ ঘণ্টা পর তিনি সুস্থ হন। এ মাদক এতটাই ভয়াবহ যে তা সেবনের পর ব্যক্তি তার কাছের মানুষকেউ হত্যা করতে পারে।

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
এলএসডি,মাদক
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close