রাকিবুল ইসলাম রাকিব

  ১৭ জানুয়ারি, ২০১৯

মুচি বাবুলালের আকুতি

‘অহন মনে হয় হাত পাতন লাগবো রে’

মাঘের মিষ্টি সকাল। কুয়াশা ভেঙে তেজ ছড়াচ্ছে সূর্য। শীতের আড়মোড়া ভেঙে জেগে উঠছে প্রকৃতি। আর এই সাতসকালেই ষাটোর্ধ্ব এক বৃদ্ধ লোক সড়কের পাশে পাটি বিছিয়ে সুই-সূতো দিয়ে জুতা সেলাই করে চলছেন একমনে। মাঝে মাঝে দু’একটা দ্রুতগতির গাড়ি সড়কে ধুলা উড়িয়ে ছুটে চলেছে গন্তব্যে। বৃদ্ধ লোকটি তখন সুরক্ষা পেতে গলায় জড়ানো মাফলার দিয়ে নিজের নাক মুখ চেপে ধরছেন। বৃহস্পতিবার সকালে এই দৃশ্য ধরা পড়ে ময়মনসিংহের গৌরীপুর পৌর শহরের পাটবাজার এলাকার হারুন টি স্টলের সামনে।

কাছে যেতেই বৃদ্ধ লোকটি এ প্রতিনিধিকে বলে উঠেন, জুতা সিলি না জুতা কালি করবাইন? সাংবাদিক পরিচয় দিলে ভুল ভাঙে। প্রতিদিনের সংবাদকে জানান, তার নাম বাবুলাল রবিদাস। বাড়ি উপজেলার জেলখানা মোড় এলাকা মমিনপুর গ্রামে। বাবা-স্বর্গীয় সুন্দর রবিদাস। দুই ভাই-বোনের মধ্যে বাবুলাল সবার বড়। অভাব-অনটনের কারণে পৈত্রিক সূত্রেই এই পেশায় আসা।

কথা বলতে বলতেই এক তরুণের পুরাতন জুতা সেলাই করছিলেন বাবুলাল। সুই-সূতোর ফোড়নে নিপুণ কৌশলে খুব দ্রুতই কাজটি সম্পন্ন করলেন। কাজ শেষে টাকা দিয়ে পারিশ্রমিক দিয়ে চলে যায় তরুণ। নতুন কাস্টমারের অপেক্ষায় থাকতে থাকতে প্রতিদিনের সংবাদের সঙ্গে গল্প জুড়ে দেন তিনি। বলেন, অভাবের লাইগ্যা ইশকুলে যাওয়া অয় নাই। সংরামের আগে থেইক্যাই বাপের লগে হাঁট-বাজারে বইয়্যা এই কাম করি। বাপ মইর‌্যা গেলেও আমি অহনো এই কামেই লাইগ্যা আছি।

বাবুলালের বাবা-মা মারা গেছেন প্রায় ২০ বছর। দাম্পত্য জীবনে বাবুলাল বিয়ে করেছেন ফুলদাসী রবিদাসকে। তাদের সংসারে পাঁচ ছেলে ও তিন মেয়ে। কিন্তু অর্থের অভাবে তার কোনো সন্তানই প্রাথমিকের গণ্ডি পেরোতে পারেনি। এরমধ্যে তিন ছেলে বাদল, কার্তিক, সুবল ও দুই মেয়ে রানী, ঋতা বিয়ের পর আলাদা হয়েছে। তারা বাবুলালের খুব একটা খোঁজ নেয় না। বর্তমানে দুই ছেলে সুজন, পূজন ও এক মেয়ে সীমা ও স্ত্রীকে নিয়েই অভাব-অনটনে চলছে তার সংসার।

স্বাধীনতার আগে থেকেই পাটবাজার এলাকায় পাটি বিছিয়ে মুচির কাজ করতেন বাবুলাল। নব্বই দশকে বাবুলাল মুচির কাজ করে প্রতিদিন ২শ থেকে ২৫০ টাকার মতো আয় করতেন। তবে সময়ের পরিক্রমায় আশে পাশে আরো মুচির দোকান হওয়ায় ব্যবসায় ভাটা পড়েছে বাবুলালের। তার এখানে জুতা কালি ১৫ থেকে ২০টাকা। এছাড়া ছেড়া জুতা সেলাই করে মেরামত করা হয় ৫ থেকে ১০ টাকায়। দিনশেষ তার আয় হয় এখন ৭০ থেকে ৯০ টাকার মতো।

বাবুলাল বলেন, ঘরের ভিডা ছাড়া আমার আর কিচ্ছু নাই। যে টেকা কামাই করি, হেইডা দিয়া সংসার চলে না। শেষমেষ যে কবে দুইশ টেকা কামাই করছিলাম মনেও নাই। অভাবে পইড়্যা পোলা সুজইন্যারে ওয়াকশপের কামে দিছি। হে অহন সংসারে কিছু দেয়, হেরপরেও টানাটানি।

কথা প্রসঙ্গে বাবুলাল জানান, নিচু জাতের লোক হওয়ায় অনেকই তাদের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে। অভাবগ্রস্থ হলেও কেউ সাহায্য করে না। পড়তে পারে না ভালো কাপড়। জাতীয় পরিচয়পত্রে বয়স ভুল হওয়ায় সে পায় না বয়স্ক ভাতা। এসব নিয়ে বাবুলালের কোনো দুঃখ নেই। তবে তার দুঃখ শুধু ছোট মেয়ে সীমাকে নিয়েই। নান্দাইল থেকে মেয়ের বিয়ের ঘর এসেছে। কিন্তু টাকার জন্য বিয়ের আলাপটা সে এগোতে পারছে না।

এরই মাঝে সকালের কুয়াশা কেটে গেছে। আকাশে খেলা করছে ঝলমলে রোদ। এমন সময় গল্পে যোগ হয় চা দোকানি হারুন। গ্যাসের চুলোয় চায়ের কেটলি বসিয়ে হারুন বলেন, বাবুলাল অভাবী হইলেও খুব সৎ মানুষ। জমি বেইচ্যা বড় দুই মাইয়্যারে বিয়া দিছে। কারো কাছে হাত পাতে নাই। কথার রেশ টেনে বাবুলাল বলেন, অহন মনে হয় হাত পাতন লাগবো রে হারুন। ছোট মাইয়্যার বিয়ার ঘর আইছে। কিন্ত আমি তো সব জমি বেইচ্যা বড় দুই মাইয়্যারে বিয়া দিয়া দিছি, ছোট মাইয়্যার বিয়ার কথা তহন ভাবি নাই।

পিডিএসও/প্রতিনিধি/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আকুতি,মুচি বাবুলাল,হাত পাতা,গৌরীপুর
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close