আরমান ভূঁইয়া

  ১০ সেপ্টেম্বর, ২০২১

থামছে না গাড়িচুরি, চালকরা সর্বস্বান্ত

মোতাহার পিকআপচালক। থাকেন যাত্রাবাড়ীর কাজলা নয়ানগর এলাকায়। অনেক কষ্টে জমানো টাকায়কিনেছিলেন টাটা ই-এক্স-টুপিকআপ গাড়ি। প্রতিদিনের মতো ২০ আগস্ট রাত ১০টায় কাজলা নয়ানগর ফাতেমা নাজ পেট্রল পাম্পের ভেতরে গাড়িটি রেখে বাসায় যান তিনি। সকালে এসে দেখেন তার কষ্টের উপার্জনে কেনা গাড়িটি নেই। এ ঘটনায় যাত্রাবাড়ী থানায় মামলা করেন মোতাহার। একই ঘটনা ঘটে আরেক পিকআপচালক কবির মিয়ার সঙ্গেও। ১৬ জুলাই রাত ৩টার দিকে দক্ষিণ যাত্রাবাড়ী নবীনগর এলাকায় বাসার সামনে তার টাটা ই-এক্স-টু পিকআপটি রেখে ঘুমাতে যান। পরদিন সকালে দেখেন গাড়িটি নেই। পরে তিনি যাত্রাবাড়ী থানায় গাড়ি চুরির মামলা করেন। সূত্র মতে, রাজধানীতে রয়েছে শতাধিক গাড়ি চোরচক্র। তারা চুরি করে নেয় গাড়ির আয়ের ওপর নির্ভরশীল গাড়িচালকদের গাড়ি। এতে ওই চালকরা হয়ে পড়েন সর্বস্বান্ত।

এমন গাড়ি চুরির ঘটনা শুধু রাজধানী ঢাকাতেই নয়, ঢাকার বাইরেও ঘটছে। চলতি বছরের ১২ফেব্রুয়ারি টাঙ্গাইলের বাসাইল উপজেলায় নথখোলা গ্রামের একটি বাড়ির সামনে থেকে টয়োটা এক্সজিও মডেলের গাড়িটি চুরি হয়। গাড়ির মালিক বাবুল হোসেনের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তিনি প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, ‘আমি গাড়িটি ভাড়ায় চালাই। প্রতিদিনের মতো সেদিন রাতে বাসার সামনে গাড়ি রাখি। সকালে এসে আর গাড়িটি দেখতে পাইনি। ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে গাড়িটি কিনেছিলাম। পরে বাসাইল থানায় গাড়ি চুরির একটি মামলা করি। গাড়িতে ট্র্যাকিং ডিভাইস ছিল। তারপরও গাড়িটি চুরি হয়ে যায়।’

এভাবে রাজধানীসহ সারা দেশেই প্রতিদিন নানা কায়দায় গাড়ি চুরি হচ্ছে। গাড়িতে ট্র্যাকিং ডিভাইস থাকলেও থেমে নেই চুরি। প্রায় সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে চোরেরা ধরা পড়লেও চক্রের হোতারা রয়ে যায় ধরাছোঁয়ার বাইরে।

সূত্র বলছে, এসব চোরচক্র ধরা পড়ার পর জামিনে বের হয়ে আবার একই কাজে লিপ্ত হয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সূত্রে জানা গেছে, প্রতি মাসে গড়ে অর্ধশতাধিক গাড়ি চুরির ঘটনা ঘটছে। কিছু কিছু গাড়ি উদ্ধার করা গেলেও বেশির ভাগ গাড়ির খোঁজ মেলে না। ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) সদর দপ্তর সূত্র বলছে, এ বছর জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত ১৮০টি গাড়ির চুরির মামলা হয়েছে। আর চক্রের সঙ্গে সম্পৃক্ত ৫৫ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এ সময় প্রাইভেটকার, মাইক্রোবাস, পিকআপ, সিএনজি, বাস, মোটরসাইকেলসহ ৭১টি গাড়ি উদ্ধার করা হয়। আর গতবছরে গাড়ি চুরির মামলা হয় ৩৩২টি। গ্রেপ্তার করা হয় ১৬২ জন গাড়ি চোর ও ছিনতাইকারীকে। সে বছর ৭৭টি প্রাইভেটকার, ৫৪টি পিকআপ, ২৯টি সিএনজিসহ ৩৯৮টি গাড়ি উদ্ধার করা হয়। আর ২০১৯ সালে মামলা হয় ৪১৭টি। গ্রেপ্তার করা হয় ২৬১ জনকে। ওই বছর ১২২টি প্রাইভেটকার, ৫৭টি পিকআপ, ৩৩টি ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যান, ৪০টি সিএনজি, ১৭টি মাইক্রোবাসসহ মোট ৬৫৪টি গাড়ি উদ্ধার করে গোয়েন্দা পুলিশ।

সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, রাজধানীতে অর্ধশতাধিক গাড়ি চোর ও ছিনতাইকারী চক্র সক্রিয় রয়েছে। প্রত্যেক সিন্ডিকেটে ১৫-২০ জন সদস্য বিভিন্ন ভূমিকায় কাজ করে থাকে। বিশেষ করে যাত্রাবাড়ী, চিটাগাং রোড, মোহাম্মদপুর, পল্টন, বিমানবন্দর, উত্তরা, টঙ্গী, গাজীপুর ও সাভার এলাকায় গাড়ি চোর ও ছিনতাইকারী সিন্ডিকেট বেশি তৎপর। এসব চক্রের মূলহোতাদের পরিকল্পনামাফিক গাড়ি চুরি ও ছিনতাই করে থাকে। গাড়ি চুরির পরপরই একস্থানের গাড়ি আরেকস্থানে নিয়ে যাওয়া হয়। বিক্রির জন্য কয়েকটি হাতবদল হয়ে ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় চলে যায় এসব গাড়ি।

পুলিশের এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা জানান, আগে গাড়িচুরি করার পর বিভিন্ন ক্ষুদ্র যন্ত্রাংশ পাল্টানো হতো, নতুন চেসিস লাগানো হতো। গাড়িতে রং পরিবর্তন করে চোরাই গাড়ি বাজারজাত করা হতো। এতে তাদের প্রচুর টাকা খরচ হওয়ায় এখন অনেক চক্র কৌশল পাল্টে আধুনিক প্রযুক্তির পাঞ্চিং মেশিন ব্যবহার করছে। এ মেশিনের মাধ্যমে গাড়ির চেসিস নম্বর তুলে নতুন চেসিস নম্বর বসিয়ে কাগজপত্র তৈরি এবং পরে তা বিক্রি করছে।

জানা যায়, গাড়ি চুরির প্রাথমিক গ্রুপে পাঁচ থেকে ছয়জন কাজ করে। গাড়ি চুরির জন্য তাদের কাছে থাকে মাস্টার চাবি। তারা বিভিন্ন নির্জন এলাকা, মার্কেট, শপিংমল, হাসপাতাল ও রেস্টুরেন্টের মতো ব্যস্ততম এলাকায় ওঁত পেতে থাকে। একজন টার্গেট করা গাড়ির চালক ও মালিকের চলাচল অনুসরণ করে। অন্যজন মাস্টার চাবি দিয়ে গাড়ির লক খুলতে থাকে। অল্প সময়ের মধ্যেই ছিনতাই চক্র লক খুলে গাড়ি নিয়ে হাওয়া হয়ে যায়। আরেকটি গ্রুপ মাইক্রোবাস বা প্রাইভেটকারে যাত্রী বেশে চড়ে কৌশলে গাড়ির ড্রাইভারকে কিছু খাইয়ে অজ্ঞান করে, মারধর বা হত্যা করে গাড়ি নিয়ে পালায়।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের লালবাগ বিভাগের ‘সংঘবদ্ধ অপরাধ ও গাড়ি চুরি প্রতিরোধ’ টিমের সহকারী কমিশনার (এসি) মধুসূদন দাস বলেন, রাজধানীতে বেশ কয়েকটি গাড়ি চুরি চক্র সক্রিয় রয়েছে। চুরির ক্ষেত্রে তারা নিত্যনতুন কৌশল অবলম্বন করছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই চক্রগুলো মাস্টার চাবি দিয়ে গাড়ি চুরি করছে। অনেক সময় ড্রাইভার সেজে, যাত্রী বেশে বা অ্যাসিড দিয়ে গাড়ির লক খুলেও গাড়ি চুরি করছে।

তিনি আরো বলেন, গাড়ি চুরি চক্রের সদস্যদের বেশ কয়েকটি গ্যারেজ মালিক সহযোগিতা করে থাকে। অনেক সময় গাড়ি চুরি করে বিভিন্ন বাসার গ্যারেজে কার পার্কিং ভাড়া নিয়ে গাড়ি রাখে। গাড়ি চুরির পর বিশ্বস্ততা অর্জনে অরিজিনাল কাগজপত্রের মতো হুবহু কাগজপত্র তৈরি করে। অনেক সময় রং, নম্বর প্লেটসহ চেসিস নম্বর পরিবর্তন করা হচ্ছে। এ চক্রের সদস্যরা বেশির ভাগ গাড়ি অনলাইনে বিজ্ঞাপন দিয়ে বিক্রি করে। এই গোয়েন্দা কর্মকর্তা আরো বলেন, যে গাড়ি চুরি করে, সে সরাসরি ভোক্তাকে দেয় না। কয়েকটি হাত ঘুরে ক্রেতার কাছে যাচ্ছে। আমরা প্রায়ই বিশেষ অভিযান চালিয়ে গাড়ি চোরদের গ্রেপ্তার ও গাড়ি উদ্ধার করি। অনেক সময় গাড়ি উদ্ধারের পর মালিককে খুঁজে বের করে গাড়ি বুঝিয়ে দিই। তবে, ড্রাইভারদের অসতর্কতার কারণেই বেশির ভাগ গাড়ি চুরি হয়ে থাকে বলে জানান এই কর্মকর্তা।

গাড়ি চুরি রোধে ট্র্যাকিং ডিভাইস ব্যবহারের পরামর্শ দিয়ে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার এ কে এম হাফিজ আক্তার বলেন, গাড়ি চুরি বা ছিনতাইয়ের ঘটনা আগের চেয়ে কিছুটা কমেছে। গোয়েন্দা পুলিশসহ সারা পুলিশ বিভাগ গাড়ি চুরি রোধে কাজ করে যাচ্ছে। প্রতিনিয়ত রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় অভিযান চালিয়ে চক্রের মূলহোতাসহ সদস্যদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে।

তিনি আরো বলেন, গাড়ি চুরি প্রতিরোধে চালক ও গাড়ির মালিকদের অনেক বেশি সতর্ক হতে হবে। গাড়ির মধ্যে ট্যাকিং ডিভাইসসহ গাড়ি রাখার স্থানে নজরদারি রাখতে হবে। বিশেষ করে, চালক নিয়োগ দেওয়ার আগে ভালোভাবে যাচাই-বাছাই করার পরামর্শ দেন ডিবির এই কর্মকর্তা।

গতমাসের ১১ আগস্ট অভিনব কায়দায় শতাধিক গাড়ি চুরি করা চোরচক্রের ৫ সদস্যকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন। রাজধানীর দারুসসালাম বেড়িবাঁধ এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেপ্তার ও ৪টি পিকআপ, নকল চাবি ও চুরির বিভিন্ন সরঞ্জাম জব্দ করা হয়।

এঘটনার বিবরণ দিতে গিয়ে র‌্যাব-৪-এর অধিনাক মো. মোজাম্মেল হক বলেন, এই চক্রটি অনেক ধূর্ত, তারা গাড়ির ট্র্যাকিং ডিভাইস খুলে গাড়ি নির্জন স্থানে নিয়ে রাখত। চক্রটি গাড়ি চুরি করে গাড়ির কালার, বডি ও নম্বর প্লেট পরিবর্তন করে কম দামে বিভিন্ন ব্যক্তি ও শোরুমে বিক্রি করে দিত। এ ছাড়াচুরি করা গাড়ির মালিককে ফোন করে বিকাশের মাধ্যমে টাকা আদায় করে অজ্ঞাতস্থানে গাড়ি রেখে আসত।

কীভাবে গাড়ি চুরি থেকে বিক্রি! র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, গাড়ি চোর ও ছিনতাই চক্রের সদস্যরা কয়েকটি ভাগে ভাগ হয়ে কাজ করে। প্রথম দলের সদস্যরা গাড়ি সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করে। গাড়ি পার্কিং, গতিবিধি, চালক ও মালিক সম্পর্কে তারা তথ্য সংগ্রহ করে। দ্বিতীয় দলটি চক্রের মূলহোতার নির্দেশনায় গাড়ি ছিনতাই বা চুরি করে। চক্রে থাকে অভিজ্ঞ চালক ও মেকানিক। কখনো কখনো তারা চালকদের অর্থের প্রলোভন দেখিয়ে ছিনতাইয়ের নাটক সাজায়। তৃতীয় দলটি চোরাই গাড়ি গ্রহণ করার পর লুকিয়ে রাখে। অনেক সময় গাড়ির মালিকের সঙ্গে যোগাযোগ করে টাকার বিনিময়ে গাড়ি ফেরত দেয়। এ ক্ষেত্রে অনেক সময় টাকা নেওয়ার পরও গাড়ি ফেরত দেয় না চক্রের সদস্যরা। চক্রে চতুর্থ দলটি গাড়ি চুরি বা ছিনতাইয়ের কয়েক দিন পর তাদের নির্দিষ্ট ওয়ার্কশপে নিয়ে গাড়ির রং, যন্ত্রাংশ, ইঞ্জিন ও চেসিস পরিবর্তন করে। এছাড়া এক চোরাই গাড়ির যন্ত্রাংশ, অন্যটিতে স্থাপন এবং ভুয়া রেজিস্ট্রেশন নম্বর প্লেট তৈরি করে। পঞ্চম দলে মূল সমন্বয়ক নিজেই ভূমিকা পালন করে। কয়েকজন সহযোগীকে দিয়ে ভুয়া কাগজপত্র তৈরিতে কাজ করে। বিভিন্ন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের নাম যুক্ত করে ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে। গাড়িগুলো বিক্রি না হওয়া পর্যন্ত ভাড়ায় চালায় এবং মাদক পরিবহন কাজেও ব্যবহার করা হয়।

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
সর্বস্বান্ত,গাড়িচুরি,ভুয়া কাগজ
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close