বিশেষ প্রতিনিধি

  ২৬ জুলাই, ২০১৭

প্রাকৃতিক দুর্যোগে দুর্ভোগে মানুষ

*প্রকৃতির স্বাভাবিক পরিবেশ ধরে রাখতে হবে *চাই জাতীয় ভৌত পরিকল্পনা

গত মার্চ-এপ্রিলে আকস্মিক বন্যায় ডুবে যায় দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল ও উত্তর-পূর্বাঞ্চল। সে সময় যে ভারী বর্ষণ হয়, সেটি ছিল গত ৪০ বছরের মধ্যে প্রথম। বিশেষ করে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের হাওর অঞ্চল পানির নিচে তলিয়ে গেলে মানবিক বিপর্যয় দেখা দেয় সেখানে। জুনে রাঙামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের বিভিন্ন স্থানে দুদিনের পাহাড় ধসে মর্মন্তুদ মৃত্যু হয় ১৫৬ জনের বেশি মানুষের। ঠিক এর পরপরই জুলাইয়ে বন্যায় ডুবে যায় উত্তর-মধ্য-পুর্বাঞ্চলের অন্তত ১২ জেলা।

২০০৭ সালের পর সে মাসে বড় ও দীর্ঘস্থায়ী বন্যার কবলে পড়ে দেশ। আর এখন স্মরণকালের জলাবদ্ধতায় ডুবে আছে বন্দর নগরী চট্টগ্রাম। জলাবদ্ধতায় ঢাকার অবস্থাও নাজুক। এরই মধ্যে গতকাল হঠাৎ করেই কক্সবাজারের টেকনাফে টর্নেডোর আঘাতে দুই শতাধিক ঘরবাড়ি, দোকানপাট লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে। আহত হয়েছেন অন্তত ১০ জন। একইদিন ভোরে কক্সবাজারে দুটি পাহাড় ধসের ঘটনায় দুই শিশুসহ মারা যান চারজন। এ ছাড়া টানা বর্ষণ ও অস্বাভাবিক জোয়ারের পানিতে পটুয়াখালী, খুলনা, বাগেরহাট, ফরিদপুর, সাতক্ষীরা ও নড়াইলের বিভিন্ন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। এতে পানিবন্দি হয়ে পড়েছে সেখানকার মানুষও।

অর্থাৎ প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেন পেয়ে বসেছে বাংলাদেশকে। কেবল গত ছয় মাসেই নয়, পরিবর্তিত জলবায়ু পরিস্থিতিতে দিন দিন এসব দুর্যোগ বাড়ছেই। দুর্যোগ থেকে সৃষ্ট দুর্ভোগে অতিষ্ঠ এখন মানুষ। তবে সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগ মানবসৃষ্ট দুর্যোগে।

বিশেষ করে পাহাড় ধসে একসঙ্গে দেড় শতাধিক মানুষের মৃত্যু ও পাহাড়ধস অব্যাহত থাকায় এবং বছরের পর বছর জলাবদ্ধতা সমস্যার সমাধান না হওয়ায় দুর্যোগ মোকাবেলায় মানুষ এখন ক্লান্ত। এ ছাড়া হাওরের মতো অকস্মাৎ বন্যায় যেকোনো সময় তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা কিছুতেই পিছু ছাড়ছে না মানুষকে। কারণ উজান থেকে নেমে আসা ঢলে ও দেশের অভ্যন্তরে হঠাৎ করেই ভারী বর্ষণ মানুষকে আতঙ্কিত করে তুলেছে সবচেয়ে বেশি। আর এসব দুর্যোগের বেশির ভাগই মানবসৃষ্ট।

এই মুহূর্তে চট্টগ্রামের স্মরণকালের জলাবদ্ধতা মানুষকে বেশি ভাবিয়ে তুলেছে। জনদুর্ভোগ রেকর্ড ছাড়িয়েছে। টানা বৃষ্টিতে সমুদ্র লাগোয়া পতেঙ্গা শুধু নয়, অফিসপাড়া আগ্রাবাদ ও বাণিজ্যকেন্দ্র চাক্তাই-খাতুনগঞ্জসহ নগরীর নিম্নাঞ্চল ডুবে পানিতে থই থই। কোমর পানিতে কোথাও গ্যাসের চুলা ও বৈদ্যুতিক হিটার ভেসে গেছে, কোথাও স্কুল-কলেজ, অফিসপাড়া ছবির মতো স্থবির হয়ে পড়েছে। পানিবন্দি সড়কে কেউ নৌকায়, কেউ বয়ায়, কেউবা ভেলায় ভেসে গন্তব্যে পৌঁছার প্রাণান্ত চেষ্টা করেছেন। চাক্তাই খাল লাগোয়া বস্তিগুলো শুধু নয়, সিডিএ এভিনিউ, আগ্রাবাদ, হালিশহর, আরাকান সড়কসহ বিভিন্ন সড়কে পানিবন্দি দশায় যান আটকে গিয়ে দুর্ভোগে পড়েন হাজার হাজার মানুষ।

একইভাবে সামান্য বৃষ্টিতেই ঢাকার জলাবদ্ধতা যেন নিয়মিত রূপ নিয়েছে। গত দুদিনের বৃষ্টিতে ইতোমধ্যেই তলিয়ে গেছে শহরের গুরুত্বপূর্ণ প্রধান সড়ক থেকে শুরু করে অলিগলি পর্যন্ত। জমে থাকা পানি ঢুকে পড়ছে বাসাবাড়িতে, রাস্তার পাশের দোকানপাটে। পানিতে তলিয়ে থাকায় অলিগলি থেকে প্রধান সড়কে আসতে হচ্ছে ভ্যানে বা রিকশায়। কোথাও কোথাও সিএনজি, প্রাইভেট কার ও মোটরসাইকেল পর্যন্ত চলতে পারছে না। পানিতে মিশছে ভুগর্ভস্থ মলমূত্র। দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে বাতাসে। দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে নাগরিক জীবন।

এমন অবস্থায় আবহাওয়া অধিদফতরও সুখবর দিতে পারছে না। অধিদফতর বলছে, সহজেই বৃষ্টি কমছে না। আজ বুধবারও বৃষ্টি চলবে বলে জানিয়েছেন আবহাওয়া বিশেষজ্ঞরা। ২৭ জুলাই থেকে পরিস্থিতি কিছুটা বদলাতে পারে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদফতর। দেশের তিনটি সমুদ্রবন্দর চট্টগ্রাম, মোংলা ও পায়রা এবং কক্সবাজারে ৩ নম্বর সতর্ক সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে। এসব এলাকায় নৌযানগুলোকে উপকূলের কাছাকাছি সাবধানে চলাচল করতে বলা হয়েছে।

আবহাওয়া অধিদফতরের পরিচালক শামছুদ্দীন আহমেদ বলেন, এখন ঘোর বর্ষাকাল। শ্রাবণ মাস, তাই বৃষ্টি চলছে। এ সময় বৃষ্টি হওয়াটাই স্বাভাবিক। মৌসুমি বায়ুর সক্রিয়তার কারণেই এই বৃষ্টি হচ্ছে। তবে দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে বৃষ্টির পরিমাণ বেশি। বিশেষ করে চট্টগ্রাম, বরিশাল ও খুলনায় বৃষ্টি বেশি। তুলনামূলক কম বৃষ্টি হচ্ছে রংপুরে। এ ছাড়া দেশের অন্য প্রায় সব জায়গাতেই বৃষ্টি হচ্ছে।

গতকাল চট্টগ্রামে ২২৩ মিলিমিটার, হাতিয়ায় ২১৮, কক্সবাজারে ২০৮, ময়মনসিংহে ৫২, ঢাকায় ৪৯, সিলেটে ৩২, রাজশাহীতে ৩১, খুলনায় ৯০, সাতক্ষীরায় ৫২ ও বরিশালে ৭২ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে।

একই সঙ্গে আবহাওয়া অধিদফতর আরও ভারী বর্ষণের সতর্কবার্তা দিয়েছে। বলা হয়েছে, সক্রিয় মৌসুমী বায়ুর প্রভাবে আজ রংপুর, রাজশাহী, ময়মনসিংহ, ঢাকা, খুলনা, বরিশাল, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের কোথাও কোথাও ভারী (৪৪-৮৮ মিলিমিটার) থেকে অতি ভারী (৮৯ মিমি বা অধিক) বর্ষণ হতে পারে। এমনকি ভারী থেকে অতি ভারী বৃষ্টির কারণে চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের পাহাড়ি এলাকায় কোথাও কোথাও ভূমিধসের আশঙ্কা রয়েছে বলে সতর্ক করে দিয়েছে আবহাওয়া অধিদফতর।

এমন পরিস্থিতিতে দেশের মানুষ কিছুটা হলো শঙ্কিত। এই দুর্যোগের কারণে একদিকে যেমন যোগাযোগ ব্যবস্থা বিঘিœত হচ্ছে, তেমনি শাকসব্জি ও ফসলের চাষবাসেও ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। বিশেষ করে দেশের অন্যতম বাণিজ্যিক এলাকা চট্টগ্রামের চাক্তাই ও খাতুনগঞ্জ পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে রাজধানীতেও। গত কয়েকদিনে বিভিন্ন শাকসব্জির দাম কেজিপ্রতি বেড়েছে। অনেকক্ষেত্রে পাওয়াও যাচ্ছে না। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মোটা চালের দাম। ফলে এক ধরনের কষ্টে দিনাতিপাত করতে হচ্ছে দুর্যোগ কবলিত এলাকার মানুষকে।

এ নিয়ে উদ্বিগ্ন দেশের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞরাও। তাদের মতে, প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যে বন্যা ও সাইক্লোন মোকাবেলায় বাংলাদেশের অবস্থান কিছুটা ভালো হলেও সার্বিক ব্যবস্থাপনা এখনো সন্তোষজনক নয়। কারণ পরিবর্তিত জলবায়ুর ফলে পরিবর্তিত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে প্রাকৃতিক ব্যবস্থাগুলো দিন দিন দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। মানবসৃষ্ট দুর্যোগ বাড়ছে। তারা একই সঙ্গে দুর্যোগ মোকাবেলায় নেওয়া বিভিন্ন উদ্যোগ বাস্তবায়নের ওপর জোর দিয়েছেন।

অবশ্য আগামী দুদিনের মধ্যেই চলমান দুর্যোগ কমে যাবে বলে মনে করছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতরের মহাপরিচালক ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ রিয়াজ আহম্মদ। তিনি প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, এখন যে বৃষ্টিপাত, সেটি প্রতিবছর এই সময়েই হয়। কিন্তু এবার বেশি হচ্ছে। তবে আগামী দুদিনের মধ্যে বৃষ্টিপাত কমে আসবে। পানি নামতে শুরু করবে। দুর্যোগ মোকাবেলায় সরকারের প্রস্তুতিও ভালো। চিন্তার কিছু নেই।

দুর্যোগ মোকাবেলায় বাংলাদেশ কতটুকু প্রস্তুত এবং কেনই বা এমন দুর্যোগের মুখে বারবার পড়ছে বাংলাদেশ- জানতে চাইলে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ রিয়াজ আহম্মেদ বলেন, পাহাড়ধস রোধে ও ঝুঁকিপূর্ণভাবে সেখানে বসবাসরত মানুষকে নিরাপদে সরিয়ে নিতে এলাকাভিত্তিক কমিটি করে দেওয়া হয়েছে। তারা নিরাপদে মানুষকে সরিয়ে নিচ্ছে এবং আগাম সতর্কবার্তা দিচ্ছে। এ ছাড়া প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় এখন আমাদের প্রস্তুতি ভালো। কারণ অগ্রিম সতর্কবার্তা দিতে পারছি। আশ্রয় কেন্দ্র হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্তদের ত্রাণ দেওয়া হচ্ছে। সবই হচ্ছে পরিকল্পিত ও সমন্বিতভাবে। আইনগত কাঠামো মেনে চলা হচ্ছে।

এই বিশেষজ্ঞ জানান, প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দুর্যোগপ্রবণ দেশগুলোর মধ্যে দুর্যোগ মোকাবেলায় বাংলাদেশের অবস্থান ষষ্ঠ। আমরা অনেক দেশের কাছেই এখন মডেল। তবে দুর্যোগ মোকাবেলায় আরো গবেষণা দরকার। কেন জলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে, কিন্তু কতটা, সেটার গবেষণা লাগবে। কারণ এবার হাওরে যে অকস্মাৎ বন্যা, সেটা গত ৫০-৭০ বছরের মধ্যে এবারই প্রথম এত আগে হলো। একই কারণে পাহাড় ধসছে। প্রাকৃতিক সবুজ কমে যাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের যেসব বহিঃপ্রকাশ, সেগুলো জানতে গবেষণা দরকার।

তবে মানবসৃষ্ট দুর্যোগ বাড়ছে উল্লেখ করে এই বিশেষজ্ঞ বলেন, পাহাড় কাটছে। গাছপালা কাটছে। জলাবদ্ধতা হচ্ছে কেবল অপরিকল্পিত নগরায়ণের কারণেই। বাঁধের স্নুইস গেটগুলো ঠিকমতো কাজ করছে না। এমনিতেই বাংলাদেশ দুর্যোগপ্রবণ দেশ। দুর্যোগের স্বরূপ জানতে হবে। দুর্যোগ মোকাবেলায় প্রস্তুতি রাখতে হবে ব্যক্তি পর্যায় পর্যন্ত। তবেই দুর্যোগ থেকে রক্ষা সম্ভব।

অবশ্য অপর বিশেষজ্ঞ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক আক্তার মাহমুদের মতে, বন্যা ও সাইক্লোন ব্যতিরেকে অন্যান্য দুর্যোগ মোকাবেলায় বাংলাদেশের প্রস্তুতি সন্তোষজনক নয়। এই বিশেষজ্ঞ বলেন, এ দুটি দুর্যোগ মোকাবেলায় বাংলাদেশের সুনাম রয়েছে। তবে এর জন্য মানুষকে কম খেসারত দিতে হয়নি। কারণ বন্যা ও সাইক্লোনের ইতিহাস অনেক পুরনো। অনেক মানুষের প্রাণহানি হয়েছে। ক্ষয়ক্ষতিও ব্যাপক। দীর্ঘদিনের ফলে একটি সফলতা এসেছে। কিন্তু জলাবদ্ধতা, ভারী বৃষ্টিপাত ও অপরিকল্পিত নগরায়ণের ফলে যে দুর্যোগ, তা মোকাবেলায় কোনো উন্নতি হয়নি। পাহাড় ধসের কারণ নিয়ে যে গবেষণা, তাতে ঘাটতি রয়েছে। প্রাকৃতিকভাবে প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় প্রস্তুতি বাংলাদেশের নেই বললেই চলে।

দুর্যোগ মোকাবেলায় করণীয় কি জানতে চাইলে এই বিশেষজ্ঞ বলেন, বাংলাদেশ ছোট দেশ। মানুষ বেশি। প্রত্যেক দুর্যোগ মোকাবেলায় আলাদা কাঠামো দরকার। যে নদী, পাহাড়, বনভূমিসহ যেসব প্রাকৃতিক অঞ্চল রয়েছে, সেগুলোর প্রাকৃতিক অবস্থা ধরে রাখতে হবে। জাতীয় ভৌত পরিকল্পনা ও কাঠামো দরকার। সে অনুযায়ী, প্রাকৃতিকে সংরক্ষণ করতে হবে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় যেসব উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, সেগুলো বাস্তবায়ন করতে হবে।

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
প্রাকৃতিক দুর্যোগ,দুর্ভোগ
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist