রাকিবুল ইসলাম রাকিব, গৌরীপুর

  ০৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯

‘বয়স্ক শিক্ষা চালু হলে আমি ইউসুফ ভর্তি হবো’

স্বপ্ন ছিল লেখাপড়া করে শিক্ষক হবো। কিন্ত ভাগ্যদোষে হয়ে গেলাম রিকশাচালক। এখন স্কুলে যাওয়ার বদলে পেটের দায়ে রিকশা চালাই। তবে পোশাক ও কথাবার্তায় স্মার্ট হওয়ায় অনেকেই আমাকে রিকশাচালক ভাবে না। তাই যাত্রীও পাই কম। তবে এটা নিয়ে আমার দুঃখ নেই!

প্রতিদিনের সংবাদের সঙ্গে কথাগুলো বলছিলেন রিকশাচালক ইউসুফ আলী ইয়াসিন (৪০)। সে ময়মনসিংহের গৌরীপুর উপজেলার রামগোপালপুর ইউনিয়নের নওয়াগাও গ্রামের মৃত জাফর আলী ছেলে। দুই ভাই চার বোনের মধ্যে ইউসুফ পঞ্চম।

সোমবার রাতে রিকশাচালক ইউসুফের দেখা মিলে গৌরীপুর পৌর শহরের মধ্যবাজার এলাকায়। পড়নে ছিল তার সাদা শার্ট-কালো প্যান্ট। গায়ে জড়ানো শীতের কোর্ট, মাথায় ওলের টুপি। শীতের রাতে পরিপাটি হয়ে তিনি রিকশা নিয়ে যাত্রীর অপেক্ষা করছিলেন।


অভাবের কারণে দিনে একবেলাও ভাত খেতে পারতাম না। সংসারের হাল ধরতে স্কুল ছেড়ে কাজ নিই ঢাকায়। চার বছর সেখানে কাজ করে বাড়ি চলে আসি। কাজ নিই গৌরীপুরের একটি হোটেলে। কিন্তু হোটেল মালিক সকাল ৭টা থেকে রাত ১টা পর্যন্ত কাজ করাতো। তাই বাধ্য হয়ে কাজ ছেড়ে রিকশা চালাই। এরপর প্রায় ২৫ বছর কেটে গেছে এই পেশায়


কাছে গিয়ে ইশারায় ডাক দিতেই ইউসুফ বলেন, কোথায় যাবেন ভাইয়্যা। সাংবাদিক পরিচয় দিলে ভুল ভাঙে তার। যাত্রীর অপেক্ষায় থাকতে থাকতে প্রতিদিনের সংবাদের সঙ্গে গল্প জমে উঠে ইউসুফের। তিনি বলেন, দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ার সময় আমার দরিদ্র কৃষক বাবা প্যারালাইসিসড হয়ে বিছানায় পড়ে যায়। তখন অভাবের কারণে দিনে একবেলাও ভাত খেতে পারতাম না। সংসারের হাল ধরতে স্কুল ছেড়ে কাজ নিই ঢাকায়। চার বছর সেখানে কাজ করে বাড়ি চলে আসি। কাজ নিই গৌরীপুরের একটি হোটেলে। কিন্তু হোটেল মালিক সকাল ৭টা থেকে রাত ১টা পর্যন্ত কাজ করাতো। তাই বাধ্য হয়ে কাজ ছেড়ে রিকশা চালাই। এরপর প্রায় ২৫ বছর কেটে গেছে এই পেশায়।

ইউসুফের বাবা মারা গেছে ২৪ বছর আগে। বয়সের ভারে তার মা আমেনা খাতুনও বিছানায় পড়েছে। দাম্পত্য জীবনে ইউসুফের স্ত্রী ও তিন ছেলে রয়েছে। এর মধ্যে বড় ছেলে প্রথম শ্রেণিতে ও ছোট ছেলে শিশু শ্রেণিতে পড়ে। সবার ছোট ছেলেটার বয়স তিন বছর।

প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত রিকশা চালান ইউসুফ। এতে তার আয় হয় ৪শ থেকে ৫শ টাকা। এই টাকা দিয়েই চলে তার সংসার, ছেলেদের পড়াশোনা ও বৃদ্ধ মায়ের চিকিৎসার খরচ।

ইউসুফ বলেন, আমরা প্রয়াত শিক্ষাবিদ আসকার ইবনে শাইখের বংশধর। গরিব হলেও গুছিয়ে কথা বলি। সবসময় ভালো কাপড় পড়ি। কিন্তু যে টাকা আয় করি সেটা থেকে একসঙ্গে কাপড় কেনা সম্ভব হয় না। তাই প্রতিদিন ৫০ টাকা স্থানীয় একটি কাপড়ের দোকানে জমা রাখি। ১ মাস পর ১৫শ টাকা হলে নতুন শার্ট-প্যান্ট কিনে আনি। অবশ্য ভালো কাপড় পড়ায় লোকে কটূক্তি করে বলে—ভাত খাইতে পায় না, সাইকেল দৌড়াইয়্যা আগতে যায়।

অর্থের অভাবে ইউসুফ জমি-বাড়ি করতে পারেননি। অন্যের জমিতে তিনি কুঁড়েঘর তোলে পরিবার নিয়ে থাকেন। রিকশা চালিয়ে খেয়ে না খেয়ে দিন পার করলেও কেউ তাদের খোঁজ নেয় না। সহযোগিতাও পায় না কারো কাছ থেকে। তবে এসব নিয়ে তার দুঃখ নেই। তার দুঃখ শুধু লেখাপড়া না করতে পারায়।

ইউসুফ বলেন, আমার এখনো লেখাপড়া করতে ইচ্ছে করে। কিন্তু এই বয়সে তো স্কুলে ভর্তি হতে পারবো না। তবে বয়স্ক শিক্ষা আবার চালু হলে, আমি ইউসুফ ভর্তি হবো।

এরই মাঝে ঘড়ির কাঁটায় রাত ১২টা বেজেছে। জনশূন্য হয়ে গেছে শহরের পথঘাট। এমন সময় আগমন ঘটে সাংবাদিক রইছ উদ্দিন ও শফিকুল ইসলাম মিন্টুর। ইউসুফকে দেখেই তারা বলেন, কিরে এতো রাতে এখনো বসে আছিস। বাড়ি ফিরবি কখন? কথার রেশ টেনে ইউসুফ বলেন, ভাইয়্যা শীতের দিন, যাত্রী পাইনি। মায়ের ওষুধের টাকা এখনো জোগাড় হয়নি। তাই রিকশা নিয়ে যাত্রীর অপেক্ষায় বসে আছি।

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
বয়স্ক শিক্ষা,গৌরীপুর,রিকশা চালক
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close