টেকনাফ (কক্সবাজার) প্রতিনিধি

  ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৭

রাখাইনে হিন্দু নারী-পুরুষরাও নির্যাতন ও খুনের শিকার

মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে নৃশংস ও লোমহর্ষক নির্যাতনের বর্ণনা দিয়েছেন সেখান থেকে পালিয়ে বাঁচা হিন্দু রোহিঙ্গা নারীরা। হিন্দু রোহিঙ্গাদের পরিবারের পুরুষরাও হামলার শিকার ও খুনের শিকার হয়েছেন। তাদের পাহাড়ে তুলে হত্যা করা হয়েছে। রোহিঙ্গা গ্রামগুলোয় হত্যাকান্ড ও লুটতরাজের সময় ঘাতকরা দ্রুত হামলা, হত্যা, অগ্নিসংযোগ ও লুট করেছে। হামলা থেকে রেহাই পায়নি নারী ও শিশুরাও। উখিয়ার পশ্চিম কুতুপালংয়ের রোহিঙ্গা হিন্দু ক্যাম্পে আশ্রয় নেওয়া বিধবা নারীরা এভাবেই জানান তাদের ওপর নির্যাতনের কথা।

তারা জানিয়েছেন, এই ক্যাম্পে আশ্রয় নেওয়া ১৩৩ রোহিঙ্গা হিন্দু নারীর মধ্যে সাতজনের স্বামীকে হত্যা করা হয়েছে। তারা বলছেন, হিন্দু বলে তারা কোনো ধরনের ছাড় পায়নি। রাখাইনে হিন্দু রোহিঙ্গাদের ওপর এমন নির্যাতন আর হত্যাকা-ের শিকার হয়েছে প্রমীলা শীলের (২৫) পরিবার। তিনি বলেন, ‘আমার স্বামীর নাম স্বপন শীল। তারা রাতে আমাদের বাড়িতে ঢোকে। সবার মুখে ছিল মুখোশ। তারা প্রথমেই আমাদের মুঠোফোন কেড়ে নেয়। নারী-পুরুষ আলাদা লাইনে বসায়। গরু-ছাগল লুট করার পর সবাইকে পাহাড়ে উঠতে বলে। নারীরা উঠতে না পারায় তাদের বেত দিয়ে পেটাতে থাকে।’

প্রমীলা শীল আরো বলেন, ‘পাহাড়ের ওপরে তুলে পুরুষদের হত্যা করা হয়। তারা অনেক ধারালো দা নিয়ে এসেছিল। মুহূর্তেই হত্যা ও লুট করে পালিয়ে যায় তারা।’ তিনি বলেন, ‘আমার স্বামী, শ্বশুর, শাশুড়ি, জা ও জায়ের ছেলেকে হত্যা করে তারা। আমার জায়ের মেয়ে এখনো নিখোঁজ। শুনেছি সে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আছে। তবে তাকে এখনো খুঁজে পাইনি।’ স্বামী ফুবন ধরকে হত্যা করা হয়েছে বলে জানালেন আরেক হিন্দু রোহিঙ্গা রিত্তা ধর। অন্তঃসত্ত্বা রিতা স্বামী-সংসার হারিয়ে এখন দিশাহারা। স্বামী হারিয়ে বিধবা হয়েছেন। এই হিন্দু রোহিঙ্গা নারীরাও নিজেদের ওপর নির্যাতনের ঘটনার বর্ণনা দেন আরেক হিন্দু নারী অনিকা ধর। মাত্র ১৬ বছর বয়সে মিলন শীলের সঙ্গে বিয়ে হয় তার। মংডুর ফকিরা বাজার এলাকায় তাদের বাড়ি। সেখানে তার স্বামী সেলুনে কাজ করতেন।

অনিকা বলেন, ‘গত ২৭ আগস্ট সকাল ৮টায় আমাদের গ্রামে ঢোকে তারা। প্রথমে আমার স্বামীর কাছ থেকে মোবাইল কেড়ে নেয়। পরে স্বামীকে মারধর করে। হাত-পা বেঁধে ফেলে। তারা সবাই ছিল মুখোশ পরা, তাদের শুধু চোখ দেখা যায়। সোনা-গয়না যা ছিল তা সবচেয়ে নিয়েছে।’ কারা হামলা চালিয়েছিল তা না বলতে পারলেও অনিকা জানান, তারা শুদ্ধ ভাষায় কথা বলছিল।

অনিকা ধর বলেন, ‘তারা এলাকাবাসী সবাইকে মারধর করে পাহাড়ে নিয়ে গেছে। এ সময় বেত দিয়ে সবার পায়ের নিচে পিটিয়েছে, আর দা দিয়ে কুপিয়েছে। এভাবেই তারা সবাইকে মেরে ফেলে।’ তিনি বলেন, ‘আমি তাদের কথামতো চলায় প্রাণে বেঁচে গেছি। আমার সঙ্গে আরো সাতজন নারী বেঁচে গেছে। তারা সবাই বাংলাদেশে আসতে পেরেছে কিনা জানি না। কিন্তু আমি মুসলিম নারীদের সঙ্গে চলে এসেছি।’ পূজা মল্লিক (২১) নামের আরেক গৃহবধূ জানান, স্বামী আশীষ কুমার ও তিন বছর বয়সী সন্তান রাজাকে নিয়ে তারা থাকতেন রাখাইনের মংডুর রেইক্যা পাড়ার ফকিরা বাজার এলাকায়। সেখানে একটি সেলুন চালাতেন আশীষ। স্বামী-সন্তান নিয়ে ভালোই চলছিল পূজার সংসার। কিন্তু ২৭ আগস্ট সকালে হঠাৎ করে এলোমেলো হয়ে যায় সব। হিন্দু রোহিঙ্গারা থাকছেন কুতুপালংয়ের এই এলাকায়। পূজা বলেন, ‘গুলির শব্দে ঘুম ভাঙে সবার। তারপর বাইরে বের হতেই দেখি ঘরবাড়ি পুড়ছে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই বাড়ির সব পুরুষকে বেঁধে ফেলে কালো পোশাকধারীরা। একে একে হত্যা করা হয় আমার স্বামী আশীষ, শ্বশুর বলরাম, শাশুড়ি অনু বালা, দেবর খুশিস কুমার ও ননদ ঝুনু বালাকে। ভাগ্যক্রমে প্রাণে বেঁচে যাই আমি। এরপর প্রতিবেশী মুসলিম নারীদের সঙ্গে বোরকা পরে বাংলাদেশে চলে আসি।’

কক্সবাজারের আশ্রয়কেন্দ্রগুলো ঘুরে দেখা গেছে, রাখাইন রাজ্য থেকে পালিয়ে আসা হিন্দু পরিবারগুলোকে রাখা হয়েছে পশ্চিম কুতুপালং ক্যাম্পে আগে থেকে অবস্থান করা ১৬টি হিন্দু পরিবারের সঙ্গে। একটি পরিত্যক্ত মুরগির খামারেও থাকছে কয়েকটি পরিবার। সেখানেই রান্না করে খাওয়ানো হচ্ছে তাদের। এ ছাড়া ত্রাণও দেওয়া হচ্ছে। হিন্দু পরিবারগুলোকে দেখাশোনার জন্য একটি কমিটি করা হয়েছে। কমিটির প্রধান সুজন শর্মা। তিনি বলেন, ‘মিয়ানমার থেকে ১৬২ পরিবারের ৫১৮ জন হিন্দু এসেছেন। এর মধ্যে নারী ১৩৩ জন। তাদের মধ্যে ১০ জন সন্তানসম্ভবা, সাতজন বিধবা। এক থেকে ১০ বছরের মেয়েশিশু ৬৫, ছেলেশিশু ৯৫ ও বৃদ্ধ আটজন। বাকি ১২৮ জন পুরুষ।’

রোহিঙ্গাদের স্বাস্থ্যসেবা ও অন্যান্য সহযোগিতা দিয়ে থাকে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ‘মুক্তি’। এ প্রতিষ্ঠানের স্বাস্থ্যকর্মী সুমা শর্মা বলেন, ‘যেসব হিন্দু নারী সন্তানসম্ভবা, তাদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হচ্ছে। তাদের জন্য যতটা সম্ভব বাড়তি যত্নের ব্যবস্থা করার চেষ্টা করছি আমরা।’

পিডিএসও/তাজ

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
রোহিঙ্গা নির্যাতন,হিন্দু নারী-পুরষ,রাখাইন,রাখাইনের হিন্দু,কক্সবাজার,কুতুপালং ক্যাম্প
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist