পিরোজপুর প্রতিনিধি
যোগাযোগ ও সরকারি পৃষ্টপোষকতার অভাব
হুমকির মুখে কুড়িয়ানার ঐতিহ্যবাহী পেয়ারা চাষ
আপেল খ্যাত পিরোজপুর জেলার স্বরূপকাঠীর পেয়ারার চাষ এখন হুমকির সম্মুখিন, কপালে হাত পেয়ারা চাষীদের। মধ্য স্বত্য ভোগীদের অত্যাচার, যোগাযোগ ব্যবস্থার সমস্যা ও সরকারি পৃষ্টপোষকতার অভাবে এ সমস্যা এখন ফি বছর এলাকার চাষীদের। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে প্রায় দেড়শ বছর আগে থেকে এই এলাকা পেয়ারা চাষের জন্য বিখ্যাত। শ্রাবনের এ সময় পেয়ারার ভর মৌসুম চলছে। পেয়ারাকে ভালবেসে ‘বাংলার আপেল’ আবার কেউ ‘গরিবের আপেল’ হিসাবে গণ্য করে। এলাকার কয়েক হাজার পেয়ারা চাষী ও ব্যবসায়ীরা এ পেশায় বংশ পরস্পর জীবিকা নির্বাহ করে আসছে। সুমিষ্ট এই পেয়ারা শুধু কুড়িয়ানার মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় সরবরাহ হচ্ছে। উন্নত যোগাযোগ আর হিমাগারের অভাবে যুগ যুগ ধরে ন্যায্য মূল্য আর মুনাফা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে চাষিরা। পুষ্টিমানের দিক থেকে একটি পেয়ারা ৪ টি আপেলের সমতুল্য বলে কৃষি বিশেষজ্ঞরা অভিমত দিলেও এবং চাহিদা থাকা স্বত্বেও ব্যবস্থাপনা ও সংরক্ষনের অভাব রয়েছে প্রকট ভাবে, কৃষকরা বলছে এই অঞ্চলের অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণেই রয়েছে পাইকারের অভাব। এর ফলে শত বছরের পুরণো এই কৃষি পণ্য উৎপাদন করে চরম হতাশার মধ্যে রয়েছে এ এলাকার চাষীরা। স্বরূপকাঠির আটঘর কুড়িয়ানার পেয়ারার চাষ এখন পার্শ^বর্তী ঝালকাঠি, বরিশালের বানারীপাড়া উপজেলার ৫০ গ্রামে চাষ হচ্ছে। তবে বিশেষ করে আটঘর কুড়িয়ানা ইউনিয়ন, সমুদয়কাঠি ও জলাবাড়ীসহ তিন ইউনিয়নে ১ হাজার ৩৪৫ টি পরিবার পেয়ারা চাষ দ্বারা যুগ যুগ ধরে জীবিকা নির্বাহ করে আসছে। এ উপজেলার কাঠ ব্যবসার পরেই মৌসুম ভিত্তিক এই পেয়ারা চাষ অর্থনীতির একমাত্র উৎস বলে সর্বজন স্বীকৃত। স্বরূপকাঠির সংগীতকাঠি, খায়েরকাঠি, ভদ্রানন্দ, বাস্তুকাঠি, ভাঙ্গুরা, আদাবাড়ী, বাক্ষ্রণনকাঠি, ধলাহার, জিন্দাকাঠি, আটঘর, কুড়িয়ানা, ইদলকাঠি, মাদ্রা, বেঙ্গুলি, আদমকাঠি, অশ্বত্থকাঠি, সেহাংগল ও আন্দারকুলসহ ২৬ গ্রাম নিয়ে রয়েছে বিস্তৃত এ পেয়ারার চাষ। যা প্রতি বছর ১০ থেকে ১২ হাজার মেট্রিক টন বিক্রিত পেয়ারা থেকে ৮-৯ কোটি টাকা উপার্জিত হচ্ছে বলে চাষীরা ও স্থানীয় ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন। যে পেয়ারা প্রতি মণ আষাঢ়ে বিক্রি হয় ৪৫০-৫০০ টাকা। শ্রাবণ শেষে তা নিচে নেমে মূল্য দাড়ায় মাত্র ৩০-৪০ টাকা মন দরে।
এ অর্থকারী ফলটি সংরক্ষণে আজও এ অঞ্চলে গড়ে উঠছে না কোন হিমাগার। হিমাগারের অভাবে ফলন প্রাচুর্যে ব্যবসায়ীদের নিকট ঐ সময়ে পানির দামে পেয়ারা বিক্রয়ের ফলে প্রতি বছর দেনায় জর্জরিত হতে হচ্ছে অধিকাংশ পেয়ারা চাষীদের। যে কারনে লোকসান এর ভয়ে ক্রমেই এ পেশা থেকে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে চাষীরা, ধীরে ধীরে সংঙ্কুচিত হয়ে আসছে এ পেশা। উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানাগেছে, স্বরূপকাঠি উপজেলায় ৬৪৫ হেক্টর জমির পেয়ারা বাগানের মধ্যে আটঘর কুড়িয়ানাতেই ৫২২ হেক্টর জমির পেয়ারা বাগান রয়েছে। যার প্রতি হেক্টর জমিতে ৮-৯ টন পেয়ারা ফলে। উপজেলায় ২ হাজার ৫৫ টি পেয়ারা বাগান রয়েছে। এ বছর চাষীদের ফলন ভাল হলেও পেয়ারায় এনথ্রাকনোস নামক এক প্রকার ভাইরাস যা, স্থানীয় ভাষায় (পেয়ারার সিট) পড়া রোগ বলে সনাক্ত করা হয়েছে। এতে করে ঝরে পড়ছে বাগানের অধিকাংশ পেয়ারা। পেয়ারা সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াজাতকরনসহ সরকারী বেসরকারী পৃষ্টপোষকতার অভাবে প্রতি বছর মৌসুম শেষে লোকসান গুনতে হচ্ছে চাষীদের। ভিমরুলি গ্রামের আড়তদার লিটন হালদার বলেন, আনুমানিক দেড়শ বছর আগে আটঘরের কালিচরন মজুমদার নামে এক ব্যক্তি ভারতের গয়া (পেয়ারা) থেকে এই জাতের পেয়ারার বীজ বপন করেন। সে কারনেই স্থানীয় ভাষায় পেয়ারাকে বলে গইয়া। সে থেকেই ছড়িয়ে পড়েছে স্বরূপকাঠির পেয়ারা চাষ। স্থানীয় পেয়ারা চাষী মোঃ মোস্তফা কামাল জানান, তার কয়েকটি বড় বড় পেয়ারার বাগান রয়েছে। আষাঢ়ের প্রথমে সে প্রতি মন পেয়ারা বিক্রি করেছে ৪৫০-৫০০ টাকা পর্যন্ত। এই শ্রাবণে ফলন প্রাচুর্যে গত ২১ জুলাই শুক্রবার আটঘরের পেয়ারা হাটে প্রতিমন পেয়ারা এনে ২০০ টাকা দরে বিক্রি করতে হয়েছে। তিনি আরো জানান, এখনো পেয়ারার যে দাম আছে তা চাষীদের সহনীয় পর্যায়ে আছে। কিন্তু শ্রাবণের শেষ সময়ে থেকে এই পেয়ারা মন প্রতি দাম দাড়ায় ৩০-৪০ টাকা দরে। ৩ জন পেয়ারা পাড়ার শ্রমিককে রোজ দিতে হয় ১ হাজার ৫০০ টাকা করে। সব মিলিয়ে ওই সময়ে প্রতিদিনই লোকসানের শিকার হতে হয়। এভাবে শুধু মোস্তফা নয় আরো শত শত চাষীকে সিজনের সময় বিপাকে পরতে হয়।
পেয়ারার জেলী পৃথিবী বিখ্যাত। বিদেশে জেলী তৈরীর কাঁচামাল হিসাবে বহু ব্যায়ে কিছু কিছু পেয়ারা বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে। জেলী অত্যন্ত পুষ্টিকর দামীয় খাবার হওয়া সত্ত্বেও পেয়ারাকে ঘিরে এখন পর্যন্ত তেমন কোন এগ্রো বেজইড শিল্প গড়ে ওঠেনি, যে কারনে উৎপাদিত পেয়ারা নিয়ে সংরক্ষন ও প্রক্রিয়াজাতকরনের অভাবে চাষীরা বার বার মার খেয়ে যাচ্ছে। পেয়ারার এই প্রতিকুল অবস্থায় উপজেলার অন্যতম অর্থকারী এই ফলটির চাষ বৃদ্বির লক্ষ্যে এ অঞ্চলে একটি জেলী তৈরীর কারখানা সহ হিমাগার স্থাপন করতে পারলে বেঁচে থাকবে স্বরূপকাঠির ঐতিহ্যবাহী পেয়ারার চাষ। নতুবা অদূর ভবিষ্যতে এ জেলা থেকে হারিয়ে যাবে শতাধিক বছরের ঐতিহ্যধারনকৃত পেয়ারার চাষ।
এ ব্যপারে উপজেলার কুড়িয়ানার ইউপি চেয়ারম্যান শেখর কুমার সিকদার বলেন, এলাকার অর্ধশত গ্রামের চাষীরা যুগ যুগ ধরে এ ফলের চাষ করে আসছে। কিন্তু দীর্ঘদিনেও উদ্যোক্তার অভাবে হিমাগারসহ প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প নির্মিত না হওয়ায় ও পাশাপাশি লাভের চেয়ে উৎপাদন খরচ দিন দিন বৃদ্ধি পাওয়ায় চাষীরা পেয়ারা চাষাবাদে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে।
এ ব্যাপারে বিসিক কর্মকর্তা মোঃ হারুন অর রশিদ বলেন, উদ্যোক্তা ও পরিকল্পিত ভাবে তা বাস্তবায়নে সম্ভব হলে একটি হিমাগার ও জ্যাম-জেলী প্রস্তুত কারখানা স্থাপন করা সম্ভব। স্বরূপকাঠি উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মোঃ রিফাত সিকদার জানান,সরকার স্বরূপাঠিতে দুইটি কৃষি পণ্য বিপনন কেন্দ্র তৈরীর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আগামী বছরই এর কাজ শুরু হবে বলে তিনি আশা করেন। এর ফলে কৃষকেরা একদিকে তাদের অতিরিক্ত ফসল সংগ্রহ করতে পারবে অন্যদিকে পেয়ারার মৌসুম ছাড়াও অধিকমূল্যে পেয়ারা বিক্রি করতে পারবে।
পেয়ারার ফলনের ব্যাপারে তিনি বলেন, এ বছর বাগানে রোগবালাই অনেক কম। তাই কৃষকেরা ভাল ফসল পাবে বলে তিনি আশা ব্যক্ত করেন। জেলা চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাষ্ট্রি সহ-সভাপতি আতাউর রহমান আলম বলেন, ঐতিহ্যবাহী এ ফসল বাঁচাতে এখনই দরকার একটি হিমাগার ও জ্যাম জেলি প্রস্তু কারখানা। অন্যথায় বেশীদিন এ অঞ্চলের মানুষ এ পেশায় টিকে থাকতে পারবে না।এত কিছুর পরেও কুড়িয়ানার পেয়ারা চাষী বিশ্বজিত চৌধুরী মনে করেন, সরকারি বা বেসরকারি উদ্যোগে বড় সাইজের পেয়ারা প্রসেসিং করে বিদেশে রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব।পেয়ারা চাষীরা মনে করেন হিমাগারের মাধ্যমে যথাযথ সংরক্ষণ পেয়ারা গাছের রোগ প্রতিরোধ ও যাতায়াতের আধুনিকী করণ ব্যবস্থা গ্রহণ করলে দক্ষিণাঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী ফল পেয়ারা থেকে এলাকার অর্থনৈতিক উন্নতি পাশাপাশি সরকারের রাজস্ব আয় বৃদ্ধিও সম্ভব।
পিডিএসও/রানা