রেজওয়ান শরিফ, টাঙ্গাইল

  ২২ মে, ২০১৯

পাথরাইলকে তাঁতশিল্প নগরী ঘোষণার দাবি

ঈদকে কেন্দ্র করে সরগরম টাঙ্গাইলের তাঁতশিল্প

‘একসময় তাঁত শাড়ি তৈরির কারখানায় কাজ করলেও মাঝখানে বিদেশ গিয়েছিলাম ভাগ্যের পরিবর্তন আনতে। কিন্তু সেই চেষ্টা ফলপ্রসূ হয়নি। তাই দেশে ফিরে আবারও শাড়ি তৈরির কাজে যোগ দেই। এতে ভাগ্যের তেমন কোন পরিবর্তন না হলেও দু’বেলা দু’মুঠো খেয়ে-পড়ে বাঁচতে পারি।’ কথাগুলো বলছিলেন টাঙ্গাইলের দেলদুয়ার উপজেলার পাথরাইল ইউনিয়নের নলসদা গ্রামের আব্দুর রশিদ মিয়া।

ধুলটিয়া এলাকার রতন বসাক বলেন, ‘ঈদের মওসুম হওয়ায় কাজের চাপ অনেক বেশি। দিন-রাত অনবরত কাজ করতে হচ্ছে। একটু বেশি পরিশ্রম হলেও পারিশ্রমিকটাও ভালোই মেলে।’ আব্দুর রশিদ ও রতনের মতো অনেকেই বললেন প্রায় রকম একই কথা।

টাঙ্গাইলের ঐতিহ্যবাহী তাঁত পল্লী খ্যাত পাথরাইল, বাজিতপুর, চন্ডি, বিষ্ণপুর, মঙ্গলহোড় এলাকায় গিয়ে তাঁত শিল্পের সাথে জড়িত বিভিন্ন পর্যায়ের লোকজনের সাথে কথা বলে এবং বিপণী বিতানগুলো ঘুরে তাদের কথার সত্যতা পাওয়া যায়।

নানা রং ও বাহারি ডিজাইনের শাড়ি তৈরি করতে কারিগররা যেমন দম ফেলার সময় পাচ্ছে না। তেমনি নারীরাও পিছিয়ে নেই একই কাজ থেকে। কেউ চরকা ঘুরিয়ে সুতা কাটছেন। কেউবা আবার সুতা রং করে রোদে শুকাচ্ছেন। কথা বলার সময়টুকুও যেন নেই। তাই কাজের ফাঁকে ফাঁকে চলছিল তাদের সাথে কথোপকথন।

সূত্র জানায়, টাঙ্গাইলের তিনটি উপজেলার বেশ কয়েকটি এলাকায় মূলত তাঁত শাড়ি তৈরি হয়। এগুলো হচ্ছে—টাঙ্গাইল সদর উপজেলার বাজিতপুর, সুরুজ, বার্থা, বামনকুশিয়া, গোসাইজোয়ার, তারটিয়া, এনায়েতপুর, বেলতা, গড়াসিন, সন্তোষ, কাগমারী। দেলদুয়ার উপজেলার ধুলটিয়া, পাথরাইল, চন্ডি, নলুয়া, দেওজান, নলশোঁধা, বিষ্ণুপুর, মঙ্গলহোড় এবং কালিহাতী উপজেলার বল্লা-রামপুর, ছাতিহাটি, আইসড়া, রতনগঞ্জ প্রভৃতি গ্রামে তৈরি হচ্ছে মনোমুগ্ধকর ও রুচিসম্মত টাঙ্গাইল তাঁত শাড়ি।

এবারের ঈদ ও পূজার আকর্ষণ হচ্ছে—হাইব্রিট, সুতি ও সিল্ক জামদানি, বালুচুরি, ধানসিঁড়ি, আনারকলি, গ্যাস সিল্ক, ডেঙ্গু, শপসিল্ক, রেশম, তশর, ফোরফ্লাই, কাতান, শাপাইরা, একতারি দোতারি, মনপুরা, সুতি ও কুচি ইত্যাদি। এই ঈদে এসব শাড়ি ক্রেতাদের নজর কারবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট শাড়ি তৈরির কারিগর ও ব্যবসায়ীরা।

সরেজমিনে যজ্ঞেশ্বর এন্ড কো., মনে মন্টু, স্বপ্ন শাড়িসহ বিভিন্ন শাড়ি বিক্রির বিপণী বিতানগুলোতে গিয়ে দেখা যায়, খুচরা ও পাইকারি ক্রেতাদের উপচেপড়া ভীড়। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এসেছেন তারা শাড়ি কিনতে। ঈদ উপলক্ষে কেউ এসেছেন তার দোকানের জন্য শাড়ি মজুদ করতে। কেউবা এসেছেন পরিবারের সদস্যদের জন্য অতি প্রয়োজনীয় ও পছন্দের শাড়ি ক্রয় করতে। টাঙ্গাইলের তাঁত শাড়ি ছাড়া রমণীদের ঈদ আনন্দ যে সম্পূর্ণ হয় না সে কথা তাদের মুখেই শোনা যায়।

ঢাকা থেকে আসা রোমনা হক বলেন, প্রতি বছরই আমি টাঙ্গাইল আসি শুধু পরিবারের সদস্য ও আত্মীয়-স্বজনদের জন্য শাড়ি কেনার জন্য। এখানে এসে নিজের পছন্দ মতো শাড়ি কিনতে পেরে স্বাচ্ছন্দ বোধ করি।

গাজিপুর থেকে আসা কণা নামের অপর এক ক্রেতা বলেন, এখানে এসে তুলনামুলক অনেক কম দামে শাড়ি কেনা যায়। ইচ্ছেমতো ঘুরে ও দেখে অনেক কাপড়ের মধ্যে পছন্দসই কাপড় কিনতে চাইলে এখানে আসতেই হবে।

‘টাঙ্গাইল স্বপ্ন শাড়ির’ স্বত্ত্বাধিকারী রাজিব খান বলেন, আমরা সব সময় তাঁতের তৈরি নতুন ডিজাইনের শাড়ি বিক্রি করে থাকি। হাতে কাজ করা ও মেশিনে কাজ করা দুই ধরণের শাড়ি আমাদের কাছে রয়েছে। ঈদ উপলক্ষে বিপুল পরিমাণ শাড়ি মজুদ করেছি। আশা করি ক্রেতাদের চাহিদা পূরণ করতে সক্ষম হবো।

শাড়ি প্রস্তুতকারক ও ব্যবসায়ী খোকন বসাক বলেন, টাঙ্গাইল তাঁত শাড়ির কদর আগেও যেমন ছিল, এখনো তেমনি আছে। কিন্তু দিন দিন শাড়ি তৈরির র’ম্যাটারিয়ালসের দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে। অপরদিকে ভারত থেকে নিম্নমানের রংচঙা শাড়ি আমদানি হচ্ছে। ফলে টাঙ্গাইল তথা দেশের এই ঐহিত্যময় শিল্পটি আজ হুমকির সম্মুখীন।

টাঙ্গাইল তাঁত মালিক সমিতির সভাপতি রঘুনাথ বসাক পাথরাইলকে তাঁত শিল্প নগরী হিসেবে ঘোষণার দাবি করে বলেন, প্রাচীন এই শিল্পকে বাঁচাতে সরকারিভাবে বহুমুখী ও যুগোপযোগী উদ্যোগ নিতে হবে। পাশাপাশি শাড়ি তৈরির র’ম্যাটারিয়ালসের দাম কমিয়ে বিশ্বব্যাপী শাড়ির নতুন নতুন বাজার তৈরির দাবি জানান তিনি। এছাড়াও রমণীদের তথাকথিত আধুনিক পোশাক বাদ দিয়ে শাড়ি পরিধানের আহ্বান জানান এই ব্যবসায়ী নেতা।

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
টাঙ্গাইল,বিপণী বিতান,পাথরাইল,তাঁতশিল্প
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close