নিজস্ব প্রতিবেদক

  ১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২২

বইমেলার দুয়ার খুলছে আজ

‘বইমেলা’ কিংবা ‘গ্রন্থমেলা’ শব্দ দুটির যেকোনো একটি শুনলেই আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে বাংলা একাডেমি আয়োজিত একুশে বইমেলা। যে মেলা বইপ্রেমী মানুষের প্রাণে দোলা দেয়। কোনো এক অদৃশ্য শক্তিবলে লাখো মানুষকে টেনে আনে একাডেমির বর্ধমান হাউস প্রাঙ্গণে। বর্ধমান হাউস ও এর আশপাশ ঘিরে জমে ওঠে লেখকদের জমজমাট আড্ডা। কাটে লেখক-প্রকাশকদের নির্ঘুম রাত। প্রকাশিত হয় হাজার হাজার বই। নতুন বইয়ের ম-ম ঘ্রাণে মোহিত হন মেলায় আসা ক্রেতা-দর্শনার্থীরা। বিক্রি হয় লাখ লাখ কপি বই। ভিড় ঠেলে প্রয়োজনীয় বইটি হাতে পাওয়ার পর আনন্দে চিক চিক করে ওঠে মুখ।

প্রতি বছর পুরো ফেব্রুয়ারি মাস এই মেলা বাংলা একাডেমির বর্ধমান হাউস প্রাঙ্গণে হয়। তবে ২০১৪ সাল থেকে অমর একুশে গ্রন্থমেলা বাংলা একাডেমির মুখোমুখি সোহরাওয়ার্দী উদযানে সম্প্রসারণ করা হয়েছে। প্রতি বছর স্বাভাবিক অবস্থায় ফেব্রুয়ারির ১ তারিখ থেকে শুরু হয় অমর একুশে বইমেলা। তবে করোনা পরিস্থিতির কারণে এবার দুই সপ্তাহ দেরিতে মঙ্গলবার (১৫ ফেব্রুয়ারি) শুরু হচ্ছে এ মেলা। আজ বিকেল ৩টায় ভার্চুয়ালি অমর একুশে বইমেলার উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এদিন বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কারও দেওয়া হবে। এ বছর ১১টি ক্যাটাগরিতে ১৫ জন গুণী সাহিত্যিক এ পুরস্কার পাচ্ছেন। অমর একুশে গ্রন্থমেলা আমাদের কাছে ব্যাপকভাবে একুশে বইমেলা নামেই পরিচিত। স্বাধীন বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী মেলাগুলোর মধ্যে অন্যতম এই মেলার ইতিহাস স্বাধীন বাংলাদেশের মতোই প্রাচীন।

যতদূর জানা যায়, ১৯৭২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি চিত্তরঞ্জন সাহা বাংলা একাডেমির বর্ধমান হাউসের সামনের বটতলায় এক টুকরো চটের ওপর কলকাতা থেকে আনা ৩২টি বই সাজিয়ে বইমেলার শুরু করেন। এই ৩২টি বই ছিল চিত্তরঞ্জন সাহা প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন বাংলা সাহিত্য পরিষদ (বর্তমানে মুক্তধারা প্রকাশনী) থেকে প্রকাশিত মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতে অবস্থানকারী বাংলাদেশি শরণার্থী লেখকদের লেখা বই।

১৯৭৩ সালে বাংলা একাডেমি মহান একুশে মেলা উপলক্ষে ১৫ থেকে ২১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বিশেষ হ্রাস করা মূল্যে একাডেমি প্রকাশিত বই বিক্রির ব্যবস্থা করে। এর পাশাপাশি মুক্তধারা, স্ট্যান্ডার্ড পাবলিশার্স এবং এদের দেখাদেখি আরো কেউ কেউ বাংলা একাডেমির মাঠে নিজেদের বই বিক্রির ব্যবস্থা করে।

১৯৭৪ সালে বাংলা একাডেমি ১৪ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সাহিত্য সম্মেলনের আয়োজন করে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ওই সম্মেলনের উদ্বোধন করেন। এ উপলক্ষে বাংলা একাডেমি তার নিজস্ব প্রকাশিত বই প্রদর্শন ও ম্যুরাল প্রদর্শনীর আয়োজন করে। বই প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন প্রফেসর আবু মহাম্মেদ হবীবুল্লাহ। ওই গণজমায়েতকে সামনে রেখে ঢাকার বিভিন্ন প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান একাডেমির পূর্বদিকের দেয়াল বরাবর নিজেদের পছন্দমতো জায়গায় যে যার মতো কিছু স্টল নির্মাণ করে বই বিক্রির ব্যবস্থা করে। এতে বাংলা একাডেমির কোনো ভূমিকা ছিল না, শুধু মাঠের জায়গাটুকু দেওয়া ছাড়া।

১৯৭৫ সালে একাডেমি মাঠের কিছু জায়গা চুনের দাগ দিয়ে প্রকাশকদের জন্য নির্দিষ্ট করে দেয়। প্রকাশকরা যে যার মতো স্টল তৈরি করে বই বিক্রির ব্যবস্থা করেন। এ অবস্থা চলতে থাকে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত। এ সময় পর্যন্ত এই আয়োজনের কোনো স্বীকৃতি ছিল না। কোনো নামও দেওয়া হয়নি। সংবাদপত্রের প্রতিবেদনেও এর কোনো উল্লেখ থাকত না।

১৯৭২ থেকে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত বাংলা একাডেমির অনুষ্ঠানসূচিতেও এই কার্যক্রমের কোনো উল্লেখ করা হয়নি।

১৯৭৮ সালে বাংলা একাডেমির তৎকালীন মহাপরিচালক আশরাফ সিদ্দিকী বাংলা একাডেমিকে মেলার সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত করেন।

১৯৭৯ সালে মেলার সঙ্গে যুক্ত হয় বাংলাদেশ পুস্তক বিক্রেতা ও প্রকাশক সমিতি। এই সংস্থাটিও প্রতিষ্ঠা করেছিলেন চিত্তরঞ্জন সাহা। ওই সময় অমর একুশে উপলক্ষে ৭ থেকে ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বইমেলা অনুষ্ঠিত হতো। মেলার তখন নাম ছিল একুশে গ্রন্থমেলা।

১৯৮১ সালের একুশে বইমেলার মেয়াদ কমিয়ে ২১ দিনের পরিবর্তে ১৪ দিন করা হয়। কিন্তু প্রকাশকদের দাবির মুখে ১৯৮২ সালে মেলার মেয়াদ পুনরায় বৃদ্ধি করে করা হয় ২১ দিন। মেলার উদ্যোক্তা বাংলা একাডেমি। সহযোগিতায় ছিল জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র এবং বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতি।

১৯৮৩ সালে মেলার সহযোগী প্রতিষ্ঠান হিসেবে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রকে বাদ দেওয়া হয়। ১৯৮৪ সাল থেকে এই মেলার নতুন নামকরণ করা হয় ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’।

প্রকাশকদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে বাড়ানো হয় মেলার পরিসর। সেই ৩২টি বইয়ের ক্ষুদ্র মেলা কালানুক্রমে বাঙালির প্রাণের বইমেলায় পরিণত হয়েছে। পরিণত হয়েছে লেখক-প্রকাশক পাঠকদের মহামিলন তীর্থে।

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
বইমেলা,বাংলা একাডেমি,অমর একুশে গ্রন্থমেলা
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close