প্রতিদিনের সংবাদ ডেস্ক :

  ১৭ মার্চ, ২০২৩

বিশ্ব জয়ি বাঙালি বডিবিল্ডার মনোহর আইচের জন্মদিন

ছবি : সংগৃহীত।

অবিভক্ত বাংলার খ্যাতিমান বডিবিল্ডার মনোহর আইচ জয় করেছিলেন বিশ্ব। হলিউড অভিনেতা, বডিবিল্ডার আর্নল্ড শোয়ার্জনেগার তাঁকে দেখে বলেছিলেন, ‘আপনি একটি অনুপ্রেরণা।’

১৯১২ সালের আজকের দিনে (১৭ মার্চ) এই গুণী শরীরবিদের জন্ম হয়েছিল বর্তমান বাংলাদেশের কুমিল্লার ধামতি গ্রামে। তিঁনি বডিবিল্ডিংয়ে এশিয়ান গেমসে তিনবার স্বর্ণ পদক জয় করেন। ১৯৫২ সালে আয়োজিত মিস্টার ইউনিভার্স-গ্রুপ ৩ বিভাগে বিজয়ী হয়েছিলেন এই বাঙালি। ব্রিটিশ ভারতে স্বাধীনতার প্রশ্নে তিঁনি ছিলেন মুক্তির পক্ষেই। শতবর্ষ পেরিয়ে তাঁর মৃত্যু হয়েছে ভারতে।

বিভিন্ন ক্রীড়া ম্যাগাজিন, স্মৃতিকথা ও খবরের উঠে এসেছে মনোহর আইচের জীবন। এ থেকে জানা যায়, ছোটবেলা থেকেই সাধারণ বাঙালি কিশোরের মতো তাঁর আগ্রহ ছিল খেলাধুলায়। বিশেষ করে কুস্তিজাতীয় খেলায়। কিন্তু তিনি ১২ বছর বয়সে আক্রান্ত হন কালাজ্বরে। রোগটি তাঁকে প্রায় মৃত্যুর কাছাকাছি নিয়ে গিয়ে ছিল। তবে তার ফিরে আসার মধ্যেই রয়েছে এই গুণী শরীর শিল্পীর জীবনের আসল গল্প।

ভেঙে পড়া স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধার করতে মনোহর আইচের শুরু করলেন দেশীয় স্টাইলে শরীর চর্চা। পড়ালেখা করতেন ঢাকার জুবিলি স্কুলে। একবার ওই স্কুলে জাদু দেখাতে আসেন বিখ্যাত জাদুশিল্পী পি সি সরকার। মনোহর আইচের শরীর চর্চা ও শরীর নির্ভর ক্রিয়াদি দেখে তার ভালো লাগে। তিনি দলে নিয়ে নেন তাঁকে। মনোহর তখন পি সি সরকারের সঙ্গে বিভিন্ন প্রোগ্রামে তাঁর ক্রীড়াকৌশল দেখাতে শুরু করেন।

পেশাগত একসময় ভারতের ব্রিটিশ রয়্যাল এয়ার ফোর্সে তিনি যোগ দিয়েছিলেন। তখন ভারতে ব্রিটিশ শাসন চলছে। এয়ার ফোর্সের একজন অফিসার ছিলেন রিউব মার্টিন। মনোহরের শরীরচর্চা প্রীতি দেখে তাঁকে উৎসাহ দেন এবং আধুনিক অনেক শরীরচর্চা পদ্ধতির সঙ্গে তাঁকে পরিচিত করান তিনি। মনোহর সেই সময়ে শরীরচর্চা তথা ওয়েট ট্রেনিংয়ের মাধ্যমে নিজের দেহকে এমনভাবে নির্মাণ করেন যে রয়্যাল ফোর্সের অন্য সবার প্রশংসার পাত্র হয়ে ওঠেন।

কিন্তু ব্রিটিশ শাসকদের ভারতে প্রজাদের ওপর নির্যাতন-শোষণ নিয়ে একদিন এক অফিসারের সঙ্গে তার তর্ক শুরু হয়। সেই অফিসার ভারত সম্পর্কে তাচ্ছিল্যপূর্ণ এক মন্তব্য করে বসেন। মনোহর তার রাগ সামলে রাখতে পারেননি। কষে এক চড় বসিয়ে দেন তাকে। এই কাজের জন্য মনোহরকে জেলে ঢোকানো হয়। জেলে যাওয়ার পরেই তিনি বডি বিল্ডিং নিয়ে ভালো করে চিন্তাভাবনা করতে শুরু করেন। তার মনে হতে থাকে তিনি চাইলে বিশ্ব বডি বিল্ডিং প্রতিযোগিতায় যেতে পারেন। এর জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করলেন তিনি। তখন এমন সময়ও গিয়েছে যে, দিনে তিনি বারো ঘণ্টা ব্যায়াম করে গেছেন।

তাঁর কথায়, “জেলে আমি একা একা, কোনো ধরনের যন্ত্রপাতি ছাড়াই ব্যায়াম করে যেতাম, কখনো কখনো দিনে ১২ ঘণ্টা করে। ” তার এমন শরীরচর্চা প্রীতি দেখে জেল কর্তৃপক্ষ অভিভূত হয়ে গেল। তারা তার জন্য একটু বিশেষ খাবারের ব্যবস্থা করল। ১৯৪৭ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মনোহর আইচ জেল থেকে ছাড়া পান অন্য সবার সঙ্গে।

কিন্তু বডি বিল্ডিং চালিয়ে নেওয়া তার জন্য সহজ ছিল না। স্ত্রী এবং চার সন্তান ছিল, তা ছাড়া তারা ছিলেন দরিদ্র। সন্তানদের পড়ানোসহ জীবনযাত্রার নানা খরচ। সুতরাং মনোহর বিভিন্ন ছোটখাটো কাজ করে নিজের বডি বিল্ডিংয়ের জন্য অর্থ জোগাড় করতেন। একসময় তার বুকের ছাতি হয় ৫৪ ইঞ্চি আর কোমর ২৩ ইঞ্চি, অর্থাৎ পারফেক্ট একটি ভি আকৃতি বলতে যা বোঝায়।

তার এই পরিশ্রম ও চেষ্টা বৃথা যায়নি। ১৯৫০ সালে তিনি মিস্টার হারকিউলিস খেতাব জেতেন। ১৯৫২ সালে জেতেন মিস্টার ইউনিভার্স খেতাব। এরপর আসে আরও অনেক খেতাব। এর মধ্যে আছে এশিয়ার সেরা বডিবিল্ডারের খেতাবও। তার উচ্চতা ছিল মাত্র ৪ ফুট ১১ ইঞ্চি। এ জন্য তাকে ডাকা হতো পকেট হারকিউলিস নামে।

ভারতীয় উপমহাদেশের প্রথম এই মিস্টার ইউনিভার্স খেতাবধারী, আমাদের মতোই একজন বাঙালি, জীবনাচরণে ছিলেন বেশ সাদামাটা। এখনকার যারা জিম করেন তাদের ডায়েটের কত নিয়ম আছে, ভাত খাওয়া যাবে না, কমপ্লেক্স কার্ব খেতে হবে ইত্যাদি। মনোহর আইচ কিন্তু ভাতই খেতেন। ‘পান্তা ভাতের জল, তিন পুরুষের বল’-এ কথা তিনি বলতেন। তিনি এটাও জানিয়েছেন যে, একসময় দিনে চারবেলা পান্তা খেতেন।

সবচেয়ে দারুণ ছিল তার জীবন দর্শন। তিনি বলতেন, “আমি কখনো দুশ্চিন্তাকে প্রশ্রয় দিই না। ছোটবেলা থেকে টাকা রোজগার নিয়ে আমার সমস্যা ছিল। কিন্তু অবস্থা যা-ই হোক না কেন, আমি চিন্তিত হই না, খুশি থাকি। ”

নিজের তৈরি ব্যায়ামাগারে ব্যায়াম শেখাতেন। ভারতের আটবারের চ্যাম্পিয়ন বডি বিল্ডার সত্য পাল তারই শিষ্য। এ ছাড়া আরেক শিষ্য প্রেমচাঁদ দোগরা ১৯৮৮ সালে জিতেছিলেন মিস্টার ইউনিভার্স খেতাব।

বডি বিল্ডিংয়ে শরীর ও মনের সংযোগ খুবই জরুরি। কারণ আমাদের শরীর একটি নিউরোমাসকুলার সিস্টেম এবং মাসল গ্রোথের মস্তিষ্কের সিগনালও জরুরি। শরীর ও মনের সংযোগভিত্তিক বডি বিল্ডিংয়ের একজন বিখ্যাত প্রচারক ছিলেন ব্রুস লী। তার মতোই মনোহর আইচ মনে করতেন, দেহের উন্নতির জন্য মনের সঙ্গে তার সংযোগ জরুরি। এ জন্য মনকে নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। শুধু শারীরিক কসরতের ওপরই বডি বিল্ডিং নির্ভর করে না।

বডি বিল্ডিংয়ের এই কিংবদন্তি বার্ধক্যজনিত কারণে ২০১৬ সালের ৫ জুন মারা যান। তখন তার বয়স হয়েছিল ১০৪ বছর। শতায়ু হলেও তিনি ছিলেন অত্যন্ত শক্তিশালী।

পিডিএস/এএমকে

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
মনোহর আইচ,বডিবিল্ডার,বাঙালি,খ্যাতিমান
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close