ফারহান ইশরাক

  ১২ এপ্রিল, ২০২১

বইমেলা কি পুরোনো রূপ হারাচ্ছে

বইমেলা বাঙালির এক আবেগের নাম। বছরজুড়ে সাহিত্যপ্রেমীরা অপেক্ষায় থাকে এই বইমেলার। বাংলা সাহিত্যের বিকাশ, পাঠকদের মননশীলতার উৎকর্ষ সাধনে বইমেলা বছরের পর বছর ধরে তাৎপর্যময় ভূমিকা রেখে চলছে। স্বাধীনতার কয়েক বছর পর বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে স্বল্প পরিসর নিয়ে শুরু হওয়া বইমেলা বিস্তার লাভ করেছে শতবর্ষী বৃক্ষের ন্যায়। তার সহস্র ডালপালা, শাখা-প্রশাখায় জন্ম নিয়েছে বাংলা সাহিত্যের অমূল্য সব রত্ন। একটা সময়ে এই বইমেলা-ই হয়ে উঠেছিল অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার, প্রতিবাদী হওয়ার প্রধান মাধ্যম। স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশে জনগণের বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশে বইমেলা সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। এর মাধ্যমে ভিন্নধারার একটি সাংস্কৃতিক বিপ্লব গড়ে উঠেছে; স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তি ও মৌলবাদের উদ্ধত কালো হাতকে গুঁড়িয়ে দিতে যে বিপ্লব শক্তি জুগিয়েছে বাঙালি জাতিকে। বই নিয়ে উৎসব, বইমেলা দিনে দিনে পরিণত হয়েছে বাঙালির প্রাণের উৎসবে, সাহিত্যপ্রেমীদের মিলনমেলায়।

প্রতি বছর বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে আয়োজিত এই বইমেলা তৈরি করেছে নতুন নতুন পাঠকশ্রেণি। প্রযুক্তির বিস্ময়কর আধিপত্যের এই যুগে সব পাঠাগার, বিশ্বসভ্যতার শ্রেষ্ঠ বইভান্ডার যখন মানুষের হাতের মুঠোয়, তখনো একটি নির্দিষ্ট পাঠকসমাজ ছাপার হরফে প্রকাশিত বই কিনতে ছুটছে বইমেলার দিকে। স্রোতের বিপরীতে অথচ মননশীলতার পানে পাঠকদের নিরন্তর ছুটে চলার এই পথে জ্বালানি হিসেবে কাজ করেছে বইমেলা। দেশের প্রকাশনা জগৎও নতুন করে প্রাণ পেয়েছে এর মাধ্যমে। বছরজুড়ে অপেক্ষা শেষে মহান ভাষা আন্দোলনের মাস ফেব্রুয়ারিতে এসে লেখক, পাঠক, প্রকাশকদের মোহনায় বাঙালির বুদ্ধিবৃত্তিক স্রোত যেন নতুন গতি লাভ করে। শুধু বই প্রকাশ বা বেচাকেনা-ই নয়; বরং সাহিত্য আড্ডা, বই নিয়ে আলোচনা, সমালোচনা, দেশবরেণ্য লেখকদের পদচারণায় মুখর থাকে বইমেলা প্রাঙ্গণ। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে অমর একুশে গ্রন্থমেলা হলো বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রধানতম উৎসব।

গত শতাব্দীর শেষ দশকে কিংবা এই শতাব্দীর শুরুর দশকে বইমেলা বইপ্রেমীদের মাঝে যেভাবে তুমুল প্রাণসঞ্চার সৃষ্টি করেছিল, বাংলা সাহিত্যের ভান্ডারকে মানসম্মত সাহিত্যকর্মে সমৃদ্ধ করেছিল, গত কয়েক বছরে সে অবস্থান থেকে অনেকাংশেই স্খলন ঘটেছে তার। বাঙালির সার্বজনীন এই উৎসব ধীরে ধীরে ব্যবসাকেন্দ্রে পরিণত হচ্ছে। আগে নতুন বইয়ের সংখ্যা কম থাকলেও সাহিত্যের বিচারে তা ছিল মানসম্মত, বিপুলসংখ্যক পাঠককে তা আকর্ষণ করত। কিন্তু এখন প্রতিদিন শত শত নতুন বই প্রকাশিত হলেও পাঠকসমাজে আলোড়ন সৃষ্টিকারী বইয়ের সংখ্যা খুবই নগণ্য। প্রতি বছর মেলায় নতুন নতুন লেখকদের আবির্ভাব ঘটছে, আরেকটি বছর আসার আগে তারা হারিয়েও যাচ্ছে। আবার সে স্থান দখল করে নিচ্ছে নতুন আরেকদল লেখক। তাদের পরিণতিও কালের অতল গহ্বরে হারিয়ে যাওয়া উঠতি লেখকদের মতোই। নতুন লেখকরা গুণগত বই উপহার দিতে পারছেন না, যার ফলে সাহিত্যের জগতে থিতু হওয়াও সম্ভব হচ্ছে না তাদের পক্ষে। নবীন লেখকরা যে একেবারেই ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে পারছেন না, তা নয়; তবে সে সংখ্যা নেহায়েতই ধর্তব্যের বাইরে।

আবার ইদানীংকালে বই প্রকাশের ক্ষেত্রে নতুন একটি ধারা চালু হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের পরিচিত মুখ, জনপ্রিয় তারকারা মহাসমারোহে নতুন বই প্রকাশ করছেন। বইগুলো কখনো দক্ষতা উন্নয়ন বিষয়ক, রম্য কিংবা অনর্থক কিছু শব্দের এলোমেলো ছড়াছড়ি। কিন্তু দিন শেষে দেখা যাচ্ছে, বিক্রয় সংখ্যার দিক থেকে তাদের বইগুলো-ই রয়েছে তালিকার শীর্ষে। পাঠকরা সানন্দে তাদের বই কিনছেন ও পড়ছেন, ব্যাপারটি কিন্তু এ রকম নয়। বরং এসব বইয়ের লেখক ও প্রকাশকরা বই বিক্রয়ের জন্য বেছে নিচ্ছেন অভিনব সব পদ্ধতি। বিভিন্ন প্রকাশনীর স্টলে তারকারা বই কিনলেই সঙ্গে থাকছে ছবি তোলার ও অটোগ্রাফ নেওয়ার লোভনীয় সুযোগ। প্রিয় তারকার সঙ্গে ক্যামেরাবন্দি হওয়ার আশায় খুব সহজেই সে ফাঁদে পা রাখছে মানুষ। আর মাঝখান থেকে লাভবান হচ্ছেন সেই তারকা ও তার প্রকাশক। আপাতদৃষ্টিতে বিষয়টি খুবই সাধারণ মনে হলেও এর ব্যাপকতাই একটা সময়ে বাংলা সাহিত্যের জন্য কাল হয়ে দাঁড়াবে। গুণগত মানসম্মত সৃজনশীল সাহিত্য কিংবা মননশীল বইয়ের বদলে বইমেলায় স্থান করে নিচ্ছে ভাষা শিক্ষা ও দক্ষতা উন্নয়নবিষয়ক বই। এ ধরনের বই যে আমাদের জন্য প্রয়োজনীয় নয়, এমনটি বলছি না। তবে বইমেলার সর্বোচ্চ বিক্রীত কিংবা মুদ্রিত বইয়ের তালিকায় এ ধরনের বইয়ের অবস্থান আমাদের জন্য হতাশাব্যঞ্জক, বাংলা সাহিত্যের জন্য অশনিসংকেত। তবে এ অবস্থার জন্য শুধু লেখক-প্রকাশক নয়, বরং পাঠকদেরও সমান দায় রয়েছে। আমরা পাঠকরা সাহিত্যগুণ সমৃদ্ধ বইয়ের দিকে না ছুটে সস্তা জনপ্রিয়তার স্রোতে গা ভাসাচ্ছি। পাঠকরা যা পড়ে, যা কেনে, প্রকাশকরা তা-ই প্রকাশ করেন। এ ধরনের বই প্রকাশের ক্ষেত্রে তাই পাঠক চাহিদাও (পাঠকপ্রিয়তা নয়) বড় একটি কারণ।

অন্যদিকে, ইন্টারনেটের অবাধ ব্যবহার মানুষকে বইবিমুখ করে তুলছে। একটা সময়ে মানুষের অবসরের প্রধান সঙ্গী যেখানে ছিল বই, সে স্থান এখন দখল করে নিয়েছে স্মার্টফোন আর ল্যাপটপের ডিজিটাল পর্দা। আমাদের দেশের ক্রমবর্ধমান সামাজিক অবক্ষয়ের পেছনে তরুণ সমাজের বইবিমুখতাও অন্যতম একটি কারণ। বই পাঠ মানুষকে চিন্তাশীল, সহনশীল ও মানবিক গুণসম্পন্ন ব্যক্তিতে পরিণত করে। একটি সমাজকে আলোকিত করার জন্য বই পাঠের কোনো বিকল্প নেই। আর এ ক্ষেত্রে একমাত্র বইমেলা-ই পারে মানুষের বইবিমুখতা দূর করে বই পড়ার অভ্যাসকে নতুন করে গড়ে তুলতে। আমাদের বর্তমান সমাজব্যবস্থার সম্ভাব্য ভাঙন ঠেকাতে সুস্থ সাংস্কৃতিক পরিবেশ খুব বেশি জরুরি। দেশজুড়ে একটি সাংস্কৃতিক আবহ গড়ে তুলতে বইমেলা কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। এজন্য বইমেলার পুরোনো ঐতিহ্যকে ফিরিয়ে আনতে হবে। শুধু সংখ্যায় নয়, মানের দিক থেকেও প্রতি বছর শত শত নতুন বইয়ে বাঙালির সাহিত্য ভান্ডারকে সমৃদ্ধ হতে হবে। আর এর জন্য প্রয়োজন লেখক, প্রকাশক, পাঠকদের সম্মিলিত প্রয়াস। পাঠকরা যদি মানসম্মত বই পাঠে আগ্রহী ও অভ্যস্ত হয়ে উঠেন, তবে প্রকাশকরাও সে ধরনের বই প্রকাশে উৎসাহিত হবেন। এতে করে বাংলা সাহিত্যের অনিষ্টকারী বস্তাপচা লেখকদের দৌরাত্ম্য কমে আসবে।

এ দেশের ১৮ কোটি মানুষ মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত, সুখী, সমৃদ্ধ ও অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখে। এই বাংলাদেশ বিনির্মাণের প্রধান হাতিয়ার হলো একটি বুদ্ধিবৃত্তিক সমাজ। বাংলাদেশে বইমেলার মাধ্যমেই নতুন দিনের ‘বুদ্ধির মুক্তির আন্দোলন’ শুরু করতে হবে। এর প্রথম ধাপ হিসেবে বইমেলার পুরোনো আবহ, বইয়ের গুণগত মান নিশ্চিত করতে সজাগ হতে হবে সংশ্লিষ্ট সবাইকে। তা না হলে প্রতি বছর বইমেলা আয়োজিত হবে, কিন্তু আসল উদ্দেশ্য বাস্তবায়িত হবে না। একবিংশ শতাব্দীর তৃতীয় দশকে এসে বলতে চাই, বইমেলা শুধু বন্ধুদের নিয়ে ঘুরতে যাওয়া কিংবা সেলফি তোলার স্থান নয়, বইমেলা পরিণত হোক শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতিপ্রেমীদের তীর্থস্থানে। পৃথিবী হোক বইয়ের স্বর্গরাজ্য।

লেখক : শিক্ষার্থী, ব্যাংকিং অ্যান্ড

ইন্স্যুরেন্স বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

[email protected]

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
মুক্তমত,বইমেলা,সাহিত্য
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close