ডা. এস এ মালেক

  ১৫ আগস্ট, ২০২০

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড ছিল মহা-আন্তর্জাতিক চক্রান্ত

বঙ্গবন্ধুর অস্বাভাবিক ও আকস্মিক হত্যাকাণ্ডে যারা হতভম্ব এবং কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়েছিলেন বলে তাৎক্ষণিকভাবে কোনো কিছু করতে পারেননি বা করার চেষ্টাও করেননি; তাদের কাছে জিজ্ঞাস্য—আসলে কি ওই হত্যাকাণ্ড একটা চরম অপ্রত্যাশিত ঘটনা ছিল? বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধকে যারা ভারত ও পাকিস্তানের ভেতরকার দ্বন্দ্ব বা পূর্ববাংলার জনগণ কর্তৃক মুক্তির সংগ্রাম বলে মনে করেন, তাদের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে বলতে হয়, আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে একটা পর্যায়ে আন্তর্জাতিক মহাশক্তিবলয় প্রত্যক্ষভাবে না হলেও পরোক্ষভাবে জড়িয়ে পড়ে। যারা বলেন, ভারত তার রাজনৈতিক স্বার্থে পাকিস্তান বিভক্তির কাজটি ত্বরান্বিত করার জন্য বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সাহায্য করে বাংলাদেশ স্বাধীন করেছে। তাদের কাছে জিজ্ঞাস্যবঙ্গবন্ধু যদি ২৩ বছরের সংগ্রামের পর ৭০-এর নির্বাচনে একচ্ছত্রভাবে বিজয়ী হয়ে এমন অবস্থান সৃষ্টি করতে না পারতেন, তাহলে বাংলাদেশের জনপ্রতিনিধিরা কি ভারতে গিয়ে সরকার গঠনে চিন্তা করতে পারত? ২৬ মার্চ যদি পাকিস্তান হানাদার বাহিনী কর্তৃক বাংলাদেশ আক্রান্ত না হতো, বঙ্গবন্ধুকে যদি ওইভাবে গ্রেফতার করে পাকিস্তানে নিয়ে না যেত, তাহলে কি ভারতীয় সৈন্য বাংলাদেশে প্রবেশ করতে পারত।

আসলে বঙ্গবন্ধু এমন এক বাস্তব পরিস্থিতির সৃষ্টি করলেন, যার কারণে ভারতীয় সরকারের পক্ষে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে সামরিক সমর্থন দেওয়া সম্ভবপর হয়েছিল। তা ছাড়া এক কোটি শরণার্থী অতি স্বল্প সময়ে ভারতে আশ্রয় দেওয়া, বাংলাদেশকে মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ী করা ভারতের জন্য অত্যাবশকীয় হয়ে দাঁড়াল। তবে এ কথা ঠিক ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীসহ অনেকেই নৈতিক ও মানবিক কারণে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন জুগিয়েছিলেন। রাজনৈতিকভাবে ভারত তখন নেহরু পরিবার কর্তৃক শাসিত। যে পরিবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবকে সুনজরে দেখেননি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কোনো সামরিক মিত্রতা তৈরি নয়; বরং জোটনিরপেক্ষ সংস্থার প্রতি পণ্ডিত জহরলাল নেহরু বিশ্বব্যাপী যে জটিল রাজনৈতিক সমীকরণ বিদ্যমান ছিল, তার প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন জোগান। এই জোটনিরপেক্ষ সংগঠন ছিল উপনিশবাদী ও সাম্রাজ্যবাদীর বিরুদ্ধের শক্তিশালী সাম্রাজ্যবাদী দেশ তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে বন্ধুত্ব ছিল সুদৃঢ়। তবে পূর্ব ইউরোপের দেশসমূহের মতো ভারত জড়িয়ে পড়েনি। নিরাপত্তার খাতিরে সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে শিল্প, বাণিজ্য ও প্রতিরক্ষা বিষয়াদিতে ভারতের সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত স্বাভাবিক। পাকিস্তান প্রথমে বাগদাদ ও পরে সেন্ট্রো মার্কিস সাম্রাজ্যবাদে জড়িয়ে পড়ে। মহাচীন বিশ্ব রাজনীতির প্রেক্ষাপটে নিজস্ব স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে পড়ে।

আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের পেছনে যারা মদদ দিয়েছিল, সেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও মহাচীন পাকিস্তানকে সমর্থন করায় সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ভারতীয় সমর্থন আমাদের কাছে চলে আসে। যখন যুক্তরাষ্ট্র সপ্তম নৌবহর পাঠিয়ে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ নস্যাৎ করতে চেয়েছিল, তখন সোভিয়েত ইউনিয়ন জাতিসংঘে ভেটো দিয়ে, তা বন্ধ করে দেয়। শুধু তা-ই নয়, স্বাধীন বাংলাদেশ পুনর্গঠনে সোভিয়েত ইউনিয়নের অবস্থান ছিল ভারতের পরই। ভারতের স্বার্থসংশ্লিষ্ট কথা বিবেচনায় না নিলেও ভারতীয় সহযোগিতা বিশেষ করে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সমর্থন বাংলাদেশের বিজয়কে ত্বরান্বিত করে। তাই শুধু উপ-মহাদেশের সামরিক ভারসাম্য বদলে দেওয়ার জন্য ভারত মুক্তিযুদ্ধে সহযোগিতা করেছিল, এ কথা ঠিক নয়। বিশেষ করে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাংলাদেশ পুনর্গঠনে ভারতের অবদান অবিস্মরণীয়। সে কারণেই ভারত বাংলাদেশ দাবি করতে পারে, তাদের বন্ধুত্ব ঐতিহাসিক প্রয়োজনেই সৃষ্টি হয়েছিল। কালের পরিবর্তনে মহাচীন যে আমাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল, তারা এখন নানা ক্ষেত্রে বাংলাদেশের উন্নয়নের সহযোগী। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক খারাপ নয়। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে বিভিন্ন দেশের পারস্পারিক সম্পর্ক কোনো চিরস্থায়ী নয়। যুদ্ধ, বিভিন্ন রাজনৈতিক ধাপ প্রতিধাপের পর বিশেষ করে অর্থনৈতিক কারণে পারস্পরিক পরিবর্তন আসতে পারে। তবে কোনো দেশের সঙ্গে বিশেষ সম্পর্ক উন্নয়নের কারণে অন্য দেশের প্রতি উদাসীন হওয়া কূটনৈতিক বিবেচনায় অনৈতিক।

মূল প্রসঙ্গ যে, আমাদের মুক্তিযুদ্ধ পরোক্ষভাবে হলেও আন্তর্জাতিক মহাশক্তির স্বার্থের সঙ্গে সম্পর্কিত হওয়ার কারণে দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও ওই মহাশক্তির স্বার্থ দুর্যোগের ঘনঘটা সৃষ্টি করে। ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের পর থেকে আজও আমরা সে দুর্যোগ থেকে রেহাই পাইনি। একবার ভেবে দেখুন তো, যে প্রায় ৫০ বছর অতিক্রম হওয়ার পরও বাঙালি জাতির পিতার হত্যাকারীরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার মতো দেশে নিরাপদ আশ্রয়ে বসবাস করছে। ওইসব সভ্য দেশের প্রচলিত আইন নাকি খুনিদের বাংলাদেশে ফেরত পাঠাতে বাধা হয়েছে। এই যদি বিশ্ব গণতন্ত্র হয় আর এ ব্যাপারে যদি জাতিসংঘের কিছু করার না থাকে, তাহলে এই বিশ্ব হত্যা ও সন্ত্রাসী রাজনীতি থেকে মুক্তি পাবে কী করে। এই বিশ্বে অনেক নেতা আছে, যাদের পক্ষে অতীতকে ভুলে বর্তমানে সুস্থ মানবতাবাদী রাজনীতিতে অভ্যস্ত হওয়া সম্ভব নয়। ১৯৭৫-এর পর থেকে আজ পর্যন্ত গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত অনেক সুদক্ষ আমেরিকান প্রেসিডেন্টের পক্ষেও খুনিদের এই আশ্রয় দেওয়ার ব্যাপারে কোনো কথা বলতে শুনিনি। এ ব্যাপারে বাংলাদেশের সীমাবদ্ধতার কথা আমরা অবশ্যই জানি। যারা বিশ্ব রাজনীতিতে এই আগস্ট মাসে এই ব্যাপারটা কীভাবে দেখবেন।

আসলে ৭৫-এর বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড ছিল একটা প্রতিবিপ্লব। যারা ৭১-এ বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে ছিলেন, তারাই দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় বঙ্গবন্ধু হত্যার ষড়যন্ত্র করে। সাম্রাজ্যবাদী ও পুঁজিবাদী দেশগুলোসহ একটি আন্তর্জাতিক চক্রান্ত এই হত্যার পেছনের মূলহোতা ছিল। কারণ তারা ৭১-এর পরাজয়কে মেনে নিতে পারেনি। বিশেষ করে বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি ঘোষণা দেওয়ার পরপরই তাকে হত্যা করে। এটা এমন একটা সহজ ব্যাপার নয় যে, খন্দকার মোশতাক কয়েকজন খুনিকে ডেকে বলল আর হত্যাকাণ্ড ঘটে গেল। এর পেছনে গভীর দেশীয় ও আন্তর্জাতিক চক্রান্ত রয়েছে। তাই বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনাকে প্রায় ২০ বার হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে এবং এখনো চলছে। তাই বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখনো শোনা যায়, অনেকেই এক হয়ে এক সুরেই বলেন সবকিছুই ঠিক আছে। শুধু ওই মেয়েটাই যত সমস্যা। ক্ষমতা যার খুশি তার হাতেই থাকুক, শেখ হাসিনার হাতেই যেন না থাকে। কেননা, শেখ হাসিনা থাকলে তো এ দেশ কেউ দাবায়া রাখতে পারবে না।

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
চক্রান্ত,বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড,১৫ আগস্ট
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MySQL server version for the right syntax to use near 'WHERE news_id=228895' at line 3
Error!: SQLSTATE[23000]: Integrity constraint violation: 1062 Duplicate entry '228895' for key 'news_hits_counter.news_id'