এহ্সান ইসলাম
বইমেলা হোক সারা বছর স্থানে স্থানে
দেশের লেখক-পাঠক-প্রকাশকরা সারা বছরই মুখিয়ে থাকেন অমর একুশে গ্রন্থমেলার জন্য। নভেল করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে অনিশ্চিত হয়ে পড়া বইমেলা শেষ পর্যন্ত মার্চের তৃতীয় সপ্তাহে শুরু হচ্ছে। প্রতি বছর পরিসর বাড়িয়েও যেন সংকুলান হচ্ছে না একুশের বই উৎসবের।
এরই মধ্যে ঢাকা বইমেলাসহ রাজধানীতে বিভিন্ন সময়ে হওয়া বইমেলা বন্ধ হয়ে গেছে। এজন্য জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের বইমেলা আয়োজনের বাজেট অপ্রতুল বলে মনে করেন প্রকাশকরা। তবে বছরে একবার একটি জায়গায় বইমেলা আয়োজনের চেয়ে বিভিন্ন সময় ঢাকায় অঞ্চলভিত্তিক বইমেলার দাবি জানিয়ে আসছেন প্রকাশকরা। এতে প্রকাশনা শিল্পের বিকাশ ও মানুষের মধ্যে পাঠাভ্যাস বাড়বে বলে মনে করছেন তারা। সম্প্রতি কাঁটাবন পাবলিশার্স ফোরামের আয়োজনে ‘কনকর্ড এম্পোরিয়াম’ চত্বরে অনুষ্ঠিত ৭ দিনের বইমেলা সে বিষয়টি সামনে এনেছে।
গবেষণা-প্রকাশনার পাশাপাশি প্রতি বছর ফেব্রুয়ারিতে মাসব্যাপী অমর একুশে গ্রন্থমেলা আয়োজন করে থাকে বাংলা একাডেমি। বিভিন্ন সময়ে রাজধানীতে বইমেলা আয়োজন প্রসঙ্গে বাংলা একাডেমির পরিচালক লেখক ড. জালাল আহমেদ প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, ‘সারা দেশে বা রাজধানীতে অন্য সময় বইমেলা আয়োজনের দায়িত্ব বাংলা একাডেমির না তা করতে গেলে মূল কাজও করা হবে না; এর জন্য নির্দিষ্ট দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র। তাদের একটা পরিকল্পনা থাকে দেশব্যাপী বইমেলা করার, এর মধ্যে রাজধানীও আছে। বাংলা একাডেমি ওইসব মেলায় অংশ নেয়। তাছাড়া আমাদের নিজস্ব উদ্যোগে বিভিন্ন স্থানে বইমেলা করি, আমাদের ভেন্যুর মধ্যেও বিশেষ বইমেলা করি, বিভিন্ন দিবসে নানা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বইমেলায় অংশগ্রহণের সুযোগ দিলেও আমরা অংশ নেই প্রকাশক হিসেবে।
তবে বাংলা একাডেমি আর কোনো মেলা করবে তা চিন্তা করে না।’ তবে রাজধানীর মধ্যে আরো বইমেলার উদ্যোগকে তিনি স্বাগত জানান।অমর একুশে গ্রন্থমেলা ছাড়া দেশের বিভিন্ন স্থানের বইমেলা আয়োজনের দায়িত্ব পালন করে আসছে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র। এর বর্তমান পরিচালক কবি মিনার মনসুর প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, ‘আমরা চাই সারা বছরই বইমেলা হোক।
ফেব্রুয়ারির প্রথম ৭ দিন কনকর্ড এম্পোরিয়ামের প্রকাশকরা যে আয়োজন করেছেন তাকে স্বাগতম জানাই। কোনো পাঠাগার, সংগঠন, স্কুল-কলেজ, প্রকাশক কিংবা বিদেশে, যারাই বইমেলার উদ্যোগ নিক, আমরা তার পাশে থাকব।’কনকর্ড এম্পোরিয়াম চত্বরে ফেব্রুয়ারির ১-৭ পর্যন্ত বই উৎসবের আয়োজক কাঁটাবন পাবলিশার্স ফোরামের নেতৃস্থানীয়দের একজন জয়তী প্রকাশের স্বত্বাধিকারী মাজেদুল হাসান পায়েল।
ঢাকার বিভিন্ন স্থানে বইমেলা আয়োজনের সংকট সম্পর্কে প্রতিদিনের সংবাদকে তিনি বলেন, ‘রাজধানীতে বইমেলা হলে অংশগ্রহণের আগ্রহ আছে। কিন্তু এই মেলাগুলো আমরা প্রচার হিসেবে গণ্য করি, তাতে খরচ উঠে না। তারপরও নিজেদের উদ্যোগে বিভিন্ন স্থানে বইমেলা করি, তাতে সরকারি প্রতিষ্ঠানের কোনো অর্থায়ন থাকে না। তাই মেলার সংখ্যা কমে আসছে। তবে গ্রন্থকেন্দ্রের বইমেলা আয়োজনের বাজেট যথেষ্ট নয়।’ কাঁটাবনে অনুষ্ঠিত সপ্তাহব্যাপী বই উৎসবের বিক্রি-বাট্টা না হলেও পাঠক-ক্রেতাদের ভালো সাড়া পেয়েছেন বলে জানান পায়েল।
এছাড়া প্রকাশকরাই উদ্যোগী হয়ে বিভিন্ন ঋতু ধরে জাতীয় গ্রন্থাগার চত্বরে বর্ষার বইমেলা, হেমন্তের বইমেলা আয়োজন করে থাকেন বলে তিনি জানান।শুরুতে রাজধানীর জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ডে ‘ঢাকা বইমেলা’র আয়োজন করত জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র। পরে তা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘তিনকোনা মাঠে’ নিয়ে আসা হয় এই মেলা। পাঠক-ক্রেতার সাড়া না পেয়ে ও ধারাবাহিক মন্দার কারণে তা বন্ধ করে বিভাগীয় পর্যায় মেলার আয়োজন করে তারা। ফলে কয়েকজন প্রকাশক উদ্যোগী হয়ে বিভিন্ন স্কুল-কলেজে বইমেলা আয়োজন করে থাকে।তবে বিভিন্ন স্থানে গ্রন্থকেন্দ্র আয়োজিত বইমেলার অংশগ্রহণ করে থাকেন সৃজনশীল প্রকাশকরা। এই প্রকাশকদের সর্ববৃহৎ সংগঠন জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক সমিতি।
সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও অনন্যা প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী মো. মহিরুল হক প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, ‘আমরা চাই সারা বছর বইমেলা হোক কিন্তু খরচের কারণে সব মেলায় অংশগ্রহণ করতে পারি না। বইমেলা আয়োজনের দায়িত্ব গ্রন্থকেন্দ্রের এর জন্য একটা বাজেট আছে। আগে তারা ঢাকা বইমেলা করত। এখন তা বন্ধ করে ৮ বিভাগে বইমেলা শুরু করেছে তারা। ফলে রাজধানীর ভেতর বইমেলা প্রকাশকদের উদ্যোগ ছাড়া আর বইমেলা হয় না।’
তিনি জানান, শিল্পকলা একাডেমিতে বইমেলা হওয়ার কথা থাকলে করোনার কারণে তা হয়নি। তবে ধনিয়া ও উত্তরায় বইমেলা করবেন তারা।জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের পরিচালক মিনার মনসুর বলেন, ‘গ্রন্থকেন্দ্র বছরে ৮-১০ বইমেলা করে থাকে। এবার করোনার কারণে স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে বইমেলা করার অনুমতি পাওয়া যায়নি। তাই অনেক মেলাই করা যায়নি।
তাছাড়া ১৮ মার্চ থেকে ১৪ এপ্রিল পর্যন্ত একুশে গ্রন্থমেলার তারিখ ঘোষণা করেছে বাংলা একাডেমি। তারপরই রমজান। এ সময় দেশে বইমেলায় সাড়া পাওয়া যায় না। তারপর আছে স্কুল-কলেজে পরীক্ষা, শুরু হবে প্রাকৃতিক ঝড়-ঝঞ্ছা। তাছাড়া করোনার প্রাদুর্ভাব এখানে কাটেনি। তাই এই বদল। আগে ১০টা প্রকাশক নিয়েও ঢাকায় বিভিন্ন স্থানে বইমেলা করেছে গ্রন্থকেন্দ্র। কিন্তু এসব মেলায় প্রকাশকদের খরচ উঠে না। ঢাকা বাইরে তারা খরচের কারণে যেতে চান না।’
এর বিকল্প হিসেবে তিনি জানান, এসব কারণে জন্য ঢাকা থেকে প্রকাশক নিয়ে বিভাগীয় মেলা করার চেয়ে সুবিধাজনক সময়ে আগ্রহী ও স্থানীয় প্রকাশকদের নিয়ে আঞ্চলিক মেলা আয়োজন করবে বিভাগীয় প্রশাসন। এ প্রস্তাব সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ে দেওয়া হয়েছে। এখনো তার উত্তর পাইনি। পেলে অবশ্যই মেলাগুলো করা হবে।’শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বইমেলা করা সম্পর্কে কনকর্ড এম্পোরিয়ামের প্রকাশক মাজেদুল হাসান জানান, স্কুলে বইমেলা করলে স্টল নির্মাণ, তাঁবুর ব্যবস্থাসহ কিছু প্রাতিষ্ঠানিক সহযোগিতা পাওয়া যায়। সম্পূর্ণ নিজস্ব খরচে বইমেলার আয়োজন করা হলে বিক্রি-বাট্টা করে খরচও উঠে না। তারা ওই মেলায় সবাই অংশগ্রহণ করতে পারেন।
রাজধানীর যে এলাকায় বইমেলা হয়, ওই এলাকার মানুষের আগ্রহ ও শিক্ষার্থীদের পছন্দ বিবেচনা করতে হয়। সেই ধরনের বইয়ের প্রকাশকরাই এতে অংশ নেন। পায়েল বলেন, ‘রাজধানীতে বইমেলা আয়োজনে গ্রন্থকেন্দ্র ছাড়াও ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সহযোগিতার সুযোগ আছে। সেটা করলেও এই ধরনের বইমেলা আয়োজন সম্ভব।’ ৮-১০ জন প্রকাশক প্রতি বছর ১০-১৫টি স্কুল টার্গেট করে বইমেলা করে থাকেন বলে তিনি জানান।
আগামীতে তারা উত্তরা, ধোলাইখাল, খিলগাঁও, ধনিয়াতে বইমেলার করবেন বলে আশা প্রকাশ করেন।করোনার প্রাদুর্ভাবের কারণে এবার ১৮ মার্চে শুরু হয়ে ১৪ এপ্রিল পর্যন্ত ‘অমর একুশে বইমেলা’ আয়োজন করেছে বাংলা একাডেমি। সম্প্রতি একটি দৈনিকে প্রকাশিত বাংলা একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খানের নিবন্ধ থেকে জানা যায়, স্বাধীনতার আগে বিভিন্ন সময় ঢাকায় ক্ষুদ্র পরিসরে বইমেলা অনুষ্ঠিত হলেও প্রতিষ্ঠানিক বইমেলার শুরু ১৯৭২ সালে।
ইউনেস্কো ঘোষিত আন্তর্জাতিক গ্রন্থবর্ষ উপলক্ষে সে বছর বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে ২০-২৭ ডিসেম্বর ৭ দিনব্যাপী আন্তর্জাতিক বইমেলার আয়োজন করে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র। ১৯৭৩ সাল থেকে মুক্তধারার চিত্তরঞ্জন সাহা, স্ট্যান্ডার্ডস পাবলিশার্সের রহুল আমিন নিজামী ও বর্ণমিছিলের তাজুল ইসলাম বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে পাটি বিছিয়ে বইয়ের পসরা নিয়ে বসতেন। মাঝে ১৯৭৫ থেকে ১৯৮০-এর মধ্যে এই মেলা পুরোপুরি বন্ধ থাকে। তবে বাংলা একাডেমিতে পরিকল্পিত বইমেলার সূচনা ঘটে ১৯৮৪ সালে। তারপর থেকে আর বন্ধ থাকেনি এই মেলা বরং পরিণত হয়েছে প্রাণের মেলায়।
পিডিএসও/এসএম শামীম