reporterঅনলাইন ডেস্ক
  ২৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২২

সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের ধারক পাঙাল সম্প্রদায়

ছবি : প্রতিদিনের সংবাদ

বাংলাদেশে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর সঙ্গে স্বকীয় সত্তা বজায় রেখে সহাবস্থানকারী একমাত্র মুসলিম ধর্মাবলম্বী ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী হলো মণিপুরি মুসলিম (পাঙাল)। মূলস্রোতের সঙ্গে দীর্ঘকাল ধরে বসবাস সত্ত্বেও পাঙালরা তাদের নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে ধারণ করে আসছে। এই নিবন্ধে তার কিছু আলোকপাত করছি :

১. পোশাক-পরিচ্ছদ : ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় ও বংশ পরম্পরায় ঐতিহ্যবাহী পোশাকের প্রচলন হয়ে আসছে। পাঙালদের আদি পিতা মুসলিম হওয়ার কারণে পুরুষরা বাঙালিদের ন্যায় শার্ট, পেন্ট, পাঞ্জাবি, পায়জামা, লুঙ্গি ইত্যাদি পরিধান করে থাকে। আর আদি মাতা মণিপুরি হওয়ার কারণে মণিপুরিদের ন্যায় নিজস্ব তাঁতে তৈরি ফানেক (পরনের কাপড়), খুদাই/ইন্নাফি (ওড়না), ব্লাউজ পরিধান করে থাকে। অবিবাহিত নারীরা লাই, সালু, হাংগামপাল, সোনারং, চুমহাপ্পা, মাকং ইত্যাদি ফানেক পরে থাকে। বিবাহিত মহিলারা ভিন্ন রং ও ডিজাইনের - লৈফানেক আরোলবা, মায়ায়রনবি, সালু ফানেক আরোলবা, লৈচিল, হৈরেং আরোলবা, উরেং চুমহাপ্পা ইত্যাদি পরিধান করে থাকে। কোমরে প্যাচানো থাকে খোয়াং নাম্ফি (ছোট কাপড়)। সামাজিক যেকোনো অনুষ্ঠানে ট্রাডিশনাল ড্রেস পরা বাধ্যতামূলক। বিবাহিত মহিলারা এক ধরনের বোরকা ও ছাতা ব্যবহার করে, যা অন্য সমাজে দৃষ্টিগোচর হয় না। কলকাতা থেকে প্রকাশিত 'মাসিক মোহাম্মদি' পত্রিকায় মতিন উদ্দিন লিখেন-

The Manipuri Muslim women did never come out on the street as half nacked.Full sleeve jacket entirely bottomed up to nick, dressed up to the sole of the feet scarf on it.....an umbrella on head.Face or any part of the body of any Manipuri Muslim women (Except the finger of hand and feet) can never see on the street.

বর্তমানে নারীরা সেলোয়ার-কামিজ, ম্যাক্সি, শাড়ি, বোরকা ইত্যাদিও পরিধান করে থাকে।

২. বিবাহ : পাঙাল সম্প্রদায়ের বিবাহরীতি বাঙালি থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের। এ সমাজে ঘটক প্রথা চালু নেই। বিবাহের আনুষ্ঠানিকতা কতগুলো পর্যায়ে বিভক্ত থাকে। বিয়ের আনুষ্ঠানিক পর্বের শুরুতেই ছেলেপক্ষের নিকট আত্মীয়রা কনের বাড়িতে গিয়ে বিয়ের প্রস্তাব দেয় এবং একে বলা হয় 'হায়জাবা কাবা'। এ পর্বে দেনমোহর সংক্রান্ত কথাবার্তা ঠিক করা হয়। অতঃপর চূড়ান্ত বাগদান পর্বের জন্যে অনুষ্ঠিত হয় 'কাপুবা' বা পানচিনির ব্যবস্থা। এ পর্বে ফলমূল, মিষ্টি, পান, সুপারি ইত্যাদি নিয়ে বরপক্ষের লোকজন কনের বাড়িতে যায় এবং আনুষ্ঠানিকভাবে বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক করে। বিয়ের আগের দিন রাতব্যাপী বর-কনের বাড়িতে আলাদা আলাদাভাবে একটা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকে। এটাকে বলা হয় 'পুরজাক'। পুরজাক অনুষ্ঠানে কনের পরনে থাকে 'কমিন' (বিশেষ ধরনের পোশাক) এবং খেমচি ব্লাউজ ও মাথায় থাকে ব্যতিক্রমী কাজ ও ফুল দিয়ে ঝালর দেওয়া 'লৈত্রেং' (গোলাকার)। সঙ্গে পরে ঐতিহ্যবাহী স্বর্ণালংকার।

অন্যদিকে বর থাকে স্বাভাবিক সাজে। বর ও কনের উভয় অনুষ্ঠানে রাতব্যাপী চলে ঐতিহ্যবাহী গান। যুবক-যুবতীসহ বিবাহিত লোকজনও গানের উৎসবে মেতে ওঠে এবং সঙ্গে যুক্ত হয় 'থাবালচোংবা' (নৃত্য)। যুবক-যুবতীসহ সবাই যৌথভাবে কিংবা আলাদাভাবে অংশগ্রহণ করে থাকে। পরেরদিন বর বাঙালিদের ন্যায় পায়জামা, পাঞ্জাবি, শেরওয়ানি ইত্যাদি পরিধান করে বন্ধুবান্ধবসহ পঞ্চায়েতের লোকজন নিয়ে (পঞ্চায়েতের লোকজন বরযাত্রী হিসেবে যাওয়া বাধ্যতামূলক) বরযাত্রীর দল রওয়ানা দেয়। এ সময় মা-বাবা ও মুরব্বিদের সালাম করে ও দোয়া নিয়ে ঐতিহ্যবাহী চাদর 'কাংথমফিদা'-র ওপর পা দিয়ে যাত্রা করার রেওয়াজ রয়েছে। আগের দিনে বরযাত্রা করতো হাতি, পালকি দিয়ে কিন্তু বর্তমানে কার, লাইটেস নিয়ে কনের বাড়িতে পৌঁছায় এবং মুরব্বিদের অনুমতি পাওয়ার পর প্রবেশ করে। কনের বাড়ির উঠানে কাংথমফিদায় বরযাত্রীদের বসানো হয়। নিজস্ব ভাষায় বরযাত্রীদের পক্ষ থেকে গান পরিবেশন করা হয়। মহল্লার ইমাম সাহেব ইসলামি তরিকায় কোরআন সুন্নাহ মোতাবেক বিয়ে পড়ান। তিনজন 'গাওয়া-উকিল' (১ জন উকিল ও ২ জন সাক্ষী) থাকে এবং উকিলের হাতে থাকে একটি লাঠি। বর ও কনে আলাদাভাবে নিচুস্বরে কবুল বলে থাকে এবং গাওয়া-উকিল তার সাক্ষী হয়। বৃটিশ পিরিয়ডের পরবর্তীকাল থেকে পাঞ্জাবি, পায়জামা ও শেরওয়ানির প্রচলন শুরু হয়েছে। ইদানিং কনের পরনে বাঙালিদের ন্যায় বিয়ের শাড়ির ব্যবহারও লক্ষ করা যায়। বৃটিশ ও পাকিস্তান আমলে বরের পরনে থাকতো ধুতি। সে সময় হাতি ও পালকির প্রচলন ছিল, যা বর্তমানে নেই। বিয়ের পর 'ঙাইসেল-খাংনাবা' অর্থাৎ একে অন্যকে দাওয়াত দিয়ে পরিচয়পর্বের আনুষ্ঠানিকতাও রয়েছে।

৩. ঐতিহ্যবাহী কাঠের বাড়ি : পাঙালদের ঐতিহ্যবাহী বাড়ি-বিশেষ কারুকাজ, বৈশিষ্ট্য ও নিপুণ কারিগরের এক শৈল্পিক সৃষ্টি। সব বাড়িই কাঠের তৈরি, প্রায় সমান কারুকাজ, উপরে শন/টিন।পূর্ব-পশ্চিমমুখী বাড়িকে বলা হয় "সাংগাই' এবং উত্তর-দক্ষিণমুখি কিংবা অন্যমুখী বাড়িকে বলা হয় 'সাংফাই'। প্রতিটি বাড়িতে কমপক্ষে ২১/২২ টি খুটি (তারেং) থাকে এবং কক্ষগুলোর ভিন্ন ভিন্ন নাম রয়েছে। যেমন, পিবা কা (ছেলের কক্ষ), বাড়ির ডানদিকে নিঙোল কা (মেয়ের কক্ষ), ভিতরে মাইবা কা (মা-বাবার কক্ষ), ফামুং কা (বাসর ঘর), সামনের দিকে ফুংগা (রান্না ঘর)। তিন পাওয়াবিশিষ্ট জসবি (এংগেল) দিয়ে তৈরি বিশেষ ধরনের চুলা থাকে বাড়ির ভেতরে সোজা মূল দরজা বরাবর।

এই ঐতিহ্যবাহী বাড়ি আজ অনেকটা অতীত ও বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে। কালের সাক্ষী হিসেবে কয়েকটি বাড়ি সংরক্ষিত রয়েছে।

৪. গান : পাঙালদের ঐতিহ্যবাহী গানগুলো হলো- কাসিদা (ফার্সি ভাষা), ইন্দারসাফা (উর্দু ভাষা), খুনুং, খুলং, জাগোই, থাবাল, মারিফত, কাওয়ালী, নাত, গজল, আসেমবা (স্বরচিত) ইত্যাদি ঐতিহ্যবাহী গান। তাছাড়া ওয়ারি লীবা (গল্পবলা)ও খুবই জনপ্রিয় আইটেম। প্রতিটি গ্রামে কমপক্ষে ২/৩ টি গানের দল থাকতো। গানের প্রতিযোগিতা হতো বিয়ের অনুষ্ঠান অথবা অন্য কোনো বিশেষ অনুষ্ঠানে। ছেলে ও মেয়ের উভয় দলে ২/৩ জন সদস্য থাকতো এবং পাল্টাপাল্টি গানের প্রতিযোগিতা হতো বিপুল দর্শকের উৎসাহ ও উদ্দীপনায়। গানের প্রতিযোগিতা রাত পাড় হয়ে ভোর অবধি চলতো। পরিশেষে মুরব্বিদের হস্তক্ষেপে প্রতিযোগিতার নিষ্পত্তি হতো। খালি গলায় গান পরিবেশন করা হতো, কোনো যন্ত্রাংশের ব্যবহার ছিল না। পাশ্চাত্য, হিন্দি ও বাংলা গানের প্রভাবে এই গানের আকর্ষণ ধীরে ধীরে কমে আসছে।

৫. খেলাধুলা : পাঙাল সম্প্রদায়ের স্বীয় বৈশিষ্ট্যপূর্ণ খেলাধুলার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- মুক্না (কুস্তি খেলার মতো), কাংজাই (হকি খেলার মতো), কাং ইত্যাদি। মুক্না খেলাটি বৃটিশ ও পাকিস্তান আমলে আন্তঃপাঙাল ক্রীড়াব মধ্যে সবচেয়ে আকর্ষণীয় খেলা ছিল। খেলা হতো এককভাবে। মুক্না খেলায় পাঙালদের মধ্যে প্রসিদ্ধ ছিলেন- মোঃ ইসলাম (কোনাগাঁও), মোঃ আব্দুর রশিদ খান (পশ্চিম জালালপুর), মোঃ আব্দুল হাই (পশ্চিম কান্দিগাঁও), মৌলানা আমির উদ্দিন (পশ্চিম কান্দিগাঁও) ও মোঃ আমির উল্লাহ (গোলেরহাওর)।

কাংজাই খেলাও জনপ্রিয় ছিল। আজ সময়ের অশান্ত স্রোতে এবং আন্তর্জাতিক ও জাতীয় খেলার প্রভাবে বিলীন হয়ে গেছে।

৬. পাঞ্চায়েত ব্যবস্থা : পাঙাল সম্প্রদায়ের পাঞ্চায়েত ব্যবস্থা খুবই সুদৃঢ়। যেকোনো ধরনের অনুষ্ঠান, যেমন- আকিকা, চল্লিশা (নুফনি), গর্ভবতী মহিলার খানা (থা মাপ্পাল), বার্ষিক সিরনি (কুম), মাঙাম ইত্যাদি সম্পূর্ণ পঞ্চায়েতের মাধ্যমে ও তত্ত্বাবধানে সম্পন্ন করা হয়। অনুষ্ঠান সম্পাদনে প্রয়োজনীয় উপাদান, যেমন- চাল,মাংস, মসলা, হাঁড়ি-পাতিল, লাকড়ি, মাদুর, পান-সুপারি ইত্যাদি সবকিছু পঞ্চায়েত থেকে সংগৃহীত হয়।

উল্লেখ্য, যেকোনো সিরনিতে ধনী-গরিব, শিক্ষিত-অশিক্ষিত নির্বিশেষে একত্রে সবাই মাটিতে বিছানো মাদুরে (ফিদা) বসে এবং পঞ্চায়েতের কোনো মুরব্বির বিসমিল্লাহ বলার মাধ্যমে সবাই বিসমিল্লাহ পড়ে খাওয়া শুরু করে, যা অন্যত্র দৃষ্টিগোচর হয় না। এখানে গরু ও মুরগির মাংস ইত্যাদির সঙ্গে ঐতিহ্যবাহী তরকারি য়ামথাকপা (হালিমের মতো) ও এরি (মাংসের ঝোল) পরিবেশন করা হয়। তাছাড়া পাঙাল সম্প্রদায়ের কোনো লোক মারা গেলে- আত্মীয়-স্বজনসহ সমাজের সবাইকে মৃত্যু সংবাদ পৌঁছানো পঞ্চায়েতের দায়িত্ব।

এখানে উল্লেখ্য যে, মৃত্যুসংবাদ যেকোনো গ্রামের শুধু একজনকে জানিয়ে দিলে এক ঘর থেকে অন্য ঘরে, এভাবে গ্রামের সর্বত্র সংবাদ পৌঁছে দেয়, যা প্রত্যেকে নিজ দায়িত্ব মনে করে পালন করে থাকে। ইদানিং মোবাইল ফোনের মাধ্যমেও মৃত্যু সংবাদ পৌঁছানো হয়। মৃত্যুর দিন ঐ পরিবারের খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করা, গরিব-দুঃখীদের মধ্যে চাল ও টাকা বিতরণ করা এবং রাতের বেলা কেউ মারা গেলে সারারাত জেগে দোয়া দরুদ পড়া, কোরআন তেলাওয়াত এবং দাফন-কাফনের পর কোরআন খতম করানোসহ যাবতীয় কাজ পঞ্চায়েত সম্পাদন করে থাকে।

৭. সাগৈ/গোত্র : পাঙালদের মধ্যে মোট ৭৩টি সাগৈ/গোত্র রয়েছে। তার মধ্যে নিম্নোক্ত গোত্রের লোক বাংলাদেশে রয়েছে। যেমন –

আরিবম, ময়চিং, ময়নাম, ইফাম, থৌবাল, কিয়াংবাই, কাইনৌ, কন্থা, সাজবম, তাংথং, তামপাকনাই, ইংখাম, য়ুমখাইবম, নবাব, সারা, লাবুকতং, সাংগমসুম্বা, কাইথেল ইংখল, কাউচিং, সিংগামায়ুম ইত্যাদি।

৮. শিশুর নামকরণ : পাঙালরা বাঙালিদের ন্যায় শিশুর নামকরণ করলেও কিছু নিজস্বতাও রয়েছে। ছেলেদের নামকরণ : আচাউ, আবুং, আমুদল, আমুচাউ, আঙাউ, চাউরেল, চাউতেল, তলেন, তনজাও, পিতু, পিশাক, মুথই, মুরেল, মাজাউ ইত্যাদি। মেয়েদের নামকরণ : ইবেমহাল, ইবেথই, খইনু, ঙাউবি, তনু, তম্বিসানা, সানাতম্বি, সানানু, সানারাই, থরো, লেহাউ, জাউবি ইত্যাদি।

পাঙাল সম্প্রদায়ের গৌরবময় ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি টিকিয়ে রাখা ও বিলুপ্তি থেকে রক্ষার জন্যে সামাজিক আন্দোলন এবং সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা খুবই অত্যাবশ্যক।

লেখক : সাজ্জাদুল হক স্বপন, শিক্ষক ও লেখক

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
মৌলভীবাজার,ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী,মণিপুরি মুসলিম,পাঙাল সম্প্রদায়
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close