আমিনুল ইসলাম

  ১৮ মে, ২০২৩

আগামী ১১ জ্যৈষ্ঠ (২৫ মে) কবির জন্মদিন। তাকে শ্রদ্ধা

বাংলা সাহিত্যে আধুনিকতা ও নজরুল

বুদ্ধদেব বসু তার ‘রবীন্দ্রনাথ ও উত্তরসাধক’ প্রবন্ধে কাজী নজরুল ইসলাম সম্পর্কে বলেছেন : ‘যেহেতু তার পরিবেশ ছিল ভিন্ন, এবং একটু বন্য ধরনের, আর যেহেতু সেই পরিবেশ তাকে পীড়িত না-করে উল্টো সবল করেছিল তার সহজাত বৃত্তিগুলোকে, কোনো রকম সাহিত্যিক প্রস্তুতি না-নিয়েও শুধু আপন স্বভাবের জোরেই রবীন্দ্রনাথের মুঠো থেকে পালাতে পারলেন তিনি, বাংলা কবিতায় নতুন রক্ত আনতে পারলেন। তার কবিতায় যে-পরিমাণ উত্তেজনা ছিল সে পরিমাণ পুষ্টি যদিও ছিল না, তবু অন্তত নতুনের আকাঙ্ক্ষা তিনি জাগিয়েছিলেন; তার প্রত্যক্ষ প্রভাব যদিও বেশি স্থায়ী হলো না, কিংবা তেমন কাজেও লাগল না তবু অন্তত এটুকু তিনি দেখিয়ে দিলেন যে, রবীন্দ্রনাথের পথ ছাড়াও অন্য পথ বাংলা কবিতায় সম্ভব। যে-আকাক্সক্ষা তিনি জাগালেন, তার তৃপ্তির জন্য চাঞ্চল্য জেগে উঠল নানা দিকে, এলেন “স্বপনপসারী”র সত্যেন্দ্র দত্তীয় মৌতাত কাটিয়ে পেশিশক্তি নিয়ে মোহিতলাল, এলো যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তের অগভীর—কিন্তু তখনকার মতো ব্যবহারযোগ্য—বিধর্মিতা, আর এসব পরীক্ষার পরেই দেখা দিল “কল্লোল”—গোষ্ঠীর নতুনতর প্রচেষ্টা, বাংলা সাহিত্যের মোড় ফেরার ঘণ্টা বাজল।

নজরুল ইসলাম নিজে জানেননি যে, তিনি নতুন যুগ এগিয়ে আনছেন; তার রচনায় সামাজিক ও রাজনৈতিক বিদ্রোহ আছে, কিন্তু সাহিত্যিক বিদ্রোহ নেই। যদি তিনি ভাগ্যগুণে গীতিকার ও সুরকার না-হতেন এবং যদি পারস্যের গজলের অভিনবত্বে তার অবলম্বন না-থাকত, তাহলে রবীন্দ্রনাথ-সত্যেন্দ্রনাথেরই আদর্শ মেনে নিয়ে তৃপ্ত থাকতেন তিনি। কিন্তু যে-অতৃপ্তি তার নিজের মনে ছিল না, সেটা তিনি সংক্রমিত করে দিলেন অন্যদের মনে; যে-প্রক্রিয়া অচেতনভাবে তার মধ্যে শুরু হলো, তা সচেতন স্তরে উঠে আসতে দেরি হলো না। যাকে “কল্লোল” যুগ বলা হয় তার প্রধান লক্ষণই বিদ্রোহ আর সে-বিদ্রোহের প্রধান লক্ষ্যই রবীন্দ্রনাথ। এই প্রথম রবীন্দ্রনাথ বিষয়ে অভাববোধ জেগে উঠল—বন্ধ্যা প্রাচীনের সমালোচনার ক্ষেত্রে নয়, অর্বাচীনের সৃষ্টির ক্ষেত্রেই। মনে হলো তার কাব্যে বাস্তবের ঘনিষ্ঠতা নেই, সংরাগের তীব্রতা নেই, নেই জীবনের জ্বালাযন্ত্রণার চিহ্ন, মনে হলো তার জীবনদর্শনে মানুষের অনস্বীকার্য শরীরটাকে তিনি অন্যায়ভাবে উপেক্ষা করে গেছেন।’

বাংলাসাহিত্যে আধুনিকতার সূত্রপাতে কাজী নজরুল ইসলামের অবদান সম্পর্কে বুদ্ধদেব বসুর মূল্যায়ন অসত্য নয় তবে অসম্পূর্ণ। শুধু পথ দেখানো নয়, বাংলা সাহিত্যে নজরুল আধুনিকতার সূচনা করেছেন এবং সে আধুনিকতাকে অনেকখানি প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন। তার দেখানো পথ ধরেই বাংলা সাহিত্যে আধুনিকতার উৎকর্ষ। আধুনিকতা শুধু প্রকরণের বিষয় নয়। এটি কাব্যভাবনারও বিষয়। আধুনিকতা হচ্ছে প্রথমত মন ও মানসিকতার ব্যাপার, চিন্তা ও চেতনার ব্যাপার, বোধ ও বিবেচনার ব্যাপার। আধুনিকতা হচ্ছে নতুনকে স্বাগত জানানোর মন, মিথ্যা প্রমাণিত অতীতের দৃঢ়মূল ধারণা ও বিগত সত্যকে পরিত্যাগ করার সাহস। বোধে ও মননে আন্তর্জাতিকতাকে গ্রহণ, সাম্রাজ্যবাদবিরোধিতা, অন্যায়-যুদ্ধবিরোধিতা, রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতার অধিকার, ব্যক্তির ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের অশৃঙ্খলিত উন্মোচন, জনগণের ক্ষমতায়ন, লৈঙ্গিক সমতা, বিজ্ঞানমনস্কতা, অতিপ্রাকৃত শক্তিতে অবিশ্বাস, ধর্মবর্ণ-জাতপাত-উপগোষ্ঠীগত কৃত্রিম ব্যবধানে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন, জন্মের বদলে কর্মে মূল্যায়ন, যৌনতাকে প্রাণীর স্বাভাবিক চাহিদা হিসেবে গ্রহণ এবং কোদালকে কোদাল জ্ঞান করা ইত্যাদি হচ্ছে আধুনিক জীবনের প্রধান অনুষঙ্গসমূহ। রোমান্টিকতা হচ্ছে কল্পনাসর্বস্ব আকাশচারিতা; আধুনিকতা হচ্ছে ভূমিলগ্নতা; রোমান্টিকতা বা অনাধুনিকতা হচ্ছে প্রথাবদ্ধতার কাছে আত্মসমর্পণ; আধুনিকতা হচ্ছে প্রথার অচলায়তন ভেঙে বের হয়ে আসা। আধুনিকতা হচ্ছে ভালো-মন্দে মিশ্রিত জীবনকে তার সমগ্রে গ্রহণ করার মানসিক প্রস্তুতি। নজরুলই প্রথম রোমান্টিক শুচিবায়ুগ্রস্ততাকে পরিহারপূর্বক বাংলা কবিতা-গানে-কথা-সাহিত্যে-অভিভাষণে রক্ত-মাংসের মানুষের মানসিক এবং শারীরিক চাহিদা ও কামনা-বাসনাকে গভীর ইতিবাচকতায় উপস্থাপন করেছেন; তিনি নারী-পুরুষের সমতার গান গেয়েছেন; তিনি জাতিভেদ প্রথাসহ সব কুসংস্কার ও মানবসৃষ্ট অসাম্যের বিরুদ্ধে কলম ধরেছেন শক্তহাতে। তিনি বারাঙ্গনা নারীকে মহত্ত্বের উচ্চাসনে অধিষ্ঠিত করেছেন। তিনি কবিতায় ও অভিভাষণে মানুষের রাষ্ট্রিক ও আত্মিক স্বাধীনতার কথা প্রথম উচ্চারণ করেছেন। তিনি সব ধরনের কুসংস্কার ও অন্ধত্বের বিরুদ্ধে কবিতা-গান-অভিভাষণ রচনা করেছেন। নিয়তিবাদী মানুষকে তিনি দিয়েছেন আত্মনির্ভর প্রেরণা, বিশ্বাস ও সাহস। গৃহবধূ-বারাঙ্গনা, পাপ-পুণ্য, সতী-অসতী প্রভৃতি প্রচলিত ধারণাগুলো তিনি আধুনিক বোধের পক্ষে আমূল পাল্টে দিয়েছেন। তিনি বারাঙ্গনাদের জননী বলে সম্বোধন করেছেন এবং তারা অসতী-অশুচি এমন যুগ-পুরাতন ধারণাকে আধুনিক জীবনের অনুকূলে পাল্টে দিয়েছেন। তিনি সবার ওপরে স্থান দিয়েছেন মানুষকে। যুগস্বীকৃত প্রথা ছিল—পতিতা নারীরা খারাপ। নজরুল সে প্রথায় আঘাত করে লিখেছেন ‘বারাঙ্গনা’ নামক মহৎ কবিতা যেখানে তিনি বারাঙ্গনাকে মেরী, অহল্যা, গঙ্গার মতো মহৎ ও নিষ্পাপ জননী বলে আখ্যায়িত করেছেন।

যুগ যুগ ধরে প্রথা ছিল এবং এখনো অনেকটা রয়ে গেছে—নিম্নবর্গের মানুষ বিশেষত হিন্দুধর্মে যাদের ঘৃণাভরে শুদ্র বলে আখ্যায়িত করা হয়, তারা নিম্নজাত এবং অস্পৃশ্য। নজরুল এই প্রথা ভেঙে দিতে লিখেছেন ‘শুদ্রের মাঝে জাগিছে রুদ্র’। ডোম মেথর কুলি কৃষক মজুর তাঁতি জেলে নাপিত কামার-কুমোর মাঝি কুলি—এসব তথাকথিত নিম্নশ্রেণির মানুষজনই যে মানুষ হিসেবে নিম্নশ্রেণির নয়, নিম্নজাতের নয়, বরং তারা সমানভাবে সম্মানীয়, নজরুল তার কবিতার গানে তা প্রতিষ্ঠত করেছেন। যে গহনা-অলংকারকে নারীজাতির ভূষণ বলে যুগ যুগ ধরে প্রশংসিত করে আসা হয়েছে, তা যে নারীর জন্য শেকল, তার বন্দিত্বের নিদর্শন, কবিতা-গানে নজরুলই সর্বপ্রথম তা চিহ্নিত করে সেসব পরিহার করার জন্য নারীজাতিকে পরামর্শ ও প্রণোদনা দান করেছেন।


নজরুলকে ভাগ করে বুঝতে গেলে, ভুল বোঝা হবে। তাকে বুঝতে হবে তার মানস ও কর্মের বৈচিত্র্যের মধ্যকার ঐক্যে


প্রেম করা ‘পাপ’ অথবা ‘ব্যভিচার’ ইত্যাদি ধারণার মূলে কুঠারাঘাত করে তিনি লিখেছেন ‘জীবনে যাহারা বাঁচিল না’ ‘পাপ’ প্রভৃতি কবিতা। ‘পাপ’ কবিতায় নজরুলের ভাবনা আধুনিকতার শিখর স্পর্শ করেছে। তিনি এ কবিতায় বলেছেন যে—পৃথিবী তথাকথিত পাপেরই জায়গা ‘পাপস্থান’। তিনি বলেছেন ‘সাম্যের গান গাই/ যত পাপী তাপী সব মোর বোন, সব হয় মোর ভাই।’ তিনি বলেছেন ‘বিশ্ব পাপস্থান/ অর্ধেক এর ভগবান, আর অর্ধেক শয়তান।’ অধিকন্তু ‘পাপের পঙ্কে পুণ্য-পদ্ম ফুলে ফুলে হেথা পাপ।’ তিনি এতটাই আধুনিক যে, এও বলেছেন—মানুষ আত্মা ও দেহ নিয়ে পূর্ণসত্তা আর ‘পুণ্যে দিলেন আত্মা ও প্রাণ, পাপেরে দিলেন দেহ।’ দেহ বাদ দিয়ে তো মানুষ হতে পারে না। অতএব পাপ ছাড়া মানুষ চলতে পারে না। তাই ‘সুন্দর বসুমতী/ চিরযৌবনা, দেবতা ইহার শিব নয়, কামরতি’। এই আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি বাংলাসাহিত্যে নজরুলের আমদানি এবং তার হাতেই এর চূড়ান্ত রূপ লাভ। প্রকাশ প্রকরণে সহজিয়া বটে, কিন্তু বিষয়ভানায় ও জীবনদর্শনে গভীরভাবে চির-আধুনিক।’

আধুনিক মানুষের কয়েকটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে মুক্তমন, বিশ্বমানস, বিজ্ঞানের সঙ্গে একাত্মতা এবং অন্তর্গত স্ববিরোধ। উপনিবেশবাদ, সাম্প্রদায়িকতা এবং শ্রেণিভেদ-শাসিত পৃথিবীতে নজরুলের মতো মুক্তমনা, অসাম্প্রদায়িক, উদার, বিশ্বমানবতবাদী মানুষ অথবা কবি আর একজনও ছিল না, এখনো নেই। পৃথিবীর প্রতিটি মহান বিপ্লব ও সংগ্রামের সমর্থক ছিলেন তিনি। তিনি জাতপাত, শ্রেণিভেদ, বর্ণভেদ এবং সর্বপ্রকার অন্যায় আধিপত্যের বিরুদ্ধে সোচ্চারকণ্ঠ কবি। বিংশ শতাব্দী ছিল বিজ্ঞানের একাধিক আবিষ্কার ও বিজয়ের শতাব্দী। নজরুল তার একাধিক কবিতায়, প্রবন্ধে, অভিভাষণে বিজ্ঞানের বিজয়ভরা বিংশ শতাব্দীর জয়গান গেয়েছেন এবং সব ধরনের কুসংস্কার ও ভ্রান্ত বিশ্বাসের অচলায়তন ভেঙে ফেলার আহ্বানগীত গেয়েছেন। তিনি ‘থাকবো নাকো বদ্ধঘরে, দেখবো এবার জগৎটাকে’ বলে সাগর-নদী-আকাশ-পাতাল-মরু-পর্বত-পাহাড়-জলপ্রপাত সর্বত্র অভিযানে নেমে পড়তে সংকল্প ব্যক্ত করেন। তিনি ‘বিশ্বজগৎ দেখবো আমি আপন হাতের মুঠোয় পুরে’—বলে সংকল্প ঘোষণা করেন। তার এ ঘোষণা বিজ্ঞানের সাধনার পথ। তিনি আরো বলেন, ‘হাউই চড়ে চাই যেতে কে চন্দ্রলোকের অচিনপুরে/ শুনবো আমি ইঙ্গিৎ কোন্ মঙ্গল হ’তে আসছে উড়ে।’ এখানে বিজ্ঞানীদের ভবিষ্যৎ-চন্দাভিযান কল্পনায় দেখেছেন এবং বিভিন্ন গ্রহ থেকে ভেসে আসা সংকেত (হয়তো-বা প্রাণের অস্তিত্ব) অনুভব করেছেন কবি।

আরেকটি বিষয় হলো, অগ্রসর ও প্রগতিশীল কবি-শিল্পী-দার্শনিকরা সমাজের বহুদিনের কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাস ও ভ্রান্ত ধারণাকে বাতিল করে আলোকিত ও বাস্তবতার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নিয়ম ও মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা করতে লড়াই করেন। অন্ধবিশ্বাস বিজ্ঞানীর সাধনার পথে মারাত্মক অন্তরায়। ইউরোপে মধ্যযুগে অন্ধবিশ্বাসীরা বিজ্ঞানীদের পুড়িয়ে মেরে ফেলাসহ নানাবিধ শান্তি দিত। বিজ্ঞানীর আবিষ্কার পুরাতন জরাজীর্ণ ভ্রান্ত ধারণা ও অন্ধবিশ্বাসকে দূর করে দেয়। অন্ধবিশ্বাসবিরোধী চেতনা মানেই হচ্ছে বিজ্ঞানমনস্কতা। অগ্রসর ভাবনার কবি হচ্ছেন বিজ্ঞানীর বন্ধু ও অনুপ্রেরণা। বিংশ শতাব্দী ছিল বিজ্ঞানের স্বর্ণযুগ। আকাশ অভিযান, সমুদ্র অভিযান, রোগবালাইয়ের প্রতিকার ও প্রতিষেধক আবিষ্কার, টেলিফোন, টেলিভিশন, সিনেমা, ক্যামেরা, রেডিও, গ্রামোফোন রেকর্ড, বাস, ট্রেন, উড়োজাহাজ, স্টিমার, বিবর্তনবাদ প্রভৃতি আবিষ্কার পৃথিবীতে নিয়ে আসে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। জগৎ ও সমাজের হাজার বছরের অচলতা, সীমাবদ্ধতা, কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাস, বদ্ধমূল ভ্রান্ত ধারণা ইত্যাদি দূর করে সেখানে নিয়ে আসে নতুন আলো। জিন, ভূত-প্রেত-অতিপ্রাকৃত অস্তিত্ব প্রভৃতি ধারণার শেকড় উপড়ে বসে। কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থায় সূচিত হয় ব্যাপক গতি ও উন্নতি। শিল্পবিপ্লব বহুগুণে বৃদ্ধি করে দেয় জীবন ও জগতের গতি। লিঙ্গবৈষম্যের ধারণা ধাক্কা খায় প্রবলভাবে। চিকিৎসাবিজ্ঞানের অভূতপূর্ব উন্নতি রোগ-জ্বরা-ব্যাধি প্রতিরোধ করে মানুষের জীবনে এনে দেয় দীর্ঘজীবন ও সুস্থ জীবনের সওগাত। বিধাতার অস্তিত্ব এবং ধর্মের অভ্রান্ততা নিয়ে প্রবল প্রশ্ন উত্থাপিত হতে থাকে। অন্ধবিশ্বাসের স্থান দখল করে নিতে থাকে প্রশ্নশীলতা, উদ্ভাবন-নেশা। এরই নাম বৈপ্লবিক পরিবর্তন। এরই নাম নতুন আলো। নজরুল বিজ্ঞানসূচিত এই নবযুগকে—এই বিংশ শতাব্দীকে স্বাগত জানিয়েছেন প্রকাশ্যে এবং প্রবলভাবে। তার ‘বিংশ শতাব্দী’ নামক কবিতাটি সেই নতুন যুগের আবাহন-স্তুতিতে পরিপূর্ণ।

তিনি এ কবিতায় আরো পরিষ্কার করে বলেছেন—সর্বকালের যত ‘মোহ’, সবকে কাটিয়ে ওঠে, অন্ধবিশ্বাস-ভ্রান্তপ্রথার ‘সর্ব-বন্ধ’ হতে ‘মুক্ত’ হয়ে ‘আদিম-সৃষ্টি-দিবস থেকে ক্রমে জমে ওঠা’ যাবতীয় পশ্চাদ্পদতা ও কুসংস্কারের প্রাচীর ভেঙে মানুষ জেগে উঠেছে নতুন সূর্যের মতো এবং তার এই নতুন সূর্য-পথচলা জ্বালায়ে দিয়েছে যুগ-পুঞ্জীভূত ভ্রমের যাবতীয় জঞ্জাল। এই নতুন জীবনদর্শনে ‘শ্রমণের চেয়ে শ্রম’কে অর্থাৎ ধর্মীয় অন্ধবিশ্বাস-অদৃষ্টবাদিতা-কুসংস্কারের স্থলে ‘সাধনা ও শ্রম’কে বেছে নেওয়া হয়েছে। এই সাধনা ও শ্রম বিজ্ঞানের মূল ভিত্তি। মানুষ তার এই সাধনা ও শ্রম অর্থাৎ গবেষণা ও অভিযান দ্বারা প্রকৃতিকে জয় করেছে। আকাশ-বাতাস-সাগর-নদী-বন্যা-মহামারি-খরা প্রভৃতি মানুষের আওতায় এসেছে। যে-প্রকৃতি এত দিন মানুষের ‘প্রভু’ ছিল, মানুষ এত দিন যেসব শক্তির ‘অধীন’ ছিল, বিজ্ঞানের সহায়তায় সেসবই তারই নিয়ন্ত্রণে এসে গেছে। ফলে বিজ্ঞানসূর্য-সূচিত নতুন প্রভাতে মানুষ দেখেছে ‘আজিকে সর্ব-পরাধীনতার লয়/ নতুন জগতে আমরা সর্বময়।’ কবি বিজ্ঞানসাধক এই ‘সর্বজয়ী‘ ‘সর্বময়ী’ মুক্তমনা মানুষের পক্ষে নির্দ্বিধায় নির্ভীক উচ্চারণ করেছেন—‘সংস্কারের জগদ্দল পাষাণ/ তুলিয়া বিশ্বে আমরা করেছি ত্রাণ।/ সর্ব আচার-বিচার-পঙ্ক হতে/ তুলিয়া জগতে এনেছি মুক্ত স্রোতে।/ অচলায়তনে বাতায়ন খুলি প্রাণ/ এনেছি, —গেয়েছি নব আলোকের গান।’

বিজ্ঞানের কাজ হচ্ছে ‘যুগের অচলায়তন’ ভেঙে দেওয়া অথবা তার ‘বাতায়ন’ খুলে দেওয়া, যা পরীক্ষা-নিরীক্ষায় উত্তীর্ণযোগ্য নয়, তা যতই পুরাতন হোক, সমাজ তাকে যতই মান্য করে এসে থাক, তাকে ‘বাতিল’ বলে ঘোষণা করাই বিজ্ঞানের কাজ। আর ‘নব আলোকের গান’ গেয়ে যুগসঞ্চিত সংস্কারের-মূর্খতার-অজ্ঞতার অন্ধকার দূর করার মন, সংকল্প এবং সেই ‘নব আলোক’কে বরণ করে নেওয়ার মানসিক প্রস্তুতির নামই বিজ্ঞানমনস্কতা, যা প্রকারান্তরে ‘প্রগতিশীলতা’ বলে কথিত। অবশ্য বিজ্ঞানের নেতিবাচক দিকগুলো নিয়ে চিন্তাভাবনাও কবিদের বিজ্ঞানচেতনার অংশ।

উল্লেখ্য, নজরুলের ‘বিংশ শতাব্দী’-বন্দনা পশ্চিমের মানুষের জন্য যতখানি সত্য ছিল, তৎকালীন ভারতীয় উপমহাদেশ তথা বৃহত্তর এশিয়ার মানুষের জন্য তখনো সেভাবে সত্য হয়ে ওঠেনি। কারণ কিছু উজ্জ্বল ব্যতিক্রমসহ এ অঞ্চলের মানুষ তখনো ছিল বিজ্ঞানবিমুখ এবং অন্ধবিশ্বাস ও অদৃষ্টবাদিতার দাস। নতুন যুগের বার্তাবাহক বিজ্ঞানসচেতন নজরুল তাদের বিজ্ঞানবিমুখতায় আঘাত করেছেন এবং অনেকটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখানোর মতো করে দেখিয়ে দিতে চেয়েছেন বিজ্ঞানচালিত পশ্চিমা সমাজ এবং বিজ্ঞানবিমুখ প্রাচ্যের সমাজের তুলনামূলক ছবি : একটি ছবি অগ্রসরমানতার, অন্যটি পশ্চাদপদতার। এই কবিতায় বিদ্যুতের আবিষ্কার ও তার সর্বজয়ী শক্তি, উড়োজাহাজ-রকেট প্রভৃতির সাহায্যে আকাশজয়ের অভিযান এবং বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের সাহায্যে বিশ্বকে দেখার-চেনার-জানার প্রচেষ্টার ছবি উপস্থাপিত হয়েছে। ‘বিদ্যুৎ ওদের গৃহকিন্নরী’—এই একটি চিত্রকল্পে ইলেকট্রিসিটির আবিষ্কার এবং আলাদীনের আশ্চর্য প্রদীপের মতো তার সর্বসাধনশক্তির ছবি অভূতপূর্ব ও অনন্যসুন্দর ব্যঞ্জনায় ফুটে উঠেছে। একই সঙ্গে আছে আধুনিক বিশ্বে বিজ্ঞানবিমুখ এশিয়াবাসীর তুলনামূলকভাবে পিছিয়ে পড়ে থাকার চিত্র। নজরুল শুধু বিজ্ঞানসচেতনই ছিলেন না, তিনি ছিলেন বিজ্ঞানভিত্তিক দুনিয়া প্রতিষ্ঠার পক্ষে প্রবলকণ্ঠ রাষ্ট্রদূত।

প্রকৃত আধুনিক মানুষ মানে প্রশ্নশীল মানুষ। তিনি যুগবাহিত কোনো কিছুই বিনা প্রশ্নে বা অন্ধভাবে মেনে নিতে চান না। আলোকিত সংশয় তাকে তাড়িত করে। আবার কোনো কিছুকেই সহজে না করেও দিতে চান না। সবকিছু বাজিয়ে দেখে নিতে চান। কিন্তু সবকিছুকে বাজিয়ে নেওয়ার সময় ও সুযোগ তো তার থাকে না। ফলে সংশয় গভীর হয়। সংশয় নানামুখী হয়ে ওঠে। সেই নানা নানামুখী সংশয় তাকে দীর্ণ করে সময়ে-অসময়ে। নজরুল তার ব্যক্তিজীবনে ও সৃজন-জীবনে আধুনিক যুগের বহুবিধ সংশয়জনিত অমীমাংসায় রক্তাক্ত হয়েছেন মনে-মননে-হৃদয়ে। পুরাতন বিশ্বাস এবং নতুন ধারণার টানাপড়েন তার মধ্যে নিয়ত জন্ম দিয়েছে সংশয় ও প্রশ্নশীলতার। তিনি একবার একটি মতপ্রকাশ করে আর সেটার সঙ্গে সাংঘর্ষিক অভিমত প্রকাশ করেছেন এবং মনে-প্রাণে রক্তাক্ত হয়েছেন, বিদীর্ণ হয়েছেন। এই সংশয়শীলতা, এই প্রশ্নশীলতা, এই অন্তরের রক্তক্ষরণ, এসবই আধুনিক সৃজনশীল মানুষের নিয়তি। আধুনিক মানুষ আস্তিকতা ও নাস্তিকতা, ধর্ম ও বিজ্ঞান, ভালো ও মন্দের ধারণা, কর্ম ও নিয়তি, ব্যক্তি ও রাষ্ট্র, দায়িত্ব ও অধিকার, প্রেম ও অপ্রেম, জাতীয়তা ও আন্তর্জাতিকতা, এসবই নিয়ে প্রায়ই টানাপড়েনে ভোগেন এবং অন্তরে অন্তরে রক্তাক্ত হন। বলা হয়েছে, আধুনিক কবিতা হবে কবির ব্যক্তিগত মানসিক প্রতিক্রিয়াজাত অনুভব অভিজ্ঞতার নির্যাস। সেখানে ‘সামষ্টিক চেতনা’ অপ্রত্যক্ষ বা অনুপস্থিত থাকবে। এটা নিরঙ্কুশ পুঁজিবাদী শিল্প-সংস্কৃতিজাত ভাবনাকাঠামো। পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বিপক্ষে অবস্থান ছিল নজরুলের। তার পরও নজরুলের একান্ত প্রাতিস্বিক ভাবনার অথবা ব্যক্তি ভাবনার কবিতা কম নেই। নজরুল রোমান্টিক কবি ছিলেন এটা যেমন সত্য, তিনি আধুনিক কবি ছিলেন সেটা সমানভাবে সত্য। এটা তার ক্ষেত্রেই সম্ভব হয়েছে। কারণ তিনি সেই স্ববিরোধী নিয়তি ও সত্তা নিয়ে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তার এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরি ছিল, অন্য হাতে ছিল রণতূর্য। তিনি বিদ্রোহী হয়ে জেল খেটেছেন; আবার প্রেমিক হয়ে প্রেম করেছেন। অনুরূপভাবেই তিনি এক হাতে রোমান্টিকতা নিয়ে জন্মগ্রহণ করেছিলেন, আর জীবনাভিজ্ঞতা ছেনে অন্য হাতে তুলে নিয়েছিলেন আধুনিকতা। নজরুলকে ভাগ করে বুঝতে গেলে, ভুল বোঝা হবে। তাকে বুঝতে হবে তার মানস ও কর্মের বৈচিত্র্যের মধ্যকার ঐক্যে। আরেকটি বিষয় হচ্ছে—নজরুলের আধুনিকতায় জীবনের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি ইতিবাচক, যা অন্য আধুনিক কবি-সাহিত্যিকদের আধুনিকতার সঙ্গে ফারাক রচনা করেছে। অবশ্যই নজরুলের সাহিত্যের আঙ্গিক বা প্রকরণ তিরিশের পঞ্চপাণ্ডবের মতো নয়। তিনি অন্ত্যমিলযুক্ত ছন্দপ্রধান সহজ ভঙিতে এবং অলংকারযুক্ত ভাষায় অধিকাংশ কবিতা রচনা করেছেন। বুদ্ধদেব বসু সম্ভবত এটাকেই ‘কিন্তু সাহিত্যিক বিদ্রোহ নেই’ বলে অভিহিত করেছেন। তবে তার ভাবনার অগ্রসর আধুনিকতা সেই ক্ষতি অনেকখানি পুষিয়ে দিয়েছে। রাজনৈতিক পরাধীনতা-সামাজিক কুসংস্কার-বৈষম্য-নারীর পরাধীনতা-শ্রমিক শোষণ-সাম্প্রদায়িক হানাহানি-জাতিভেদ-বর্ণভেদ-ধর্মভেদ প্রভৃতি থেকে মুক্তি পেতে প্রতিটি ক্ষেত্রেই আজকের আধুনিক মানুষ অন্যদের প্রকরণসর্বস্ব আধুনিক কবিতার চেয়ে নজরুলের কবিতা-গানকে অস্ত্র হিসেবে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করে থাকেন। আসলে অন্যান্য ক্ষেত্রের মতোই সাহিত্যের আধুনিকতাতেও নজরুল অনন্য ও একক।

লেখক : কবি ও প্রাবন্ধিক। ইমেইল : [email protected]

পিডিএস/মীর

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
১১ জ্যৈষ্ঠ,কবি,জন্মদিন,বাংলা সাহিত্যে আধুনিকতা
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close