বাবার বিকৃত লালসার শিকার ২ মেয়ে এখন আদালতে
পৃথিবীতে একজন মেয়ের কাছে একমাত্র বাবাই যেখানে ভরসাস্থল হওয়ার কথা সেখানে বাবার কারণেই এখন সবচেয়ে অনিরাপদ দুই বোন। শুধু তাই নয়, নিজেরদের নিরাপত্তার জন্য বাবার বিরুদ্ধে মামলাও করেন তারা। কিন্তু তাতেও কোনো কাজ হয়নি। বরং দুই বোনকেই এখন আদালতে নিয়মিত হাজির হতে হচ্ছে।
রাজধানী তেজগাঁওয়ের পূর্ব রাজারবাজার এলাকার ওমর ফারুক পেশায় একজন দলিল লেখক। মেয়েরা যখন শিশু তখনই মা-বাবার বিচ্ছেদ ঘটে। এরপর মায়ের কাছে নানাবাড়িতে বড় হয় দুই মেয়ে। আত্মীয়দের দেয়া সহযোগিতায় দুই মেয়ের পড়াশোনা চালিয়েছেন মা।
স্কুল-কলেজের গণ্ডি পেরিয়ে এখন একজন পড়ছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে। অন্যজন ইংরেজিতে অনার্স পড়ছে। পড়ার তাগিদে বাধ্য হয়ে বাবার নতুন সংসারে ওঠেন তারা।
স্ত্রীর সঙ্গে বিচ্ছেদ সত্ত্বেও মাঝে মাঝে নোয়াখালীতে গিয়ে দুই মেয়েকে কিছু টাকা দিয়ে আসতেন ওমর ফারুক। বিশ্ববিদ্যালয়ে ওঠার পর দুই বোন রাজধানীর ফার্মগেটের একটি বাসায় বাড়া থাকতে শুরু করে। এসময় বাবার সঙ্গে যোগাযোগ ছিল তাদের। পড়াশোনার খরচ চালাবেন বলে ২০২০ সালের লকডাউনের মধ্যে দুই মেয়েকে নিজ বাসায় উঠতে বলেন ওমর ফারুক। একই বছরের আগস্টে সৎ মায়ের সংসারে আশ্রয় নেয় ওমর ফারুকের দুই মেয়ে।
বাবার নতুন সংসারে প্রথম কয়েকদিন খুব স্বাচ্ছ্যন্দেই কাটছিল দুই বোনের। কিছুদিন যেতেই বাবার আচরণ দুই বোনের কাছে আপত্তিকর ঠেকতে থাকে। দুই বোনের অভিযোগ- ওমর ফারুক তার মোবাইলে লাউডস্পিকার দিয়ে পর্নো ভিডিও দেখতেন এবং তাদের অনৈতিক ইশারা-ইঙ্গিত করতেন। তাই বাধ্য হয়েই বাবাকে সতর্ক করেন বড় মেয়ে। জবাবে ওমর ফারুক তার বড় মেয়েকে বলেন- ‘তোরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িস আর এসব বুঝিস না?’
এসব ঘটনা দুই বোন তাদের ফুপুদের জানায়। তারা বিষয়টি সহ্য করতে এবং পরে সব মিটমাট হবে বলে আশ্বাস দেন তারা। তাই নিজের মাকেও কিছু জানায়নি দুই বোন।
এদিকে ২০২০ সালের ২৩ নভেম্বর বড় মেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সেমিস্টার ফি চাইলে ওমর ফারুক জানান, আমি যে টাকা দেবো, তাতে আমার লাভ কী? তোমরা আমার কাছে আসো, আমি সব দেবো।
এরপর ওমর ফারুক তার বড় মেয়েকে বলে, আমার সঙ্গে ফ্রি হও, যা করতে বলি তাই করো, তোমার কোনও অভাব রাখবো না। তোমার নামে ফ্লাট লিখে দেবো। কাছে না আসলে কিছুই দিতে পারবো না।
ঘটনার শিকার ছোট বোন বলেন, বাবা হয়েও কিভাবে এসব কথা বলতে পারে! তার কথা শোনার পর বড় আপা আত্মহত্যা করতে গিয়েছিল একবার। আমি তাকে রক্ষা করতে গিয়ে সব জানতে পারি। এরপর তাকে পুলিশের ভয় দেখালে কয়েকদিন আপাকে আর বিরক্ত করেনি।
সেদিনের ঘটনার কয়েকদিন পর ওমর ফারুক আবার বলেন, তোর মায়ের সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। তাই তোরা আমার জন্য বৈধ।
বড় বোন বলেন, ততদিনে ফুপুরাও আমাদের বিরুদ্ধে চলে যাচ্ছিলেন। তার সঙ্গে মিলিয়ে আমাদের নিয়ে অনেক কুৎসাও তারা রটিয়েছেন। এসব কথা বললেও কেউ বিশ্বাস করবে না জানি। তাই শেষ দিকে তার কিছু অনৈতিক আচরণের কথা রেকর্ড করেছি। যা প্রমাণ হিসেবে আমাদের কাছে আছে। ফুপারা কিন্তু অনেক ভালো। কিন্তু কাউকে কিছু জানাতে দেয়নি ফুপুরা।
ঘটনার মীমাংসার কথা বলে বাবা আর আমাদের নিয়ে দরজা বন্ধ করে আলোচনাও করেছেন তারা। তখন বাবা বলেছে, আমরা নাকি তার সম্পত্তি নেয়ার পরিকল্পনা করে এখানে এসেছি। এ কথা বলে কয়েকবার মারতেও এসেছে।
তখন ফুপুরা বলেছে- ভাই, দোষ আপনার না, ওদেরও না। দোষ হলো শয়তানের। এরপর জোর করে আমাদের দুই বোনের কাছ থেকে সাদা কাগজে সই নেন তারা। সবার আচরণ দেখে প্রচণ্ড মানসিক যন্ত্রণায় ভুগছিলাম। তাই বাধ্য হয়ে সেদিন দুই বোন ওই বাসা থেকে বেরিয়ে আবার ভাড়া বাসায় থাকতে শুরু করি।
বাসা থেকে বেরিয়েও নিস্তার মেলেনি। ২০২০ সালের ১০ ডিসেম্বর ওমর ফারুক প্রায় রাত ১২টার সময় বড় মেয়েকে ফোন করে বলেন, ‘আমাকে কিছু দিলি না। এখন বাঁচবি কী করে?
ফলে নিজেদের নিরাপত্তার কথা ভেবে মাকে সব খুলে বলে দুই বোন। এরপর নিজেদের নিরাপত্তা ও দৈনন্দিন ব্যয়ভার গোছাতে না পেরে আশ্রয় নেন এক নিকটাত্মীয়ের বাসায়। একইসঙ্গে ফোনে পাওয়া হুমকি, লোকলজ্জা, আর্থিক, যৌন ও মানসিক অত্যাচারের শিকার দুই বোন আদালতের দ্বারস্থ হন। বড়বোন ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে পারিবারিক সুরক্ষা আইনে ওমর ফারুকের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন।
মামলায় দুই বোনের ভরণপোষণের খরচ প্রদানের পাশাপাশি ওমর ফারুক যেন তাদের মানসিক ও যৌন অত্যাচার এবং অশ্লীল প্রস্তাব দিতে না পারে সেজন্য তার গ্রেপ্তার চেয়ে আদালতের কাছে আরজি জানানো হয়।
দুই বোনের আইনজীবী বলেন, মামলা দায়েরের পর ওমর ফারুককে শোকজ করেছেন আদালত। কিন্তু কয়েকদফা তারিখ পড়লেও এখন পর্যন্ত তিনি আদালতে হাজির হননি। উক্ত আইনের বিধান অনুসারে সর্বোচ্চ ৭ দিনের মধ্যে মামলার তারিখ নির্ধারণ করতে হয়। অথচ আইনের সুস্পষ্ট বিধান সত্ত্বেও আদালত কোনোরকম অন্তর্বর্তীকালীন আদেশ না দিয়ে মামলাটি শুনতে দীর্ঘদিন পরপর দিন নির্ধারণ করছেন। তাই মেয়ে দুটোকেও নিরুপায় হয়ে বারবার আদালতে হাজির হতে হচ্ছে।
ঘটনা সম্পর্কে জানতে ওমর ফারুকের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। কয়েকবার ফোন করা হলেও তিনি কল রিসিভ করেননি।