মেহেদী হাসান

  ১২ এপ্রিল, ২০২২

মঙ্গল শোভাযাত্রা নিয়ে যেসব মিথ-বিতর্ক বর্ষবরণকে ম্লান করে

ছবি : সংগৃহীত

আসছে পহেলা বৈশাখ। বাংলা বা বঙ্গাব্দ সালের প্রথম দিন। যা বাঙালির নিজস্ব স্বকীয় সত্তা ও গৌরবের ঐতিহ্যের বর্ষবরণের দিন। কথিত আছে একসময় এ দিনটি হালখাতার উৎসব হিসেবেও বাঙালি সমাজে পালিত হত। এদিন উৎসবে মেতে উঠত সারা দেশ।

কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এই বিশেষ দিনটিতে মঙ্গল শোভাযাত্রা নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে কিছু বিতর্ক। এই বিতর্ক বাঙালি মুসলিম সমাজের ধর্মীয় বোধ ও সংস্কৃতি থেকে। ফলে মঙ্গল শোভাযাত্রার উৎস ম্লান করে দেয় ধর্মপ্রাণ কিছু মানুষের অংশগ্রহণকে।

মঙ্গল শোভাযাত্রা কি

পহেলা বৈশাখের সকালে মঙ্গল লাভের আশায় বিভিন্ন পশু-পাখির মুখোশ, ছবি, প্রতিমা বহন করে ঢোল-তবলার তালে তালে যে মিছিল বের করা হয় তাকে মূলত মঙ্গল শোভাযাত্রা বলা হয়। এর মূল উদ্দেশ্য মানব জীবনের কল্যাণ ও সমৃদ্ধি আনা। বিশ্বাস করা হয় এ শোভাযাত্রা করলে আমাদের জীবনে কল্যাণ ও সমৃদ্ধি আসবে।

বিতর্কের কারণ

বিতর্ক মূলত পশুপাখির মুখোশ, ছবি, প্রতিমা বহন করা নিয়ে। যাদিও দাবি করা হয় এসব বহনের কোনো উদ্দেশ্য নেই। বাঙালি জাতি এবং আমাদের সংস্কৃতির সাথে বিভিন্নভাবে এসব পশু-পাখির মিল রয়েছে। নিছক সৌন্দর্যের জন্য এগুলো বহন করা হয়। কিন্তু ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা দাবি করেন হিন্দুধর্মের বিশ্বাস অনুযায়ী এসব পশু-পাখি বিভিন্ন দেবদেবীদের বাহন ছিল। যা মূলত হিন্দুধর্মের বিভিন্ন প্রতীক বহন করে।

এ যাত্রায় পেচার মুখোশ দেখা যায়। হিন্দুদের বিশ্বাস অনুযায়ী পেচা মঙ্গলের অন্যতম প্রতীক। শুধু তাই নয়, তাদের অন্যতম দেবতা লক্ষীর বাহনও এটি। ঠিক তেমনি ইঁদুর গণেশ দেবতার বাহন। তাছাড়া হাসের ছবি ও প্রতিমা প্রচুর পরিমাণে দেখা যায় এ যাত্রায়, যা হিন্দুদের দেবী স্বরস্বর্তীর বাহন। হাতি, বাঘ এবং সিংহের মুখোশ ও প্রতিমাও প্রচুর পরিমাণে দেখা যায় এখানে। যেগুলো হিন্দুদের অন্যতম দেবী দূর্গার বাহন। একইসাথে গাভী, যা রামের সহযাত্রী, ময়ূর কার্তীকের বাহন, ক্ষীপ্ত ষাড় যা দেবাদীদেব মহাদেবের বাহন।

এছাড়াও তাদের অন্যতম দেবতা হলো সূর্য দেবতা, হিন্দু ধর্মালম্বীরা তাকে পূজা করে কল্যাণ ও আলোকময় জীবনের আশায়। তার আদলে মঙ্গল শোভাযাত্রায় সূর্যের মুখোশ প্রচুর পরিমাণে দেখা যায়।

বাঙালি মুসলিম সমাজের প্রতিক্রিয়া

৯০ ভাগ মুসলমানের দেশে ঐতিহ্যগত একটি বিশেষ দিনে এ মঙ্গল শোভাযাত্রা কাম্য নয়। কারণ মুসলমানদের ধর্মের বিশ্বাস অনুযায়ী, ভাগ্যের নির্ধারণকারী এবং সকল কল্যাণ বা মঙ্গলের মালিক একমাত্র আল্লাহ, আর এসব মুখোশ প্রতিমার ছাপ বা ছবি বহন করা শিরক।

পবিত্র কোরআনে সুস্পষ্ট বলা আছে: (ক.) মূর্তিপূজা শয়তানের কাজ (মায়েদা ৯০) এবং (খ.) “এই মূর্তিগুলো কী, যাদের তোমরা পূজারী হয়ে বসে আছ?” (আম্বিয়া ৫২)।

‘তোমরা পরিহার কর অপবিত্র বস্তু অর্থাৎ মূর্তিসমূহ এবং পরিহার কর মিথ্যাকথন।’ -সূরা হজ্জ: ৩০

এরকম আরও অসংখ্য আয়াত মুসলমানদের কুরআনের আলোকে লক্ষ্য করা যায়, যা এই শোভাযাত্রার সাথে পুরোপুরি সাংঘর্ষিক।

সুতরাং মুসলমান ধর্ম অনুযায়ী এ শোভাযাত্রা পুরোপুরি হারাম। ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের বিশ্বাস এ যাত্রা বিশেষ দিনটির উৎসবকে বিঘ্নিত করে।

মঙ্গল শোভাযাত্রার শুরু

সংবাদপত্র থেকে যতোটা ধারণা পাওয়া যায়, ১৯৯৬ সাল থেকে চারুকলার এই আনন্দ শোভাযাত্রা মঙ্গল শোভাযাত্রা হিসেবে নাম লাভ করে। তবে বর্ষবরণ উপলক্ষে আনন্দ শোভাযাত্রা চারুকলায় ১৯৮৯ সালে শুরু হলেও এর ইতিহাস আরো কয়েক বছরের পুরানো।

১৯৮৬ খ্রিষ্টাব্দে চারুপীঠ নামের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান যশোরে প্রথমবারের মতো নববর্ষ উপলক্ষে আনন্দ শোভাযাত্রার আয়োজন করে। যশোরের সেই শোভাযাত্রায় ছিল - পাপেট, বাঘের প্রতিকৃতি, পুরানো বাদ্যযন্ত্রসহ আরো অনেক শিল্পকর্ম। শুরুর বছরেই যশোরে শোভাযাত্রা আলোড়ন তৈরি করে। পরবর্তীতে যশোরের সেই শোভাযাত্রার আদলেই ঢাকার চারুকলা থেকে শুরু হয় বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা।

পর্যবেক্ষকদের চিন্তা

এ বিষয়ে কয়েকজন পর্যবেক্ষকের কাছে জানতে চাইলে তারা বলেন, সময়ের পরিবর্তণের সাথে সাথে পহেলা বৈশাখের উৎসবের সাথে যোজন-বিয়োজন করা হয়েছে নানভিদ বিষয়। যা তৈরি করেছে নানা বিতর্কের। গোটা বাঙালি জাতির কাছে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উৎসব পহেলা বৈশাখ। কোন বিতর্ক যদি উৎসবকে ম্লান করে, তাহলে বিতর্কিত বিষয়গুলো বাদ দেয়াই শ্রেয়।

পরিশেষে, বাঙালির প্রাণের উৎসব পহেলা বৈশাখ। নিজস্ব সত্তা ও গৌরবময় ঐতিহ্যের বর্ষবরণের দিন এটি।

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
মঙ্গল শোভাযাত্রা,বর্ষবরণ,বিতর্ক,পহেলা বৈশাখ
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close