১০ ফেব্রুয়ারি, ২০২১

কাজী জহিরুল ইসলামের জন্মদিন

একজন সহজ ও সত্যের পথযাত্রী কবি

কাজী জহিরুল ইসলাম (জন্ম : ১০ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৮)

‘রোজ রাতে একটি কলম ঠোঁট ঘষে তোমার খাতায়/চুমুর চিহ্নেরা আঁধারে সাঁতার কেটে কেটে ঘুম ভাঙায় শিল্পের।’ কবিতা যে একটা পৃথিবী সমান বয়স নিয়ে শিল্পের উচ্চাসনে বসে আছে, সেকথা নির্বোধ বালকটিও মানে ও জানে। সেজন্যই হয়তো কবি কাজী জহিরুল ইসলাম উপর্যুক্ত পঙক্তি লিখেছেন।

কবিতা শিল্প হয়ে সত্যকে কতটা ধারণ করেছে বা করবে, তা নিয়ে বিতর্কের তেমন ডালপালা ছড়ায়নি সাহিত্যাঙ্গানে। কেননা সাহিত্য মানেই যেন সত্য বলা, ভালোর পথে চলা। আর প্রতিটি সাহিত্য সাধক যেন এক একজন স্রষ্টা। যেহেতু সাহিত্য সাধককে সমাজের সর্বস্তর স্রষ্টা মেনেই নিয়েছে, তাই সে নিশ্চয়ই সুন্দরের পক্ষে। আসলে কি তাই? যদি তাই হতো, তাহলে একজন স্রষ্টা কেন তোষামোদকারী রূপে আবির্ভূত হয় কবিতার ছত্রে ছত্রে। আবার ভয়ানক হিংসুটে হয়! অথবা ধরেই নিতে পারি, সাহিত্যিকদের মনে কোনো গলদ নেই। হয়তো বোধের অভাব থাকতে পারে ব্যক্তি বিশেষে। তাই তো জীবনানন্দের মতো কবিকে সুধীন্দ্রনাথ দত্ত এক গ্রাম্য ও তৃতীয় শ্রেণির কবি ভাবতেন। বাংলা ভাষার প্রধান কবিদের মধ্যে একজন হয়েও আল মাহমুদ কিভাবে ‘রফিক আজাদের শ্রেষ্ঠ কবিতা’ বইটি পড়ে বলতে পারলেন—রফিক আজাদের সমগ্র রচনায় আমি একটিও কবিতা পাইনি। (কবির আত্মবিশ্বাস, পৃষ্ঠা ৫০-৫১)

এভাবেই যুগের পর যুগ কবি ও সাহিত্যিকের মধ্যে স্বীকার ও অস্বীকারের দ্বন্দ্ব চলে এসেছে। আবার কখনও এটাও দেখা যায় যে, নিজের দল ভারী করতে বা কণ্ঠ তৈরি করতেও কোনো কোনো সময় প্রধান কবিরাও অকবিদের কৌশলে কবি স্বীকৃতি দিয়েছেন। এরও প্রমাণ মেলে আবদুল মান্নান সৈয়দের ‘করতলে মহাদেশ’ (দ্বিতীয় সংস্করণ, পৃষ্ঠা ২০৭-২০৮) গ্রন্থে যখন সাদামাটা কবিতার উদ্ধৃতি দিয়ে একজন কবিকে প্রধান কবি হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।

আসলে সাহিত্যাঙ্গনে খালি চোখে অনেক কিছু দেখা না গেলেও সহজেই অনুমেয় যে, সম্পর্কের খাতিরেই এমন স্বীকৃতি ও অস্বীকৃতির ঘটনা ঘটে। পদ ও পদবীও হয়তো কিছুটা সেই কথাকে আরও জোরালো করতে বাধ্য করে সচেতন সাহিত্য সমাজকে। এই যে সাহিত্যের ভেতর-বাহিরের স্বজনপ্রীতি, ভালোলাগা-মন্দলাগা, বোধকরি সমকালীন সব লেখকই তা জানতেন। কিন্তু সেসব মুখে বা কলমের ডগায় কেউ আনতেন না। কারণ এসবের পেছনে লেগে থাকে অদৃশ্য স্বার্থ। সেই স্বার্থ যেকোনো মুহূর্তেই দৃশ্যমান হতে পারে। তাই অনেকে বলতে চাইলেও বলতে পারেন না। এই যে সত্যকে গোপন করা, এটা বর্তমান সময়ে সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ে। বিশেষ করে তরুণ লেখকদের মধ্যে। তাইতো দেশের উত্তরবঙ্গে যখন বন্যায় মানুষ জলখাবার পায় না, ত্রাণের অভাবে মানুষ কষ্টে জর্জরিত, তখনও তরুণরা কবিতা লেখেন—‘ওগো প্রিয়া, তুমি খুলে দাও হৃদয়ের দরজা।’ এসব তরুণদের পথভ্রষ্ট হওয়ার পেছনে সমকালের সিনিয়র লেখকরাই দায়ী।

এই সময়ের কবি কাজী জহিরুল ইসলাম বর্তমান সময়ের সেইসব কবিদের থেকে আলাদা। তিনি অকপটে কবিতায় তুলে আনেন সত্য-মিথ্যার পার্থক্য। কবিতার ভাষায় পরিবর্তন করতে চেষ্টা করেন সময়ের অসঙ্গতি। তিনি তরুণদের মন্দকে মন্দ এবং ভালোকে ভালো বলে প্রকাশ ও প্রচার করতে কৌশলের আশ্রয় নেন ঠিকই, তবে সেটা কাউকে আঘাত না করে সুন্দরের মাধ্যমে বুঝিয়েও দেন।

কবিতা নিয়ে কাজী জহিরুলের ব্যাপক পরীক্ষা-নিরীক্ষা সচেতন লেখকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। সেই পরীক্ষাই তিনি করেছেন ক্রিয়াপদ ব্যবহার না করে লেখা তার কাব্যগ্রন্থ ‘ক্রিয়াপদহীন ক্রিয়াকলাপ’। নিরীক্ষাধর্মী ও ব্যতিক্রমী এই কবিতার বইটি ২০১৫ সালের ১৬ আগস্ট থেকে শুরু করে ২০১৬-এর এপ্রিলের মধ্যে লেখা। গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত পঁয়ত্রিশটি কবিতার কোথাও ক্রিয়াপদ ব্যবহৃত হয়নি।

ক্রিয়াপদ এড়িয়ে পঙক্তির পর পঙক্তি সাজানো, কাব্যরসের স্বাদ বজায় রাখা, চিত্রকল্পের সফল প্রয়োগ, উপলব্ধির দুয়ার খুলে দিয়ে পাঠককে স্বাধীনভাবে ভাবতে সুযোগ করে দেয়া; তার ওপর কবিতার প্রবাহমানতা ধরে রেখে নানান রঙ আর ছবি আঁকা—সত্যিই চাট্টিখানি কথা নয়।

লেখক : কবি ও সম্পাদক [email protected]

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
কবি,কাজী জহিরুল ইসলাম,সাহিত্য,এনাম রাজু,কবিতা
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close