reporterঅনলাইন ডেস্ক
  ০৪ জানুয়ারি, ২০২২

নূরলদিন, স্বাধীনতাকামী একজন কৃষকের গল্প 

ছবি : ইন্টারনেট

‘নিলক্ষা আকাশ নীল, হাজার হাজার তারা ঐ নীলে অগণিত আর

নিচে গ্রাম, গঞ্জ, হাট, জনপদ, লোকালয়, আছে ঊনসত্তর হাজার।’

সৈয়দ শামসুল হকের সাড়াজাগানো ‘নূরলদীনের সারাজীবন’ কবিতাটির শুরুর লাইন এই দুটি। আর শেষে রয়েছে সেই গভীর উচ্চারণ জাগো বাহে কোনঠে সবায়। রংপুরের কৃষক বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেওয়া নূরলদীন ছিলেন স্বাধীনতাকামী একজন কৃষক, ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতাসংগ্রামের প্রাণপুরুষ। তাঁর আসল নাম ছিল নূরুউদ্দীন মোহাম্মদ বাকের জং। ইংরেজ শাসন উৎখাতে ১৭৬০ থেকে ১৭৮৩ সাল পর্যন্ত অসংখ্যবার সম্মুখযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিলেন তিনি।

বাংলা অঞ্চল তখন পার করছিল হাহাকারময় সময়। তারপরও অত্যাচার, নিপীড়ন আর লুণ্ঠনের মাধ্যমে অর্জিত টাকায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অবস্থা তখন খুবই রমরমা। রাজস্ব ক্ষমতা হাতে পেয়ে ইংরেজরা তখন চালু করেছিল ইজারাদারি প্রথা। আর এই ইজারাদারি ব্যবস্থায় রংপুর, দিনাজপুরের ইজারাদারি লাভ করেন একজন অত্যাচারী জমিদার দেবী সিংহ। নূরলদীন ও তাঁর বাহিনীর লড়াই ছিল কৃষক স্বার্থবিরোধী এই ইজারাপ্রথার বিরুদ্ধে।

রংপুর জেলা প্রশাসকের সম্পাদনায় রংপুর জেলার ইতিহাস, মুহম্মদ মনিরুজ্জামানের রঙ্গপুরের প্রাচীন ইতিহাস (প্রথম খণ্ড) এবং লালমনিরহাট জেলা তথ্য বাতায়নের ‘ইতিহাসে মোগলহাট ইউনিয়ন’ লেখা থেকে জানা যায় একাধিক সম্মুখযুদ্ধের কাহিনি। তেমনই একটি লড়াই হয়েছিল ১৭৮৩ সালের জানুয়ারি মাসে। রংপুর-দিনাজপুর, কোচবিহার ও জলপাইগুড়ির (বর্তমানে ভারত) বিদ্রোহী প্রজারা লালমনিরহাট জেলার পাটগ্রামে অবস্থান করছিলেন। ইংরেজ-সমর্থিত জমিদাররা তখন প্রাণভয়ে আত্মগোপন করেন।

নূরলদীনের নেতৃত্বে একটি দল পাটগ্রামের মোগলহাটে পৌঁছায়। নূরলদীনের সঙ্গে কতজন সৈন্য আছেন, সেটা আন্দাজ করতে না পেরে ইংরেজ বাহিনী তাদের দুজন সৈন্যকে কৃষকদের পোশাক পরিয়ে নূরলদীন বাহিনীর পেছনে পাঠিয়ে দেয়। উদ্দেশ্য ছিল গোয়েন্দাগিরি করে নূরলদীন বাহিনীর তথ্য জানা। একপর্যায়ে নূরলদীন প্রধান দুই সহযোগী লালমনি,দয়াশীলসহ তাঁর বাহিনী নিয়ে ইংরেজদের সঙ্গে সামনাসামনি যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। একজন ইংরেজ সৈন্য পেছন দিক থেকে এসে নূরলদীনকে অতর্কিত আক্রমণ করে বসে। নূরলদীন মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। লালমনিসহ অন্যরা তৎক্ষণাৎ নূরলদীনকে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সরিয়ে নিয়ে যান। যুদ্ধে দয়াশীল নিহত হন। আহত নূরলদীনকে তিস্তা নদীতীরবর্তী এলাকায় নিয়ে সেবা করতে থাকেন লালমনি। এদিকে ইংরেজ বাহিনী হন্য হয়ে নূরলদীনকে খুঁজতে থাকে। উপায় না দেখে গভীর রাতে তিস্তা নদী পার হয়ে রংপুরের মিঠাপুকুরের কাছে ফুলচৌকি গ্রামে নূরলদীনকে নিয়ে যাওয়া হয়, যেটি তাঁর নিজের গ্রাম। আহত অবস্থায় ১৭৮৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি নূরলদীন ফুলচৌকির নিজ বাড়িতে মারা যান। সেখানেই তাঁকে সমাহিত করা হয়।

কবি সৈয়দ শামসুল হক, তার কবিতায় কিছু সাড়া জাগানো উক্তি লিখে গেছেন। যা দেশকে শত্রুমুক্ত রাখতে আমাদের প্রেরণা যোগায়

“এই তীব্র স্বচ্ছ পূর্ণিমায়/নূরুলদীনের কথা মনে পড়ে যায়।” ১১৮৯ সনের একদিন নূরলদীন রংপুরের মানুষকে ডাক দিয়েছিলেন। সেদিনও ছিল এমন তীব্র স্বচ্ছ পূর্ণিমা। কালঘুম যখন বাংলায় সেদিনও হানা দিয়েছিল শত্রুরা। সরল কৃষকেরা তাদের ফসলের অধিকার চেয়েছিল, তাই বিদেশি শাসকরা করেছিল জবরদস্তি অবিরাম। বিদেশিদের অন্যায় শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য সেদিন কৃষকদের ডাক দিয়েছিলেন নূরলদীন। আজও হঠাৎ সেই দুঃসময় হানা দিয়েছে বাংলায়। তাই নূরুলদীনের কথা মনে পড়ে যায়।

যখন শকুন নেমে আসে এই সোনার বাংলায়;” হানাদার শত্রুরা শকুনের রূপ ধরে আসে এই বাংলায়। শকুন যেমন তার প্রাণবন্ত খাদ্যবস্তুকে নখরে ছিন্নভিন্ন করে শক্ত ঠোঁটে ছিঁড়ে খায়, তেমনি শত্রুরাও নির্বিচারে এদেশের মানুষকে যত্রতত্র হত্যা করে শকুনের মতো নির্মম হাতে।

যখন আমার দেশ ছেয়ে যায় দালালের আলখেল্লায় শকুনেরা আবার হানা দেয় ১৯৭১-এ এই বাংলায়। চালায় নিমর্ম হত্যাযজ্ঞ এদেশীয় দোসর দালালদের সহযোগিতায়। সারা দেশ ছেয়ে যায় ঘৃণ্য দালাদের আলখেল্লায়।

যখন আমার স্বপ্ন লুট হয়ে যায় বাংলার মনোরম প্রকৃতির কোলে লালিত সহজ-সরল মানুষের শান্তিপূর্ণ জীবনের স্বপ্ন ছিল। সে জীবন বাংলার ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতিকে ঘিরে আবর্তিত। ঘৃণ্য হানাদারদের ষড়যন্ত্র আর নিষ্টুরতায় সেই স্বপ্ন ভেঙে যাওয়ার উপক্রম হলে নূরলদীনের কথা সংগতভাবেই মনে পড়ে যায়।

যখন আমারই দেশে এ আমার দেহ থেকে রক্ত ঝরে যায় ইতিহাসে, প্রতিটি পৃষ্ঠায়। বাংলার ইতিহাসের প্রতিটি পৃষ্ঠায় বিদেশি শত্রুদের ষড়যন্ত্র শোষণ আর রক্ত ঝরার কথা রয়েছে। ১৭৫৭, ১৮৫৭, ১৯৩০, ১৯৫২, ১৯৬৯, ১৯৭১ সালে এই বাংলায় নির্বিচারে চলেছে গুলি। আমারই দেশে এ আমার দেহ থেকে অজস্র রক্ত ঝরেছে, হত্যা করা হয়েছে অসংখ্য স্বাধীনতাকামী নিরপরাধ মানুষকে।

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
নূরলদিন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close