মোহাম্মদ আসাদুল্লাহ

  ০৯ মার্চ, ২০২৩

মেয়েটার নাম জামিলা 

অ্যা সানডে অন লা গ্রানদে জাতেঁ।। অঙ্কনকাল ১৮৮৪-১৮৮৬।। চিত্রশিল্পী- জর্জ পিঁয়েরে সুঁরাত -অন্তর্জাল

খুব ছোটবেলাতেই সিন্ডারেলাকে স্বপ্নের একটা বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছিল, যে স্বপ্নের রঙ কখনই রঙিন হয় না। হয় সাদাকালো। সিন্ডারেলা বিশ্বাস করেনি। কারণ, তার স্বপ্নগুলো ছিল খুবই রঙিন।

ছোটবেলা থেকেই সিন্ডারেলা সৎ মা ও দুই সৎ-বোনের ফাইফরমাশ খাটে। দিবারাত্র। ঘুম থেকে পাখিদের জাগরণের আগেই সিন্ডারেলা জেগে উঠে। সকাল হবার আগেই বাড়ির উঠোন ঝাড়ু দেয়। হেঁশেলের গনগনে ছাই বাড়ির পেছনের আনারসের বাগানের ঢালে রেখে আসে। প্রায় অপরিচিত হয়ে উঠা পিতা, সৎমা এবং সৎ দুই বোনের জন্যে সকালের নাস্তা তৈরি করে। ভোরের ছায়া সরে যাবার পূর্বেই উঠোনে ধান নেড়ে দেয়। বাড়ির সবার কাপড়চোপড় ধবধবে সাদা করে ধুয়ে ফেলে। সকলের জন্যে দুপুরের খাবার তৈরি করে। গোধূলির মায়াবী প্রহরে বাড়ির অন্য সকল কিশোরীরা যখন গল্পগুজবে ব্যস্ত, তখন নিজেকে ধুঁয়ার ভেতরে আচ্ছন্ন করে রাতের খাবার তৈরি করে।

মায়ের মৃত্যুর পর তাকে আসল নাম ধরে কেউ ডাকে না। সারা দিনরাত রোদ-বৃষ্টিতে অবিরাম কাজ করার কারণে তার গায়ের রঙ নিকষ কাল। বাড়ির কাজের বুয়ারা তাকে ডাকে ‘কয়লা সুন্দরী’ বলে! অবশ্য কয়লা শব্দের সাথে সুন্দরী বিশেষণ লাগার একটা যৌক্তিক কারণও আছে। সিন্ডারেলার গায়ের কালো রঙের নিচ থেকে একটা উজ্জ্বল আলো বিচ্ছুরিত হয় সর্বক্ষণ; মেরু-জ্যোতির মত। যার ঝিলিক চারপাশের সবাইকে স্পর্শ করে যায়। এমনকি তার সৎ-বোনদেরকেও। তারা সিন্ডারেলার অস্পর্শনীয় আলোর উত্তাপে জ্বলে পুড়ে খাক হয়ে যায়!

প্রতিদিন বাড়ির সকল কাজকর্ম শেষ করে সিন্ডারেলা ঘুমোতে যায়। গভীর রাতে। ক্লান্ত পরিশ্রান্ত হয়ে। বাড়ির নেড়িকুত্তা, এমনকি ইঁদুর-বিড়ালেরাও যখন ঘুমে অচেতন; ঝিঁঝিঁ পোকার শব্দ ছাড়া আর কোন শব্দ নেই। অন্ধকার রান্না ঘরের কোণে শরীর এলিয়ে দিতে দিতেই সিন্ডারেলার চোখ বুজে আসে। সে স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। শুধু ঘুমের ভেতরে নয়, জাগরণের সময়েও রঙ-বেরঙের স্বপ্ন দেখা তার নেশা। বায়োস্কোপ দেখার নেশার মত। বায়োস্কোপের মুড়ির টিনের গোল জানালাগুলো যেমন চলমান শব্দময় রঙিন পৃথিবীকে জাগিয়ে তোলে, সিন্ডারেলার স্বপ্ন তেমনি বাস্তব কঠিন পৃথিবী থেকে তাকে নিয়ে চলে যায় অতীন্দ্রিয় কোন মায়ার রাজ্যে। সেই রাজ্যে সিন্ডারেলার সাথী তার মৃত মা- এক রূপকথার রাণী। উজ্জ্বল জ্যোৎস্না রাতে তিনি সিন্ডারেলাকে ঘুম পাড়ান; কোলে নিয়ে। রূপকথার গল্প শুনতে শুনতে এক সময়ে হারিয়ে যায় অতীন্দ্রিয় কোন লোকে। স্বপ্নের ভেতরেই সে রূপান্তরিত হয় অপূর্ব কিশোরীতে।

সিন্ডারেলা মায়ের কাছ থেকে অদ্ভুত সুন্দর একজোড়া কাঁচের জুতো উপহার পেয়েছে। শুনেছে আশ্চর্য এক রাজপুত্রের গল্প। তার নিশ্চিত বিশ্বাস রাজপুত্র মায়ের দেয়া জুতার সুত্র ধরেই সিন্ডারেলাকে একদিন খুঁজে বের করবে। তাকে নিয়ে যাবে স্বপ্নের রাজপুরীতে। সিন্ডারেলা নাচবে রাজপুত্রের সাথে। যুগল নাচ। বিশাল একটা হল রুমের ভেতরে। মায়ের দেয়া জুতো জোড়া পরে!

সিন্ডারেলা জুতা জোড়াকে হাতছাড়া করে না। স্বপ্নের ভেতরেও প্রতিনিয়ত সেগুলোকে লুকিয়ে রাখে। যাতে তার সৎ বোনদের চোখে না পড়ে। দেখলেই তারা কেড়ে নিয়ে যাবে। প্রতিরাতে বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে যাবার পর নিশ্চিদ্র রাতের আঁধারে জুতো জোড়া গুপ্তস্থান থেকে বের করে আনে। অপসৃয়মান তারার আলো জুতোর পৃষ্ঠদেশে প্রতিফলিত হয়ে ঝিকমিক করতে থাকে। কোন অতিপ্রাকৃত আলোর কিরণে। আলোর এই বিচ্ছুরণ সিন্ডারেলা ছাড়া আর কারও কাছেই দৃশ্যমান হয় না। কারণ, দৃশ্যমান আলোর সীমানার বাইরে এর অবস্থান। অতিবেগুনী রশ্মির শেষপ্রান্তে। কেবল সিন্ডারেলার অন্তর্দৃষ্টিই পারে একে দৃশ্যমান করে তুলতে।

অনেকদিন পরের কথা। কিশোরী সিন্ডারেলা এখন যুবতী। একরাতে আগমন করে রাজপুত্র। কথায় আছে, ‘বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহুদূর। সিন্ডারেলা রাজপুত্রের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ মাত্রই নিশ্চিত হয় যে, এটাই তার স্বপ্নের রাজকুমার। এই রাজপুত্রের হাত ধরেই স্বপ্নের ভেতরে সে নেচেছিল! স্বয়ম্বরা রাজকুমারীর মত সিন্ডারেলা তাকে বরণ করে। অতঃপর সৎ মা আর বোনদের ঈর্ষার জলে ভিজিয়ে এক তারাচ্ছন্ন রাতে সিন্ডারেলা বাড়ি ছেড়ে চলে যায়; রঙিন মেঘের ভেলায় ভাসতে ভাসতে। শুরু হয় দুজনের অনন্ত যাত্রা। ঘোড়ায় চড়ে সাত-সমুদ্র, তের-নদী, আকাশ নক্ষত্র পেরিয়ে স্বাতী নক্ষত্রের নিচ দিয়ে তারা উড়তে থাকে। আরব্য উপন্যাসের শেহেরজাদির দৃষ্টি দিয়ে সিন্ডারেলা দেখতে থাকে নীচের ঘুমন্ত পৃথিবীকে। দূরে দিগন্তের কাছে মেঘের ভেতরে জেগে থাকে নয়নাভিরাম এক রাজপ্রাসাদে। পাইক-পেয়াদা, হাতি-ঘোড়া সমৃদ্ধ। বিশাল হল রুমে রাজপুত্রের হাত ধরে রাতে আবার নাচবে সিন্ডারেলা।

বিশাল রাজপুরী। সিন্ডারেলার চোখ ঝলসে যায়। কিন্তু কী এক অদ্ভুত কারণে রাজপুরীতে সিন্ডারেলার ভাল লাগছে না। রাজপুত্রের মতিগতি বুঝতে পারছেনা সে। একেবারে অচেনা মনে হচ্ছে তাকে। এই বিশাল দেয়াল ঘেরা রাজপুরীতে সে ছাড়া আর কোন মেয়ে নেই। সবাই পুরুষ। সবার দৃষ্টিতে সম্পূর্ণ অন্য ধরনের কিছু অনুভব করে সে। লজ্জায় আর ভয়ে আচ্ছন্ন ও সংকুচিত হয়ে যায়। বিশাল প্রাচীর ঘেরা রাজপুরীকে অন্ধকারাচ্ছন্ন এক কারাগার বলে মনে হয়। নিজেকে মনে হয় চিড়িয়াখানায় আঁটকে রাখা বনমানুষ। প্রবলভাবে শঙ্কিত সে। তার বিশ্বাস কয়েক জন্মেও এই কারাগার থেকে মুক্তি লাভ করা সম্ভব নয় তার। এমনকি জন্মজন্মান্তরও কেটে যেতে পারে এই বদ্ধ কুঠুরিতে। মৃত মাকে তো বটেই, কষ্টদায়িনী সৎ মা ও বোনদেরকেও ভীষণভাবে অনুভব করতে থাকে সে।

গভীর রাত। রাজপুত্র ঘরে ফিরে। পারিষদ সমভ্যিহারে। রাজপুত্র এবং তার সাথীদের দৃষ্টিতে রাজ্যের লোলুপতা। সিন্ডারেলা প্রাণপণে দৌড়াতে থাকে। এক সময়ে চারপাশের প্রাচীরগুলো ক্রমশ তার দিকে নিবিড় হয়ে আসে।

প্রস্ফুটিত সকাল। ঢাকা নগরীর বিখ্যাত বাণিজ্যিক এলাকার বহুতল ভবন। ভবনের নিচে রাস্তার উপরে ভিড়। পিচের রাস্তার ঠিক মধ্যখানে একটা সুন্দরী মেয়ে শুয়ে আছে। অনেক ওপর থেকে পতিত হয়েছে সে। শরীরের যেদিকটা ভূমি স্পর্শ করে আছে তা সম্পূর্ণ থেঁতলে সমতল হয়ে গেছে। হিমবাহের মত রক্তের স্রোত একটু অগ্রসর হবার পর থমকে দাঁড়িয়েছে। কয়লার চেয়েও কাল পিচের ওপরে জমে আছে রক্ত; বরফের মত। রক্তের আস্তরণকে মনে হচ্ছে লাল রঙের ইরানি কার্পেটের অংশবিশেষ। কিংশুকের মত রক্তলাল।

নিশ্চল শুয়ে আছে মেয়েটা। মুখ ঊর্ধ্বপানে। তার বিস্ফারিত চোখ দুটো স্থির। যেন বা দূর আকাশের তারার পানে নিবদ্ধ। মনে হচ্ছে জেগে জেগে সে স্বপ্ন দেখছে। মেয়েটার নাম জামিলা! ‘এই রাস্তায় এই চাঁদের নিচে

আমার জুতো আমি চিরদিনের জন্য রেখে যাচ্ছি হেনরি

হয়তো কেউ আসবে একদিন

যার পা আমার পায়ের মতো নয়! - অমিতাভ মৈত্র।

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
মেয়েটার নাম জামিলা
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close