নিজস্ব প্রতিবেদক

  ০৫ নভেম্বর, ২০২২

সম্ভাবনাময় ফেসবুক কমার্স, প্রয়োজন সুষ্ঠু অবকাঠামো : তরুণ উদ্যোক্তা সাইম

দাঁড়কাক-এর প্রধান নির্বাহী (সিইও) আবু ওবায়দা সাইম। ছবি : প্রতিদিনের সংবাদ

ছোটবেলা থেকেই স্বপ্ন ছিলো বড় কিছু করার। মধ্যবিত্ত পরিবারের অনেক সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও আমার স্বপ্নকে কখনো সীমাবদ্ধ করে রাখিনি। ক্লাস নাইনে থাকতে এক বড় ভাইয়ের সাথে আলোচনার মাধ্যমে অনলাইন ব্যবসার প্রতি আগ্রহ তৈরি হয়। তখন যেহেতু ভার্চুয়াল জগৎ ধীরে ধীরে জায়গা করে নিচ্ছিল আমাদের জীবনে। তাই চিন্তা করলাম এমন যদি কোনো ব্যবসা করা যায় যেটি নেটে ব্রাউজ করা যাবে এবং ব্যবসাও হবে তাহলে তো ভালোই হয়। সেখান থেকেই মূলত শুরু। তবে স্বপ্ন পূরণের পথ কখনো সহজ হয় না। বারবার ব্যর্থ হয়েছি, হয়েছি উপহাসের পাত্র। কিন্তু আমার সাফল্যের কাছে সেগুলো টিকেনি। তারপর আল্লাহর উপর ভরসা রেখে নিজেকে প্রমাণ করার পথে এগিয়ে গিয়েছি।

সাবলীলভাবে কথাগুলো বললেন, ফেসবুকভিত্তিক কমার্স (এফ কমার্স)-এর জেন্টস ফ্যাশন টি-সার্টের বৃহৎ অনলাইন মার্কেট প্লেস ‘দাঁড়কাক’(Daar-Kak)-এর প্রধান নির্বাহী (সিইও) আবু ওবায়দা সাইম। শিক্ষাজীবন শেষ হওয়ার আগেই উদ্যোক্তা হয়ে উঠা তরুণ এখন অনেকের-ই আদর্শ। নিজে চাকুরি মুখাপেক্ষী না হয়ে করেছেন বেকার তরুণ-তরুণীদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা। অফিস ও কারখানা মিলে বর্তমানে তার প্রতিষ্ঠানে ১২০ জন তরুণ-তরুণী কর্মরত আছেন।

জন্ম ঢাকার মিরপুরে। বাবার চাকরির সুবাদে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে থাকতে হয়েছে তাকে। খুব ছোটবেলায় সাতক্ষীরায় ছিলেন। এরপর সিলেট, সাভার, দিনাজপুর এবং পরবর্তীতে ক্লাস ফাইভের পর আবার ঢাকার মিরপুরে চলে আসেন। এরপর ক্লাস ফাইভ থেকে টেন পর্যন্ত মিরপুর বাংলা স্কুল এন্ড কলেজে এসএসসি এবং শহীদ রমিজউদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করেন। বর্তমানে তিনি বিজিএমইএ ইউনিভার্সিটি অব ফ্যাশন অ্যান্ড টেকনোলজিতে ‘টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে বিএসসি অনার্স শেষ সেমিস্টারে পড়াশুনা করছেন।

কারখানায় কর্মরত শ্রমিক।

ধীরে ধীরে উদ্যোক্তা হয়ে উঠা সর্ম্পকে তিনি জানান, ২০১৮ সালে ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হলাম। তখন মাথায় কাজ করতো যে কিছু একটা করতে হবে। চাকুরি করার তেমন ইচ্ছা ছিল না। ব্যবসার দিকে ঝোঁক ছিল বেশি। যদিও সেই সময় আমি একটি কল সেন্টারে চাকরি নিয়েছিলাম কিন্তু কোনো সুযোগ পাচ্ছিলাম না। তখন কিছু সহকর্মী আমাকে পরামর্শ দিলেন ব্যবসাতে মন দিতে, কারণ রাতে কল সেন্টারে কাজ করে সকালে ক্লাস আর পড়াশুনা হয়ে উঠছিল না। এরপর ইউনিভার্সিটির এক বড় ভাইয়ের সাথে কথা হয় এবং তার সাথে আমার ব্যবসায়িক চিন্তাগুলো শেয়ার করি। উনিও পরামর্শ দেন ব্যবসায় মনোযোগ বাড়ানোর জন্য। তারই দেওয়া নামে শুরু হয় ‘দাঁড়কাক’। এভাবেই ‘দাঁড়কাক’এর যাত্রা।

‘দাঁড়কাক’ প্রতিষ্ঠার শুরুর কথা জানতে চাইলে তরুণ এ উদ্যোক্তা জানান, ক্লাস নাইন থেকে দীর্ঘ সময় ধরে চলছে আমার যাত্রা। পড়াশুনার পাশাপাশি ব্যবসা, এ দুটো জিনিসকে একসাথে চালিয়ে নিতে বেশ চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয়েছে। এর আগে আমার বেশ কিছু অনলাইন পেইজ ছিল। বেশ কিছু পেইজের মাধ্যমে আমি রিসেলিং করেছি। তারপর নিজের প্রডাকশন থেকে সেল করেছি। শপআপ-এর মতো কোম্পানির সাথেও আমি রিসেলিং করেছি। বেশ ভালোই লাভ হচ্ছিল সেই পেইজগুলো থেকে। মূলত ২০১৩ থেকে প্রডাকশন করে অথবা রিসেলিং করে অনেক কাজ করেছি। তবে এই কাজগুলো তখন গুছিয়ে করতে পারিনি। এছাড়াও আমার আরও দুইটি পেইজ ছিল ‘ড্রিমহাউজ’ আর ‘ডুশপ’ নামে। সেগুলোতে অডিয়েন্স এনগেইজমেন্টও ভালো ছিল। কিন্তু ফেসবুক অ্যালগোরিদমের কারণে পেইজগুলো হারাতে হয়। তবে আমরা হাল ছেড়ে না দিয়ে ‘দাঁড়কাক’ নিয়ে নেমে পড়ি।

দাঁড়কাক-এর কো-ফাউন্ডার জোবায়েদ হাসান রিফাত।

তিনি আরো জানান, ২০১৯ সালের শেষ দিকে বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারি শুরু হলে মানুষের জীবনযাত্রা থমকে পড়ে। ব্যবসা বাণিজ্যসহ সবকিছুতে এর ধাক্কা লাগে। এরপর দেশজুড়ে শুরু হয় লকডাউন। মূলত সে সময়টাই ভাবনার জগতে বাঁক বদল হয়। শুরু হলো জোর কদমে এগিয়ে চলা। সে সময় বন্ধু ‘জোবায়েদ হাসান রিফাত’ আমার এ যাত্রার সঙ্গী হয়। তার সহযোগিতায় এবং আমাদের দুই জনের অক্লান্ত প্রচেস্টায় ব্যবসার প্রসারের জন্য লেগে পড়ি। যার অনুপস্থিতি আজকের এই ক্রমবর্ধমান ‘দাঁড়কাক’ এর অগ্রযাত্রা কোনভাবেই সম্ভবপর ছিলো না। ‘দাঁড়কাক’এর অপারেনশন, অপারেটরদেরকে মনিটরিং করা, ডেইলি সেলস্ বৃদ্ধি করাসহ নানা ধরনের জটিল কাজ সমাধান করছে রিফাত। বর্তমানে তিনি ‘দাঁড়কাক’ এর চিফ অপারটিং অফিসার হিসেবে নিয়োজিত আছেন এবং একইসাথে ‘দাঁড়কাক’এর একজন কো-ফাউন্ডার। তার লিডারশিপ সত্যি প্রশংসনীয়। আর এভাবেই স্বপ্নকে বাস্তবে নিয়ে আসতে আমরা দিন-রাত কাজ করছি। প্রতিষ্ঠানকে বর্তমান জায়গায় নিয়ে আসার পেছনে তার অবদান সবথেকে বেশি। এছাড়াও ‘দাঁড়কাক’কে এ পর্যায়ে নিয়ে আসতে অনেক বন্ধু শুভাকাঙ্ক্ষী; রাজন, শোভন, অপি, সোয়াইবসহ বেশ ক’জনের অবদান অনস্বীকার্য। তাদের বুদ্ধি পরামর্শ ও সহচর্য্যই আজকে ‘দাঁড়কাক’ একটি ব্রান্ড হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে।

অনলাইন ব্যবসার প্রতিবন্ধকতা ও সম্ভাবনা সম্পর্কে তিনি জানান, অনলাইন ব্যবসার বেশ কিছু প্রতিবন্ধকতা আছে। প্রথমত, ফেসবুক কমার্স বা (এফ কমার্স)-এর জন্য আইনগত ডকুমেন্টস করার ইচ্ছা সবার মাঝে নেই। দ্বিতীয়ত, এফ কমার্সে ব্যবসা করা ঝুঁকিপূর্ণ, কারণ ফেসবুকে বিভিন্ন সময় অ্যালগোরিদম আপডেট হয় এবং তারা বিভিন্ন বিধিনিষেধ আরোপ করে। এতে পেইজ হারানোসহ আরও নানা ইস্যু তৈরি হতে পারে। কোন কনটেন্টে ফেসবুক থেকে বিধিনিষেধ আসতে পারে বা কোন কনটেন্টে অর্গানিক রিচ ভালো হবে এগুলো নিয়ে ভালো জানাশুনা থাকা দরকার।

তিনি জানান, আরও বড় চ্যালেঞ্জ হলো, যারা ফেসবুকে ব্যবসা করছেন, তাদের পেইজে যদি কোনো সমস্যা হয় তাহলে পেইজ উদ্ধারসহ অন্যান্য ব্যাপার নিয়ে অনেক ধোঁয়াশাতে থাকতে হয়। এক্ষেত্রে যদি বাংলাদেশ সরকারের আইটি মন্ত্রণালয় থেকে কোনো গাইডলাইন বা সিস্টেম তৈরি করে তাহলে এফ কমার্স ব্যবসায়ীদের সুবিধা হয়। কারণ এখন এফ কমার্সের সম্ভাবনা অনেক। আইনি ডকুমেন্টস সঠিকভাবে ব্যবহার করে এফ কমার্সের জন্য সুষ্ঠ অবকাঠামো থাকলে আরও অনেক দূর এগিয়ে যাবে এই সেক্টর।

দাঁড়কাকের গ্রাহক কারা, সংখ্যা, ব্যবসা পরিচালনা পদ্ধতি বিষয়ে তিনি জানান, ‘দাঁড়কাক’ মূলত পুরুষদের পোশাক নিয়ে কাজ করে। তবে আমাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা আছে সব ধরনের ফ্যাশন আইটেম নিয়ে কাজ করার। গ্রাহক সেবার কথা যদি বলি তাহলে বলবো আমরা এখন পর্যন্ত দেড় লাখেরও বেশি রিটেইল প্রোডাক্ট সেল করেছি। বর্তমানে ঢাকার ভিতরে যদি ৫০০ মানুষের কোনো সভা বা সমাবেশ হয়, তাহলে আপনি অবশ্যই ‘দাঁড়কাক’এর টি-শার্ট বা পোলো শার্ট পরিহিত ৫ থেকে ৬ জন মানুষ খুঁজে পাবেন। আপনি যদি ৩০টি ক্লোদিং এফ কমার্সের নামের তালিকা করেন তাহলে ‘দাঁড়কাক’ থাকবে তাদের মধ্যে অন্যতম। আমাদের নিয়মিত গ্রাহকদের সংখ্যাই বেশি। কারণ আমরা দেখেছি কেউ একবার আমাদের প্রোডাক্ট ব্যবহার করে এরপর আরও বেশি বেশি প্রোডাক্ট নিয়েছেন।

ক্লায়েন্টদের সঙ্গে যোগাযোগে ব্যস্ত কর্মীরা।

আর ব্যবসা পদ্ধতি বলতে এতদিন আমরা এফ কমার্স করেছি। আমরা সমগ্র বাংলাদেশে ক্যাশ-অন হোম ডেলিভারিতে গ্রাহকের ঠিকানায় প্রোডাক্ট পাঠিয়ে থাকি। গ্রাহক প্রোডাক্ট হাতে পেয়ে মান যাচাই করে প্রোডাক্ট নিয়ে থাকে। খুব শীঘ্রই আমরা ই-কমার্সে চলে আসছি এবং খুব ভালোভাবে আমাদের ওয়েবসাইট তৈরি করেছি। ইনশাআল্লাহ আমাদের গ্রাহকদের কাঙ্খিত সেবা দিতে পারবো।

দাঁড়কাকের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য প্রসঙ্গে প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী বলেন, আমাদের লক্ষ্য গ্রাহকদের সবচেয়ে সেরা কোয়ালিটির প্রোডাক্ট এবং সার্ভিস দেওয়া। প্রোডাক্টের কোয়ালিটি নিয়ে আমি কোনো আপোস করি না। তাই আমাদের গ্রাহকদের মাঝেও আমরা সেই সন্তুষ্টি বজায় রাখতে চাই। আমাদের উদ্দেশ্য বাংলাদেশে অনলাইন ব্যবসার জন্য একটি সুন্দর পরিবেশ গড়ে তোলা এবং সেইসাথে বেকার সমস্যা দূর করতে কাজ করা। এন্ট্রাপ্রেনার তৈরিতে এবং নতুন নতুন মানুষকে সাহায্য করার মধ্য দিয়েই এতদূর আমাদের যাত্রা। সরকারের সাহায্য পেলে আমরা এই অংশে আরো জোর দিতে পারবো।

তরুণ উদ্যোক্তাদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, আসলে আমি নিজেই একজন তরুণ। তবে আমার বয়সী বা যারা এফ কমার্স বা ই-কমার্সে ব্যবসা করতে চান, তাদের বলবো দুইটি জিনিস মাথায় রাখতে। এক, আপনি যা-ই করেন, তাতে আপনি মজা পাচ্ছেন কী না, আর দুই, সেই কাজের প্রতি আপনার প্যাশন আছে কী না। আপনি যদি কোনো কাজ করে মজা না পান এবং কোনো দায়বদ্ধতার কারণে কাজটি করে থাকেন তাহলে আপনার সেই সন্তুষ্টির হাসি থাকবে না, সে কাজে আপনি যত টাকাই পান না কেন। এতে করে একটা সময় সেই কাজে আপনিই বিরক্তি বোধ করবেন। যা-ই করেন না কেন, সততার সঙ্গে আপনার প্যাশনকে কাজে লাগান। প্যাশনকে যদি প্রফেশনে রূপ দিতে পারেন এর থেকে বড় পাওয়া হয়তোবা আর কিছু হয় না এবং এমন মানুষ জীবনে সফল হবেই।

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
ফেসবুক কমার্স,সুষ্ঠু অবকাঠামো,দাঁড়কাক
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close