মোঃ নাজমুল সাঈদ সোহেল, চকরিয়া(কক্সবাজার)

  ২৪ অক্টোবর, ২০১৮

চকরিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স নিজেই রোগী!

কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে প্রতিনিয়ত ঘটছে রোগীদের হয়রানি আর দূর্ভোগ। ৫০ শষ্যা বিশিষ্ট সরকারি হাসপাতালটিতে চিকিৎসা সেবা মারাত্বক ভাবে ব্যাহত হচ্ছে। প্রতিদিন এ হাসপাতালে উপজেলার ১ টি পৌরসভাসহ ১৮ ইউনিয়নের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে আসা রোগীরা সুচিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। তাছাড়া হাসপাতালের বেডের শষ্যাগুলো নোংরা, অপরিস্কার ও অপরিচ্ছন্নতায় ভরা। রোগীদের খাবারের জন্য বরাদ্দ দেয়া অর্থ হাসপাতাল কতৃপক্ষের যোগসাজশে হরিলুট করে রোগীদের অস্বাস্থ্যকর খাবার পরিবেশনের অভিযোগও রয়েছে দায়িত্বপ্রাপ্ত ঠিকাদারের। হাসপাতালের বড় কর্তা যেন সব কিছু জেনে না জানার ভান করে বসে আছেন।

বর্তমান সরকার চিকিৎসাখাতে যে উন্নয়ন করেছেন তা চকরিয়া হাসপাতালের কয়েকজন ডাক্তার ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছেন বলেও জানা গেছে।

হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, হাসপাতালের মোট কার্যপরিচালনার আসন সংখ্যা ৩৯জন হলেও বর্তমানে দ্বায়িত্বরত রয়েছেন ১১জন। তারমধ্যে ২জন প্রশাসনিক কার্যক্রমের দ্বায়িত্বে রয়েছেন একজন হাসপাতাল ইনচার্জ ডাঃ শাহবাজ অন্যজন যাবতীয় কার্যক্রম দেখবালের দ্বায়িত্বে আরএমও ডাঃ শোভন দত্ত। আর ৯ জনের মধ্যে ৩ জন মেডিকেল অফিসার- ডাঃ তোফাজ্জল হোসেন, ডাঃ উম্মে কুলসুম ও মোস্তাফিজুর রহমান। কনস্যালটেন্ট রয়েছেন ৬ জন, এদের মধ্যে ডাঃ মর্তুজা রেনু, ডাঃ খালেদ হোসেন, ডাঃ মুজিবুল হক, ডাঃ একরামুল হোসেন, ডাঃ শামস তারেক। বিগত উপজেলার ১৮ ইউনিয়নের জন্য ১৮জন পৌরশহরের জন্য ৭ জন ডাক্তারের আসন সংখ্যা রয়েছে। ৩৩ তম বিসিএস পরীক্ষার পর একসাথে ১৪জন মেডিকেল অফিসারকে পোষ্টিং দেয়া হয়েছিল চকরিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের জন্য। হাসপাতালে ২০১৪ সালেও ছিল আসন সংখ্যা অনুযায়ী পরিপূর্ণ। কিন্তু এর পরবর্তী সময়ে আসন সংখ্যা হ্রাস পেতে থাকে যার পিছনে রয়েছে এক গোপন রহস্য। সে রহস্যজট নিবারণের মাথাব্যথা প্রশাসনিক দ্বায়িত্ববোধ কারো কাছে নেই বললেই চলে।

হাসপাতালে লাগোয়া ডায়াগনস্টিক সেন্টার পরিণত হয়েছে চিকিৎসকদের প্রাইভেট ক্লিনিকে। রোগীরা হাসপাতালের সুচিকিৎসা না পাওয়ার কারণে ভিড় জমাচ্ছে ডাক্তারদের প্রাইভেট চেম্বারে। সরকারিভাবে বরাদ্দ দেয়া মুল্যবান ওষুধ গুলো ভাগ্যে জুটেনা রোগীদের। সরকার বেঁধে দেয়া নিয়ম অনুসারে সকাল ৮ টা থেকে বেলা আড়াইটা পর্যন্ত ডাক্তারদের হাসপাতালে আগত রোগী দেখার নিয়ম থাকলেও মূল পিকআওয়ার টাইম ১০টা থেকে ১২টা পর্যন্ত। অভিযোগ বাকি সময় ডাক্তাররা প্রাইভেট ক্লিনিকে চিকিৎসাসেবায় ব্যস্ত থাকেন। তাই এ সময় তাদের খুঁজে পাওয়া মুশকিল।

শুধুমাত্র সরকার দেয়া বেতন ভাতাগুলো হালাল করতে কয়েক ঘণ্টা সময় হাসপাতালে কাটিয়ে তারা ব্যক্তিগত চেম্বারে প্রাইভেট রোগী দেখার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এ ব্যাপারে সচেতন নাগরিক কমিটি হাসপাতালের অনিয়ম ও দূর্নীতির ব্যাপারে সরেজমিনে তদন্ত করে বহুবার প্রতিবেদন দিলেও সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে উর্ধ্বতন কতৃপক্ষ কোনও আইনি ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছেনা বলে গুরুতর অভিযোগ রয়েছে। এ উপজেলায় জায়গা জমির বিরোধসহ সামাজিক নানা ঘটনা-দূর্ঘটনায় দ্বারস্থ হতে হয় ডাক্তারদের। এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে কর্তব্যরত ডাক্তাররা মিথ্যা জখমী সনদ প্রদান করে হাতিয়ে নিচ্ছে লাখ লাখ টাকা। এ কারণে থানা ও আদালতে মিথ্যে মামলার সংখ্যা দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।

এ হাসপাতালে নিয়োজিত ডাক্তারদের মধ্যে বেশির ভাগই প্রাইভেট ক্লিনিক নিয়ে ব্যস্ত। অনেকেই দীর্ঘদিন ধরে এখানে একাধারে কর্মরত থাকা অবস্থায় হাসপাতালটি তাদের পৈত্রিক জমিদারী মূলে পরিণত হয়েছে। ডাক্তারা অফিস চলাকালীন সময়ে ও প্রাইভেট চেম্বারে বসে রোগী দেখার কাজে ব্যস্ত থাকতে দেখা গেছে। আবার কয়েকজন ডাক্তার স্থানীয় ঔষুধ কোম্পানীর এম.আর সাথে যোগসাজস থাকার ফলে দাম্বিকতার সহিত অফিস চলাকালীন সময়ে বিভিন্ন ক্লিনিকে রোগী দেখতে চলে যায়, এদিকে হাসপাতালে ডাক্তারের রুমের সামনে দরিদ্র রোগীরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে থাকার পরও চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত হয়ে বাড়ি ফিরে যেতে হচ্ছে। এ সব অভিযোগ হাসপাতালে আগত রোগীসহ চকরিয়ার সাড়ে ছয় লক্ষ জনসাধারণের।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, বেলা ১১টার দিকে হাসপাতালে সেবা নিতে আসা রোগীদের দীর্ঘ লাইন কিন্তু দেখা নেই কোনও ডাক্তারের। যেখানে বসে ডাক্তার বা রোগীর সেবা দিবেন প্রায় ডক্তার কক্ষে তালা ঝুলানো, শুধু মাত্র তিনটি রুমে দাঁতের ও গাইনী ডাক্তার বসে সব রোগীদের কিছু প্যারাসিট্যামল, নাপা, গ্যাস্টিকের ঔষুধ লিখে দিয়ে বিদায় করে দিচ্ছেন, রোগীদের দীর্ঘ লাইন। অনেকের কাছেই জানতে চাওয়া হলে তালা লাগানো রুমের ডাক্তারা গেল কোথায়? জবাবে সবাই বলল- সকাল থেকে আমরা দাঁড়িয়ে আছি কোনও ডাক্তার এসে রোগী দেখেনি।শুধুমাত্র ২ রুমে গাইনী ও ডেন্টাল ডাক্তার দিয়ে সব রোগের রোগীদের সেবা দিচ্ছেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে হাসপাতালের অফিস সহকারী বলেন, এখন প্রতিদিনই এরকম হয়, আমরা প্রতিবাদ করলে বদলী করে দেওয়ার হুমকি দেওয়া হয়, তাই আমরা দেখেও চুপ করে থাকি। সরকার নিযুক্ত এখানে ৭/৮জন কনসালটেন্ট প্রতিদিন রোগী দেখার কথা, কিন্তু একজন গাইনী কনসালটেন্ট ছাড়া বাকিরা আসে শ্বশুর বাড়িতে জামাই বেড়াতে আসার মত সাপ্তাহে ১দিন, আবার কেউবা দেড় দিন। হাসপাতালের মূল ইনচার্জ (টিএইচ) দ্বায়িত্বে যিনি আছেন ওনার প্রতিদিনই হাসপাতালে উপস্থিত থাকার নিয়ম থাকলেও সাপ্তাহে আসেন ২/৩দিন।

হাসপাতাল ইনচার্জ (টিএইচ) ডাঃ শাহবাজ বলেন, হাসপাতাল তিনটি বিভাগে পরিচালিত হয়ে থাকে- বহিঃবিভাগ, জরুরি বিভাগ, আবাসন বিভাগ। সে অনুসারে আমাদের পর্যাপ্ত ডাক্তার নেই, স্বল্পসংখ্যক ডাক্তার দিয়ে তিনটি বিভাগ পরিচালনা করা অনেকটা দুঃসাধ্য। বেশ কয়েকবার অফিসিয়ালি আমার উর্ধ্বতন কতৃপক্ষের নিকট অবহিত করার পরেও কোনও প্রকার সুরাহা হয়নি। চলমান পরিস্থিতি নিয়ে ডাক্তার অনুপস্থিতির বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে তিনি এড়িয়ে যান।

কক্সবাজার ভারপ্রাপ্ত সিভিল সার্জন রফিক-উজ সালেহীনের কাছে উপরোক্ত বিষয়ে মুঠোফোনে জানতে চাওয়া হলে তিনি রাজধানী ঢাকায় মিটিংয়ে আছেন বলে ফোনের লাইন কেটে দেন।

পিডিএসও/রিহাব

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
চকরিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স,রোগী
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close