ইলিয়াস ফারুকী

  ৩১ মার্চ, ২০২৩

গল্প

মৌলি, তুলি এবং পাগলি

মৌলির ভেতরের অনুভূতি আজ খুবই চনমনে। আজ তার কাছে সবকিছুই আপন আপন ভালো লাগছে। এমনকি যে বিড়ালকে সে এড়িয়ে চলে, সেই বিড়ালকে দেখেও সে আনন্দে শিস দিয়েছে। এত আনন্দের কারণ অফিস থেকে পাওয়া একটি খাম। দীর্ঘ পাঁচ বছর নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করে আজ তার ফল সে পেয়েছে। প্রমোশন এবং দুটো ইনক্রিমেন্ট একসঙ্গে। হৃদয়ের উচ্ছ্বাস তখন তাকে অন্যদিকে লক্ষ করতে দিচ্ছে না। কিন্তু মনোযোগ একটু সরালেই বুঝতে পারত যে বেশ কিছুক্ষণ থেকেই অর্ধ-উলঙ্গ এক পাগলি মৌলির পিছু নিয়েছে। রোহানের ফোনের জলতরঙ্গে তার ভেতরের উচ্ছ্বাসে বাধা পড়ল। রোহানের সঙ্গে কথা শেষ করে নিজের ফোনটা ব্যাগে রাখছে তখনই সে পাগলিকে লক্ষ্য করল। এক দৃষ্টিতে মৌলির দিকে তাকিয়ে আছে। যেহেতু আজ মৌলির জন্য একটি বিশেষ দিন সে পাগলিটাকে খাবার কিংবা টাকা দিতে চাইল। কিন্তু তাতে তার কোনো আগ্রহ ছিল না। শুধু বারবার আঙুলের ইশারায় মৌলির বুক দেখিয়ে কিছু একটা বলতে চাচ্ছিল। পাগলি বারবার কেন তার দিকে আঙুলের ইশারা করছিল তা কিছুতেই মৌলির বোধগম্য হচ্ছিল না। সে বেশ বিব্রত বোধ করছিল। কিছুতেই বুঝতে পারছিল না একজন নারী হয়েও কেন অপর আর একটি নারীর বুক দেখিয়ে বারবার ইঙ্গিত করছে। একসময় লজ্জা পেয়ে বুকের আঁচলকে টেনে নিয়ে বুকটা ভালো করে ঢাকতে চেষ্টা করল। বোধ হয় পাগলিটা বিষয়টি বুঝতে পেরে দুহাত নাড়িয়ে জিহ্বা কামড়ে এবং নিজের ছেঁড়া শাড়ির আঁচল এবং শরীরের কাঁপানো দেখিয়ে মৌলিকে শীতের অনুভূতি বোঝাতে চাইল। এবার মৌলির কাছে বিষয়টি স্পষ্ট হলো। পাগলি তার গরম পোশাকের দিকে ইঙ্গিত করছে বুঝতে পেরে বিড়বিড় করে বলল, ‘পাগলের শখ কত, আমার শখের জিনিস তাকে দিয়ে দিতে হবে!’ কিন্তু পাগল-সম্বন্ধীয় এক ধরনের আতঙ্ক তাকে সরাসরি ঘাঁটাতে সাহস পেল না। কারণ তার বিশ্বাস, এ রকম মানুষদের এক ধরনের আধ্যাত্মিক ক্ষমতা থাকে। ছোটবেলা মা-নানুর কাছে অপ্রকৃস্থ মানুষ নিয়ে অনেক মিথ শুনেছে। যেটা এখনো তার অবচেতন মনে ঘাপটি মেরে আছে। আজ হঠাৎ এ রকম সমস্যা তাকে বিহ্বল করে তুলেছে। পাগলিটা তার পেছনে পেছনে আসতে থাকায় আতঙ্কে তার ব্রহ্মতালু শুকিয়ে মরুভূমির রুক্ষতা পেয়ে বসেছিল। নিরাপত্তাহীনতা বোধে কিছুটা দ্রুতই পা চালাচ্ছিল সে। মাথার পেছনের শিরশির অনুভূতিটা একটু জোরেই পা চালানোর তাগাদা দিচ্ছিল। বাসার গলির মুখে এসে সাহস সঞ্চয় করে শেষবারের মতো পেছনে তাকাল মৌলি এবং মুহূর্তেই সব আতঙ্ক এবং শিরশির অনুভূতি শূন্যে হারিয়ে গেল। কারণ পেছনে ফাঁকা রাস্তা। পাগলিটা কখন যে উধাও হয়েছে, টেরই পায়নি সে।

মৌলির বাসা শহর থেকে একটু বাইরে। যেখানে এখনো মফস্বলের ভাব-স্বভাব রয়ে গেছে। এলাকায় ঘন গাছপালা থাকায় পৌষের সন্ধ্যায় শীত দ্রুতই তার আঁচল বিছিয়ে দেয়। মৌলিদের পরিবার শীতকালীন একটি নিয়ম মেনে চলে। সন্ধ্যা পেরোলেই রাতে আহার-পর্ব শেষ করে ফেলে। মৌলিদের বাড়ির আরো একটি বৈশিষ্ট্য হলো, বাড়ির কাজকর্ম সবাই ভাগ করে সম্পন্ন করে। মৌলি যেহেতু চাকরি করে তাই সে তার অংশের বাড়ির কাজ রাতেই করে থাকে। রাতে সবার খাওয়া-দাওয়া শেষ হলে এঁটো বাসন-কোসন ধোয়ার দায়িত্ব মৌলির। রোজকার মতো সেদিন রাতেও সবার এঁটো বাসন-কোসন ধুয়ে রান্নাঘরের মিটসেফে রাখছিল। সদ্যই মাতৃত্বে গর্বিত তাদের পোষা কুকুর তুলি ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে আদুরে স্বরে কুউউ করে ওঠে। শীতের সময় এটা তার ঘুমুতে যাওয়ার ঘোষণা। মৌলি তখন কুকুরটার জন্য একটি মোটা ছালার ব্যবস্থা তার নির্দিষ্ট করা জায়গায় বিছিয়ে দেয়। কিন্তু আজ মৌলি লক্ষ করল সে সময়ের অনেক আগেই শুতে যাওয়ার ইঙ্গিত করছে। কিছুটা আশ্চর্য হলেও তেমন পাত্তা না দিয়ে কুকুরটার নির্দিষ্ট জায়গায় চটের বস্তা বিছিয়ে দিল। সেও নিজের ধোয়া-মোছার কাজ শেষ করে দ্রুতই বিছানার আশ্রয় নিল। কর্মব্যস্ততার কারণে বিকেলের ঘটনা প্রায় ভুলেই গিয়েছিল। কিন্তু বিছানায় শুয়ে পড়তেই তার পাগলিটার কথা মনে পড়ে গেল। হঠাৎ করেই একটা অজানা অস্বস্তি তাকে আবারও ঘিরে ধরল। অস্বস্তির কাঁটা তার ঘুমকে অনেক রাত পর্যন্ত দূরে সরিয়ে রাখল। পাগলির ঘটনাটা মাথা থেকে দূর করতে সুকুমার রায়ের অদ্ভুত প্রাণীর উদ্ভট ছড়া পড়তে শুরু করল। উদ্ভট ছড়াই তার নিদ্রা প্রশমনে কার্যকর হলো। কখন যে ঘুমিয়ে পড়ল নিজেও বলতে পারবে না। রাতে তরল প্রাকৃতিক ডাক তাকে জাগিয়ে দিল।

পৌষের মাঝরাতে ঘুম ছেড়ে নিজেকে হালকা করতেও ইচ্ছে করছিল না মৌলির। কিন্তু উপায় কী। অগত্যা বিছানা ছাড়তেই হলো। নিজেকে হালকা করে বিছানায় ফিরে আসার সময় একটা ফিসফিসানির মতো শব্দ তার কানে প্রবেশ করল। কিন্তু চেষ্টা করেও দিকটা ঠাহর করতে পারল না। চৌচালা ঘরে শীত তখন জাঁকিয়ে বসেছে। কম্বলের বাইরে বেশিক্ষণ থাকতে পারল না সে। কম্বলের নিচে সবেমাত্র শরীরটা একাত্ম হতে শুরু করেছে, তখনই কিঁ কুঁই কাঁই কুঁ শব্দ আসতে শুরু করল। এবার বিরক্ত হয়ে কম্বলের নিচে পুরো মাথা ঢুকিয়ে ঘুমোতে চেষ্টা করল মৌলি। কাঁঠালগাছের পাতা থেকে কুয়াশার ফোঁটাগুলো চুইয়ে পড়ে টিনের চালে তখন ছন্দ তুলছে। কিঁ কুঁই কাঁই কুঁ শব্দ থেকে নিজের মনোযোগ সরিয়ে কুয়াশার ছন্দে সে নিজেকে ব্যস্ত করল। আবার কখন ঘুমিয়ে গেল টেরই পেল না।

অভ্যাস অনুযায়ী খুব সকালেই ঘুম ভাঙল মৌলির। শীত হোক কিংবা গ্রীষ্ম ভোরের পবিত্র অবস্থায় খোলা উঠোনে দাঁড়িয়ে বুক ভরে নিঃশ্বাস নেওয়া তার দীর্ঘদিনের অনুশীলন। সে বিশ্বাস করে এতে সারা দিন মন উৎফুল্লও থাকে, কাজে আনন্দ পাওয়া যায়। কিন্তু আজ মনটা খারাপ হয়ে গেল। দরজা খুলে বেরিয়ে আসতেই চমকে ওঠে। গতকালের সেই পাগলি তাদের তুলি ও তার দুই শাবককে জড়িয়ে তাদের উঠোনের কোনায় তাদের জন্য পেতে দেওয়া বস্তার ভেতরে নিশ্চিন্তে ঘুমুচ্ছে।

পিডিএস/মীর

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
গল্প,ইলিয়াস ফারুকী,সাহিত্য
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close