জুবায়ের চৌধুরী

  ০৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯

সড়কে শৃঙ্খলা ফিরছেই না

নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের নজিরবিহীন আন্দোলনের পরও শৃঙ্খলা ফেরেনি সড়কে। তাই সড়ক শৃঙ্খলায় চতুর্থ দফায় অভিযান শেষ করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তড়িঘড়ি করে নানা উদ্যোগ নিয়ে সড়কে কিছুটা শৃঙ্খলা আনা গেলেও তা টেকসই হয়নি। ফলে দুর্ঘটনাও কমেনি। ঝুঁকি রয়ে গেছে পদে পদে। প্রতিদিনই দেশের বিভিন্ন স্থানে ছোট-বড় একাধিক দুর্ঘটনা ঘটছে। থামছে না মৃত্যুর মিছিল। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে চালকদের বেপরোয়া মনোভাবের কারণেই দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না। আইনকানুন মানছে না বলেই সড়ক-মহাসড়কে নানা নৈরাজ্য চলছে। অদক্ষ চালকের অবহেলা, অত্যধিক যাত্রী বহনের মাত্রাতিরিক্ত বাণিজ্যিক প্রবণতা, সর্বোপরি বেপরোয়া প্রতিযোগিতায় বারবার দুর্ঘটনা ঘটছে। বুয়েটের গবেষণা বলছে, সড়কের সক্ষমতার চেয়ে অতিরিক্ত গাড়ি, বেপরোয়া গতি ও ওভারটেকিংয়ের কারণেই সড়কে মৃত্যুর ঘটনা বন্ধ হচ্ছে না।

গত জুলাইয়ে বাসচাপায় রাজধানীর শহীদ রমিজউদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই শিক্ষার্থী নিহতের পর আন্দোলনে নামেন শিক্ষার্থীরা। কোমলমতি শিশুদের দেখানো পথে কিছুদিন হাঁটা শুরুর পর আবার চিরচেনা রূপ রাজধানীর সড়কে। বেড়েছে বাসের ওভারটেকিং, বন্ধ হয়নি পথচারীদের হাত দেখিয়ে রাস্তা পারাপার। শুধরায়নি কেউ, শৃঙ্খলা ফেরেনি রাজপথে। আলোচিত সেই দুর্ঘটনার পর আগস্ট থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত টানা দুই মাসের বিশেষ অভিযান চালায় পুলিশ। তখন সড়কে কিছুটা শৃঙ্খলা ফিরেছিল। তবে একাদশ জাতীয় নির্বাচন ঘনিয়ে আসায় অভিযানে বিরতি আসে।

এদিকে হঠাৎ থেমে যাওয়ার পর রাজধানীর সড়কে শৃঙ্খলা আনতে গত ১৫ জানুয়ারি থেকে ফের পক্ষকালব্যাপী অভিযান শুরু করে ডিএমপির ট্রাফিক বিভাগ, যা শেষ হওয়ার কথা ছিল ৩১ জানুয়ারি। কিন্তু তা বাড়িয়ে ২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত করা হয়। সে হিসেবে চার দফার বিশেষ ট্রাফিক অভিযান শেষ হয় গত শনিবার। গতকাল রোববার ডিএমপি ট্রাফিক বিভাগ জানিয়েছে, বছরের প্রথম ট্রাফিক পক্ষের ১৯ দিনে মামলা হয়েছে সোয়া এক লাখ। এ সময় আদায় হয়েছে ছয় কোটি টাকা জরিমানা। তারপরও শৃঙ্খলা ফেরেনি রাজধানীর সড়কে। মহাপরিকল্পনা হিসেবে সড়ক ব্যবস্থাপনার ২৯টি সুপারিশ প্রধানমন্ত্রীর দফতরে পাঠিয়েছে পুলিশের ট্রাফিক বিভাগ। এদিকে চলমান ট্রাফিক পক্ষের মেয়াদ ২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বাড়িয়েছে ডিএমপি।

১৫ থেকে ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত পালিত হয় চতুর্থ দফার ট্রাফিক পক্ষ। তারপরও খুব একটা শৃঙ্খলা ফেরেনি রাজধানীর সড়কে। নিয়ম ভাঙার প্রতিযোগিতাই যেন বেশি। যেখানে-সেখানে গাড়ি থামিয়ে তোলা হচ্ছে যাত্রী। দরজা খোলা রেখেই চলছে বাস। ফুটওভারব্রিজ আছে হাতখানেক দূরেই, তারপরও সড়কের মাঝ দিয়েই দৌড়ঝাঁপ। নিয়ম ভাঙাই যেন নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। পুলিশ বলছে, ১২ থেকে ৩০ জানুয়ারি পর্যন্ত গড়ে প্রতিদিন মামলা হয়েছে ছয় হাজারেও বেশি। আর জরিমানা আদায় হয়েছে গড়ে দিনে ৩২ লাখ টাকার ওপরে। তারপর মিলছে না কাক্সিক্ষত সাফল্য।

রাজধানীর ট্রাফিক ব্যবস্থা ঢেলে সাজাতে, প্রধানমন্ত্রীর দফতরে ২৯ দফা প্রস্তাবনা দিয়েছে পুলিশের ট্রাফিক বিভাগ। এর কয়েকটির বাস্তবায়ন চলমান। তবে অধিকাংশরই অগ্রগতি আংশিক। পুলিশ বলছে, সড়কের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব দফতর, পরিবহন মালিক-শ্রমিক ও সাধারণ মানুষের সহযোগিতা পেলেই যানবাহন চলাচলে শতভাগ শৃঙ্খলা আসবে।

এদিকে সড়ক পরিবহন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ট্রাফিক পুলিশ শুধু নয়, সড়কে শৃঙ্খলা আনতে সংশ্লিষ্ট ৩২ সংস্থার সমন্বয়ে কর্মসূচি নিতে হবে। স্কাউটসহ বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাকে সঙ্গে নিয়ে উদ্বুদ্ধকরণ কর্মসূচি চালিয়ে যেতে হবে পথে পথে। এ জন্য ঢাকা যানবাহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) পুরস্কার প্রদান, প্রণোদনা দানসহ বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করতে পারে। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করতে ও নৈরাজ্য বন্ধে পুলিশের পাশাপাশি সরকারের অন্যান্য সংস্থাও নানা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। এসব প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন হয়েছে যৎসামান্য। নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে দেওয়া নির্দেশনাগুলোও পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি। ফলে রাজধানীর সড়কে শৃঙ্খলাও ফেরেনি। মামলা ও জরিমানা দেদার হলেও সড়কে নৈরাজ্য বন্ধে পুলিশ যেসব উদ্যোগের কথা বলেছিল, সেগুলোর পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয়নি।

মামলা-জরিমানাতেই সীমাবদ্ধ পুলিশ : মামলা-জরিমানা করেই সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানো ব্যর্থ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানো কার্যকর কোনো উদ্যোগ নিতে দেখা যাচ্ছে না তাদের। দফায় দফায় অভিযানের নামে আইন অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে মামলা-জরিমানাতেই সন্তুষ্ট থাকতে হচ্ছে তাদের। অনেকেই বলছেন, এভাবে সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানো অসম্ভব। তবু গৎবাঁধা সেই কাজই করছে পুলিশ। তবে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এসব পদক্ষেপের মাধ্যমে সড়কে শৃঙ্খলা ফিরে আসার সম্ভাবনা খুব একটা নেই। সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে বেশ কয়েকটি সংস্কার আনা জরুরি। এসবের মধ্যে রয়েছে, তিন শতাধিক বাসরুটকে কমিয়ে আনা, চালককে চুক্তিতে নিয়োগ না দিয়ে বেতনভুক্ত হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা, ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার আমূল পরিবর্তন এবং চালকদের প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ করে গড়ে তোলা।

এদিকে ঢাকাসহ সারা দেশে সড়কে প্রতিদিনই ঝরছে প্রাণ। ওভারটেকিং ও অসুস্থ প্রতিযোগিতার পাশপাশি চালকের অদক্ষতা এসব দুর্ঘটনার জন্য বেশি দায়ী। অধিকাংশ চালকেরই নেই কোনো প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ। বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট করপোরেশন (বিআরটিসি) মনে করছে, চালকের অদক্ষতা, যান্ত্রিক ত্রুটি, চালক ও পথচারীদের অসাবধানতা প্রভৃতি কারণে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে। এ সমস্যাগুলোর সমাধান করা না গেলেই অবস্থার উন্নতি ঘটানো সম্ভব নয়।

বাসগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতা এবং চালকের বেপরোয়া মনোভাবে কারণে ঢাকা শহরে সড়ক দুর্ঘটনার একটি বড় কারণ বলে চিহ্নিত করেছেন সড়ক পরিবহন বিশেষজ্ঞরা। বুয়েটের অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (এআরআই) পরিচালক ড. মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, সড়ক দুর্ঘটনায় চালকদের বেপরোয়া মনোভাবের জন্য অনেকাংশে মালিকরাই দায়ী। কারণ মালিকরা প্রতিদিন বাসটি চুক্তিতে চালকদের হাতে ছেড়ে দেয়। ফলে চালকদের মাথায় সব সময় চুক্তির বাইরে আরো বেশি টাকা আয় করার চিন্তা থাকে। আবার ঢাকা শহর যেহেতু অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠেছে, সে জন্য এখানকার রাস্তার নেটওয়ার্কও পরিকল্পিত নয়। ঢাকা শহরে উত্তর-দক্ষিণমুখী সড়ক বেশি থাকলে পূর্ব-পশ্চিমমুখী সড়ক খুবই কম।

বেসরকারি এক পরিসংখ্যানে উঠে এসেছে, কেবল সড়ক দুর্ঘটনায়ই দেশে গড়ে প্রতিদিন ৩০ জনের প্রাণহানি ঘটছে। এ হিসেবে মাসে ৯০০ জন এবং বছরে ১০ হাজার ৮০০ জন মারা যাচ্ছে। তবে বিআরটিএ বলছে, এ সংখ্যা দিনে ১৬ এবং বছরে ৫ হাজার ৭৬০। অনেকে বলছেন, সড়কে মৃত্যু যাই হোক, এক হিসেবে দেখা গেছে, দেশে সন্ত্রাসীদের হাতে শতকরা ৩০ জন লোক মারা গেলে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায় ৭০ জন। ৩০ জনের জানমাল রক্ষায় সরকারি বাহিনী থাকলে ৭০ জনের জীবনরক্ষায় অর্থাৎ সড়ক দুর্ঘটনা রোধে বিশেষ বাহিনী থাকার প্রয়োজন আছে বলে মনে করছেন তারা।

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
সড়কে শৃঙ্খলা,নিরাপদ সড়ক,রাজধানী
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close