গাজী শাহনেওয়াজ

  ০৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩

ধ্বংসপ্রায় প্রত্নস্থাপনা রক্ষার উদ্যোগ 

প্রতীকী ছবি।

দেশের ঐতিহাসিক প্রত্নতত্ব স্থাপনাগুলোর বেশির ভাগ অযত্ন ও অবহেলায় রয়েছে। এগুলোর ধ্বংসাবশেষ ছাড়া কিছুই নেই। এগুলো রক্ষায় সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির কিছু তৎপরতা বেড়েছে। ফলে তাদের সুপারিশে কিছু স্থাপনা সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। তবে সে সংখ্যা সীমিত।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, মূলত, নদী ভাঙনের কবলে কিছু স্থাপনা হুমকিতে, জরাজীর্ণ কিন্তু সংস্কারের অভাবে ভবনগুলো হুমকিতে। এর ওপর রয়েছে তদারকিতে অনাগ্রহ। এ ছাড়া প্রভাবশালীদের দখলে রয়েছে অনেক ঐতিহাসিক স্থাপনা।

বিভিন্ন তথ্য সূত্রে জানা যায়, প্রত্নতত্ববিদরা বলছেন, উয়ারী-বটেশ্বর অঞ্চলে ২০০৬ সালে পাওয়া পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শনের মতে বাংলাদেশে জনবসতি গড়ে উঠেছিল প্রায় চার হাজার বছর আগে। সময়ের প্রতিটি ধাপই এ ভূখণ্ডে রেখে গেছে তার নানা নিদর্শন। এর মধ্যে অনেক প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন ধ্বংস হয়ে গেছে।

প্রাপ্ত তথ্যমতে, সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগরে জমিদার বাড়িটি সংরক্ষনের অভাব ও অযত্ন অবহেলায় বিলিন হওয়ার পথে। ধ্বংসবশেষ ছাড়া সেখানে অবশিষ্ট কিছু নেই। কিছুদিন আগেও বিভিন্ন অঞ্চল থেকে এই ঐতিহাসিক নিদর্শনটি দেখতে ভিড় লেগে থাকত। এখন শুধুই ইতিহাস। শুধু এটা নয়, পানাম নগরের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। ১৩৩৮ সালে ফখরুদ্দিন মোবারক শাহ সুবর্ণগ্রামকে বাংলার রাজধানী ঘোষণা করেন। এ সুবর্ণগ্রামই বর্তমানের সোনারগাঁ। ২০০৬ সালে ওয়ার্ল্ড মনুমেন্ট ফান্ডের করা বিশ্বের ১০০ ধ্বংসপ্রায় নগরীর তালিকায় স্থান হয় পানাম নগরের। সে বছরই গেজেট জারির মাধ্যমে পানাম নগর প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের অধীন করে দেয়া হয়। একই অবস্থা ঢাকার আরেক নিদর্শন লালবাগ কেল্লারও। এর ভেতরের দশমিক ১২ একর ভূমিও দখল হয়ে গিয়েছিল। সেখান থেকে দখলদারদের উচ্ছেদ করে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর। এভাবে দেশের গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নতত্ত্ব নিদর্শনগুলো দখল করে নেয়ার চেষ্টা চলে প্রতিনিয়ত। প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর বলছে, যথেষ্ট লোকবল না থাকায় দেশজুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা এসব নিদর্শনের সর্বোচ্চ দেখভাল করা তাদের পক্ষে সম্ভব হয় না।

সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ তথ্যমতে, গত ২০ বছরে বাংলাদেশে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের আওতায় ৫১৮টি সংরক্ষিত পুরাকীর্তির মধ্যে ১৭৮টিকে গেজেটভুক্ত করা হয়। সেগুলোর মধ্যে ঢাকা বিভাগে ২১টি, খুলনা বিভাগে ৪৪, রাজশাহী ও রংপুর বিভাগে ২৫ এবং চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগে ৬৭টি নিদর্শন রয়েছে। বাকি নিদর্শনগুলোর অবস্থানও দেশের বিভিন্ন স্থানে। তবে এরপরও জনবল সংকটসহ নানা অজুহাতে আর রক্ষণাবেক্ষণ করা সম্ভব হয় না। ফলে হাতে গোনা যে কয়টি নিদর্শন এখনো টিকে আছে, সেগুলোও নষ্ট হওয়ার পথে।

সংস্থাটির বিভাগ পর্যায়ের কয়েকজন কর্মকর্তা বলেছেন, দেশের অধিকাংশ প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন দখল ও নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। পর্যাপ্ত জনবল না থাকাকেই এর কারণ বলে মনে করেন তারা। দেখা গেছে, গত দুই দশকে খুলনা অঞ্চলে ৪৪টি প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন গেজেটভুক্ত হয়েছে। এর মধ্যে খুলনার কয়রার ধোপখোলা মসজিদটি ভেঙে নতুন মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছে। যশোরের ঝিকরগাছার কয়েম খোলা মসজিদটি ভেঙে আধুনিক করা হয়েছে। ঝিনাইদহের পঞ্চরত্ন মন্দিরটিও সংস্কার করে ব্যবহার করা হচ্ছে। মাগুরার শ্রীপুরে কবি কাজী কাদের নেওয়াজের স্মৃতিবিজড়িত ভবনটি নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। সংসদীয় কমিটির নথির তথ্যমতে, বরিশালের মেহেন্দীগঞ্জের উলানিয়া জমিদার বাড়িটি নদী ভাঙনের কবলে পড়ে বিলিন হওয়ার উপক্রম হয়েছিল। কমিটির সুপারিশের আলোকে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে প্রাপ্ত বরাদ্দে গত বছরের জুনে এটি নদী বাঁধ রক্ষায় এ যাত্রায় রক্ষা পেয়েছে। একই ভাবে টাংগাইলের পাকুটিয়া জমিদার বাড়ির জরাজীর্ণ কলেজ ভবনটি যে কোন সময় ভেঙে পড়ার আশঙ্কা ছিল। ঐতিহ্যবাহী প্রত্নতত্ব প্রতিষ্ঠানটি সংরক্ষনের সুপারিশের পর এটি সংস্কারে উদ্যোগ শুরু হয়েছে।

এ ছাড়া বাংলাদেশের বিক্রমপুরের বজ্রযোগিনী ও পাহাড়পুরসহ ইবনে বতুতার বাইয়ে উল্লেখিত স্থানে ‘ গৌতম বুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত প্রত্নস্থলসমূহ সংস্কার করার হচ্ছে। এ ছাড়া জাতীয় চার নেতা তাজউদ্দীন আহমেদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, এম মুনসুর আলী ও এস এম কামরুজ্জামান স্মৃতিবিজড়িত স্থানগুলো এতোদিন অরক্ষিত ছিল। সংসদীয় কমিটির সুপারিশে এসব ব্যক্তিদের স্মৃতিচিহ্ন সংস্কার করে দর্শনীয় স্থান হিসেবে গড়ে তোলার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি বেগম সুবর্ণ মুস্তফা বলেন, টাঙ্গাইলের পাকুটিয়া জমিদার বাড়ির জরাজীর্ণ ভবনে কলেজের কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। এখানে এক হাজারের মতো শিক্ষার্থী অধ্যায়নরত। যে কোন সময়ে বড় ধরণের একটি দূর্ঘটনা ঘটার আশঙ্কা রয়েছে। এটি প্রত্নতত্ব অধিদপ্তরের অধীনে এনে সংরক্ষণের জন্য পরামর্শ দেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, শুধু এটা না সংরক্ষণের অভাবে, অযত্ব-অবহেলায় আরও অনেক দর্শনীয় স্থান বাংলাদেশের মানচিত্র থেকে হারিয়ে গেছে, যা দুঃখজনক। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় সংসদীয় কমিটি চেষ্টা করছে এগুলোর যতাযথ সংরক্ষনের।

পিডিএস/এইচএস

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
প্রত্নতত্ত্ব
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close