দীপংকর গৌতম
বাতিঘরের গল্প
শিল্পী-সংগ্রামী কামাল লোহানী

ঢাকায় সাংবাদিক জীবন শুরু হলে অফিসের দায়িত্ব পড়ে সব সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, নাট্যানুষ্ঠান, চিত্রপ্রদর্শনী কাভার করার। আবার গুণিজনদের সঙ্গে ফোন করে লেখা চেয়ে সে লেখা নিয়ে আসা, লেখা লিখে আনা। সেদিক থেকে যাদের সঙ্গে ফোনে কথা হয়েছিল, তার মধ্যে প্রথম ফোনে কথা হয়েছিল (যত দূর মনে পড়ে) দেশবরেণ্য সাংবাদিক-সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব প্রয়াত কামাল লোহানীর সঙ্গে। কমলা রঙের টেলিফোন সেট থেকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে নম্বর ঠিকমতো ডায়াল করতেই টেলিফোন বাজতে থাকল। তারপর টেলিফোন ধরলেন এক রাশভারী কণ্ঠের মানুষ। শহীদ মিনারে সফেদ পোশাক পরিহিত মানুষটির বক্তৃতা শুনেছি। তার বক্তৃতা যেন সাহসের আখ্যান। উদাত্ত কণ্ঠের অধিকারী কামাল লোহানী। আমার বুক ধড়ফড় করছে। একটা গ্রামের ছেলে, টেলিফোনের আচার অতটা শিখিনি। যতটা শিখলে কামাল লোহানীর সঙ্গে স্বাভাবিকভাবে কথা বলা যায়। তা ছাড়া তার মতো ব্যক্তিত্ব আমার সঙ্গে কী কথা বলবেন? বা বলবেনইবা কেন? তবু ফেনের রিসিভার ধরে ঘামতে থাকি। কারণ কামাল লোহানী এমন একজন মানুষ যার জীবনটা একটি সংগ্রামী আলেখ্য। কামাল লোহানী সম্পর্কে একটু বলতে চাই। এই শিল্পী-সংগ্রামী লোহানী ছাত্রজীবন থেকেই রাজনীতিতে। ১৯৫২ সালে বাংলা ভাষা আন্দোলনে যুক্ত হন। ১৯৫৩ সালে পাবনার এডওয়ার্ড কলেজে নুরুল আমিন ও অন্য মুসলিম লীগ নেতাদের আগমনের বিরুদ্ধে যে আন্দোলন সংঘটিত হয়, তাতে অংশ নেওয়ার কারণে তিনি গ্রেপ্তার হন। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের রাজনৈতিক মঞ্চের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এবং অনেকের সঙ্গে পুনরায় গ্রেপ্তার হন। তিনি শেখ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দীন আহমদসহ তৎকালীন রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে কারাবাস করেন। ১৯৫৫ সালের জুলাইয়ে জেল থেকে মুক্তি লাভ করে ঢাকা চলে আসেন এবং মার্কসবাদের সঙ্গে জড়িত হন। এ সময় তিনি ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির রাজনীতি করতেন। ১৯৫৮ সালের সামরিক শাসনের সময় অনেকের সঙ্গে আত্মগোপন করেন। ১৯৬১ সালে রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনের ওপর আসে সরকারি বাধা। এ বাধায় পাকিস্তানি শাসকদের মুখোশ আর একবার উন্মোচিত হয়। সরকারের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে তখন রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনের জন্য যে কমিটি গঠন করা হয়েছিল, তাতে যারা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন কামাল লোহানী তাদের একজন। স্বাধীন বাংলা বেতার প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশ থেকে যাওয়া কর্মী, সাংবাদিক, শিল্পী, সুরকার, নাট্যকর্মী, সংস্কৃতিকর্মী, লেখকসহ অনেকের সঙ্গে সেখানে যোগ দেন কামাল লোহানী। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের বার্তা বিভাগের প্রধানই শুধু নন, এ বেতার কেন্দ্রকে সুসংগঠিত করতে কামাল লোহানী নিরলস পরিশ্রম করেছেন। মহান মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের শেষে ঐতিহাসিক শুভক্ষণে বিজয়ের খবরের বার্তাটি রচনা ও পড়ার সৌভাগ্য হয়েছিল তার। আমি যখন তার সঙ্গে কথা বলছি, তখন ঢাকায় উদীচী করি এবং সবেমাত্র একটি দৈনিকে ঢুকেছি। আমার চিফ নাট্যকার কানাই চক্রবর্তী (বর্তমানে বাসসের বার্তা সম্পাদক)। কানাইদার কথামতো ফোনের রিসিভার ধরে দাঁড়িয়ে ঘামছি। এবার ফোনের ওপার থেকে দরাজ কণ্ঠে আওয়াজ এলো- ‘হ্যালো’। সালাম দিয়ে বললাম, আমি উদীচী করি, একটা কাগজে কাজ করি। আপনার একটা লেখা চাই। তারপর তার কথাবার্তায় এত আনন্দ পেলাম, এত মোহিত হলাম- তার কথামতো দিনে বাসায় গিয়ে হাজির হলাম। তখন ঢাকা শহর ভালো চিনি না। তবে যতটা মনে পড়ে, সিদ্ধেশ্বরী এলাকায় হতে পারে। শীতের সকাল। তখন ঘাসে শিশির জমত। কুয়াশায় ঢেকে থাকত পথ। মিরপুরের কল্যাণপুরে খেজুর রস পাওয়া যেত। আমি গিয়ে দেখলাম গ্রিল দেওয়া বারান্দা। একটা চেয়ারে পিঠ ঠেকিয়ে তিনি পত্রিকা পড়ছেন। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে বুঝলাম আমার উপস্থিতি টের পাননি। দরজায় শব্দ করতেই তাকালেন। বললেন, ‘কোত্থেকে এসেছো’? বললাম তার সঙ্গে টেলিফোন আলাপের কথা। তিনি হাসতে হাসতে দরজা খুলে বসতে বললেন। তারপরে শুরু হলো আড্ডা। তার জীবনের রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক অজস্র ঘটনা শোনালেন। আমার বাড়ির অবস্থা, কে কি করেন সব শুনতে শুনতে এগিয়ে এলেন তার স্ত্রী সংগ্রামী নারী দীপ্তি লোহানী। এভাবেই ধীরে ধীরে শুরু হলো বাসায় যাওয়া-আসা। কামাল লোহানীর জীবন দেখা। বিশেষত তিনি যখন কলাবাগান লেক সার্কাসের বাসায় এলেন তখন দীপ্তি লোহানী প্রায়ই অসুস্থ থাকতেন। লোহানী কাকার (কামাল লোহানী) চোখে গ্লুকোমা। তাই নিয়ে লিখতেন। গোটা গোটা অক্ষরে বিন্যস্ত করে লিখতেন বলপেন দিয়ে, নিউজপ্রিন্টের কাগজে। যারাই লেখা চাইতেন না বলতেন না। নিজে বাসায় না থাকলেও লেখা রেখে যেতেন। আমার যাওয়া হতো সময়ে-অসময়ে। দুপুরে বাসায় গেলে কাকিমার কথাটা এখনো খুব কানে বাজে- ‘দুপুরে খাসনি তো, দেখ টেবিলে তোর কাকার (কামাল লোহানীর) জন্য খাবার আছে, তার অর্ধেকটা খাবি, পুরোটা খেলে তোর কাকা খেতে পারবে না কিন্তু।’ আমরা যারা পত্রিকায় কাজ করি। আমাদের ছুটি কম। বাড়ি যাওয়া কম হয়। এ রকম ভর দুপুরে যাদের কথা শুনে চোখ ভিজে যেত দীপ্তি লোহানী তাদের একজন ছিলেন। খাওয়া হলে খাটে তার পাশে বসতে বলতেন। অনেক কথা বলতেন প্রাণ খুলে। তিনি বলতেন, ‘এমনও দিন গেছে, তোর কাকা পত্রিকা অফিসে গেছেন, রাতে আসছেন না। পরে খবর পেলাম পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে।’ আমি তখন আজকের কাগজে কাজ করি। কাকিমার কাছে চেক দিয়ে আসতাম লোহানী কাকার লেখার সম্মানী। কাকিমা বলতেন, ‘তোদের সম্পাদকের তো টাকার অভাব নেই। টাকাটা একটু বাড়াতে বলবি। তোর কাকার চোখে অসুখ তো। যত কম লেখে ততই ভালো।’ শ্রদ্ধেয় কামাল লোহানীকে পেলে কথা শেষ হতো না। আমার কামাল লোহানীর বাসায় যাওয়ার পরে মনে হতো, একজন মানুষ শুধু ভালো লিখলেই ভালো পরিচয় বহন করে না। সামাজিক দায়সহ বহু গুণ লাগে একটা মানুষকে প্রকৃত মানুষ হয়ে উঠতে। কামাল লোহানী তার বয়সিদের সঙ্গে যেমন আড্ডা দিতেন, তেমনি আমার মতো একজন সাব-এডিটরের সঙ্গেও আড্ডা দিতেন। তিনি একবার এক অভিজ্ঞতার কথা বললেন, জিয়াউর রহমানের সঙ্গে বিদেশ যাওয়ার আমন্ত্রণ। কিন্তু তাকে স্যুট-কোট পরে যেতে হবে। কামাল লোহানী তার সাদা পাঞ্জাবি-পাজামা ছাড়তে রাজি হলেন না। ফলে রাষ্ট্রপক্ষ ক্ষেপে গেলেও তিনি অনড় থাকলেন। লোহানী কাকার বাসা কলাবাগান লেক সার্কাসে থাকতে বন্যা আপা (কামাল লোহানীর মেয়ে বন্যা লোহানী) আয়োজন করলেন তার জন্মদিন উদযাপনের। আমি, মাহমুদুল হাসান (জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগীত ও নাট্যকলা বিভাগের শিক্ষক) গৌতম বাকালী (গণসংগীত শিল্পী ও খামারবাড়ি কৃষি বিভাগে কর্মরত) এমন আরো বেশ কজন মিলে অনুষ্ঠান করলাম। আমি আজকের কাগজে কামাল লোহানীর জীবন ও কর্ম নিয়ে একটা লেখা লিখলাম। দারুণ উদযাপন হলো। তবে এখানে একটা কথা বলে রাখা দরকার, ১৯৮৩ সালে দেশ যখন স্বৈরাচারী শাসনের আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা, তখন কামাল লোহানীর গড়ে তুলেছিলেন ‘বাংলাদেশ গণশিল্পী সংস্থা’ নামের সাংস্কৃতিক সংগঠন। রাজশাহী-ঝিনাইদহ অঞ্চলে এর কাজ খুব ভালো ছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাহমুদুল, গৌতম বাকালীসহ অনেকে যখন শুক্রবার টিএসসিতে বসত, তারা গণসংগীত গাইত। কামাল লোহানী এক দিন আমাকে বললেন, ‘ওদের কয়েকটা গান তুলে দে।’ আমি সেটা করতাম। সেই গ্রুপ নিয়েই বন্যাদির নেতৃত্বে কামাল লোহানীর জন্মদিন পালন হয়েছিল। লোহানী কাকা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কাগজে কাজ করেছেন, কিন্তু মেরুদণ্ড বন্ধ রাখেননি। এর মধ্যে এক দিন সংগ্রামের সঙ্গী দীপ্তি লোহানী মারা যান। লোহানী কাকা কলাবাগান ছেড়ে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে আহসানিয়া মিশনের পাশে বন্যাদিসহ বাসায় থাকতেন। চোখে ভালো দেখতেন না। আমি গেলে দরজা খুলতেন আন্দাজে, পা টিপে টিপে এসে। হাসতে হাসতে বলতেন, ‘তুই এসে আমাকে ওঠালি, এখন লাইন হারিয়ে যাবে।’ মানে চোখে ভালো না দেখলেও লিখতেন। লাইন আঁকাবাঁকা হতো। আমার মতো কেউ গেলে ধারাবাহিকতা হারাত। যদিও কেউ গেলে অনেক খুশি হতেন। কথার কত শক্তি, ভাষায় কত মধু, আদর, শাসন- তা লোহানী কাকার সঙ্গে যারা কথা বলেছেন, মিশেছেন, তারা জানেন। একসময় নৃত্যশিল্পী ছিলেন, ছিলেন ছায়ানটের সাধারণ সম্পাদক। পদ ছেড়েছিলেন কেন, এক দিন জিজ্ঞাসা করলে হাসতে হাসতে বললেন, ‘পরে শুনিস’। আজও শোনা হয়নি। উদীচীর সভাপতি হওয়ার পর অনেক ব্যস্ত হয়ে গিয়েছিলেন। তবে দমে যাওয়ার লোক তিনি ছিলেন না। সাংবাদিকতায় ওই প্রজন্ম আর আসবে বলে মনে হয় না। সাংবাদিকতা স্বাধীন কোনোকালে ছিল না। কিন্তু তাদের একটা প্রজন্ম ছিল, যারা নিজের কথা লিখতে দ্বিধা করতেন না। উচ্চাভিলাষী ছিলেন না। গাড়ি-বাড়ির কথা কোনো দিন ভাবেননি। বাসায় গেলে প্রাণ ভরিয়ে আপ্যায়ন করতেন, আবার যে পর্যন্ত অদৃশ্য হয়ে না যেতাম দাঁড়িয়ে বলতেন, ‘সাবধানে যাবি। গিয়ে ফোন করিস।’ শেষ দিন পর্যন্ত মানুষের কথা ভেবেছেন, গণমানুষের মুক্তির কথা ভেবেছেন। আমি কোথায় পাব তারে? এই মানুষদের সান্নিধ্য কোনো ছোটখাটো বিষয় নয়। ঘরে-বাইরে এক চরিত্র। বাসার সবাই একসঙ্গে আড্ডা দেওয়ার সংস্কৃতি এরা রচনা করেছিলেন। তাদের পথে আমরা কত দূর যাব, সেটাই বড় কথা। কামাল লোহানী পরিচয়ের শুরু থেকেই আমার পরমাত্মীয়, আমার লোহানী কাকা করোনা মহামারিতে যিনি অনন্তলোকে চলে গেছেন, তাকে কোনো দিন ভুলব না।
পিডিএস/মীর