নাজমুল সাঈদ সোহেল, চকরিয়া (কক্সবাজার) প্রতিনিধি

  ১৮ অক্টোবর, ২০১৮

মাতামুহুরীর ভাঙনে বিপর্যস্ত জনপদ

বান্দরবানের আলীকদম ও লামা উপজেলা এবং কক্সবাজার জেলার চকরিয়া ও পেকুয়া উপজেলা হয়ে বঙ্গোপসাগর-মোহনা পর্যন্ত প্রবাহমান মাতামুহুরী নদীর দৈর্ঘ্য ২৮৬ কিলোমিটার। এরমধ্যে চকরিয়া উপজেলার মধ্য দিয়ে বয়ে গেছে নদীর প্রায় শত কিলোমিটার অংশ। প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমে মাতামুহুরী নদীতে উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল সবকিছুই লণ্ডভণ্ড করে দিয়ে যায়।

অনেক স্থানে বাড়ির চাল (ছাদ) পর্যন্ত পানিতে তলিয়ে থাকায় অন্যত্র ঠাঁই নিতে হয়। খাবার ও বিশুদ্ধ পানির সংকট তো থাকতই। এ নিয়ে মানুষকে যে দুর্বিষহ যন্ত্রণা ভোগ করতে হতো তা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। কথাগুলো কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার মাতামহুরী নদীর আশপাশের গ্রামের বাসিন্দাদের।

নদীর তলদেশের সামান্য অংশ দিয়ে ছড়াখালের মতো পানি চলাচল করলেও বৃহদাংশ চর জেগে খেলার মাঠ ও ফসলি জমিতে রুপ পেয়েছে। এই নদী কারো জন্য আশির্বাদ হলেও অনেকের জন্য অভিশাপ। উজান থেকে নেমে আসা পলিমাটি ও বালি জমে ভরাট হয়ে গেছে মাতামুহুরী নদী।

মাতামুহুরী নদীর অববাহিকায় আঁকাবাঁকা গতিপথ। এ কারণে প্রতিবছর বর্ষামৌসুমে চকরিয়া পৌরসভাসহ উপজেলার পশ্চিমাংশ রক্ষা পাচ্ছেনা বন্যার তাণ্ডব থেকে। তবে লোপকাটিংয়ের মাধ্যমে বন্যার কবল থেকে রক্ষা করা সম্ভব। নদীর আঁকাবাঁকা অববাহিকাকে লোপকাটিং প্রকল্প ও নদী খননের মাধ্যমে পানি চলাচলের পথ সোজা হলে সুফল গুণবে জনসাধারণ। উজান থেকে মাতামুহুরী নদীতে পানি সরাসরি লোপকাটিং দিয়ে ভাটির দিকে দ্রুত নেমে যাবে। একই সঙ্গে জনসাধারণ দাবি করেন নদীর ভাঙন, জনবসতিসহ নানা স্থাপনা, চিংড়িঘের ও ফসলী জমি রক্ষা করা। অবশ্য এ দাবি আজকের না, দীর্ঘদিনের। ১৯৮৭ সালের ভয়াবহ বন্যার পর থেকে চকরিয়াবাসী দাবি জানিয়ে আসছেন সরকার বাহাদুরের কাছে।

অভিযোগ রয়েছে, পার্বত্য অঞ্চলের আলীকদম ও লামা উপজেলার বনাঞ্চলের গাছ কাটার পাশাপাশি গোড়ালিও উত্তোলন করে ফেলায় এবং নিয়মিত পাহাড় কেটে পাথর উত্তোলন করায় ছোট-বড় পাহাড়গুলোর মাটি বৃষ্টির পানির সাথে ভেসে এসে মাতামুহুরীর তলদেশ ভরাট হয়ে যায়। এতে মাতামুহুরী নদীর দু-কূল ভাঙছে প্রতিনিয়ত। বিশেষ করে বর্ষা আসলেই নদী তীরবর্তী বাসিন্দারা ভাঙনের কবলে পড়ার ভয়ে আতঙ্কে থাকেন। মাত্র দু’দশকেই এই নদীর ভাঙনে অন্তত দশ হাজার বসতভিটা বিলীন হয়েছে।

এর মধ্যে চকরিয়ার মানিকপুর, কাকারা, ফাঁসিয়াখালী, পৌরসভার একাংশ, নামার চিরিংগা পুরাতন বাজার, তৎসংলগ্ন মামা-ভাগিনার মাজার, কবরস্থানের আংশিক, পুরনো থানা ও হাসপাতালের ভিটে তলিয়ে গেছে নদীতে। এছাড়াও লক্ষ্যারচর, কাজির পাড়া, বেতুয়াবাজার, সাহারবিল, সীতারখিল, ছোট ভেওলা, খীলছাদক এলাকা ভাঙন ঝুঁকিতে রয়েছে।

কৈয়ারবিল ইউনিয়নের খীলছাদক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শওকত ওসমান বলেন, কৈয়ারবিল ইউনিয়নের খীলছাদক এলাকাটি বর্তমানে দ্বীপ অঞ্চলে পরিণত হয়েছে। নদী ভাঙনের ফলে শত শত ঘর বাড়ি উধাও। আরো একটা এলাকা বিলীন হওয়ার পথে।

এই এলাকার শতকরা আশিভাগ মানুষ কৃষির ওপর নির্ভরশীল। বর্তমানে স্কুল ভবনটি ও ঝুঁকির মুখে। চিরিঙ্গা ইউনিয়নের মতো ব্লক বসানোর সিদ্ধান্ত নিলে বদলে যাবে হাজারো মানুষের বর্ষা মৌসুমের অতুলনীয় কষ্ট। এবিষয়ে উপজেলা চেয়ারম্যানসহ সংশ্লিষ্ট মহল যদি একটু সদয় দৃষ্টি দেন তাহলে খীলছাদকবাসীর সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।

চকরিয়া পৌরসভার মেয়র আলমগীর চৌধুরী বলেন, মাতামুহুরী নদীর পৌরসভা অংশে ভাঙনরোধকল্পে ইতিপূর্বে দু-একটি স্থানে শহর রক্ষা বাঁধ দেয়া হয়েছে। ঝুঁকিপূর্ণ অন্য স্থানে বাঁধ নির্মাণ করতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে আবেদন করা হয়েছে।

কাকারা ইউপি চেয়ারম্যান শওকত ওসমান বলেন, ইউনিয়নের মাইজকাকারা অংশে বেড়িবাঁধ দেয়ায় ঢালের ক্ষতি থেকে চলতি বর্ষায় কাকারার অনেক বাসিন্দা রক্ষা পেয়েছে। দিঘীর নিকটবর্তী হাজিয়ান সড়কের সেতু পয়েন্টে একটি স্লুইস গেট বসানোর পাশাপাশি আরো ৫-৬ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ দেয়া হলে এবং ওই বাঁধের নদী সাইটে ব্লক বসানো হলে বন্যা ও ভাঙন থেকে লাখো মানুষ রক্ষা পাবে।

চকরিয়া উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি জাফর আলম প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, বর্ষা মৌসুম আসলেই মাতামুহুরী নদীর আঁকাবাঁকা গতিপথের কারণে চকরিয়া উপজেলার মানুষ ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়ে নিঃস্ব হয়ে আসছিলো। এর প্রভাব গিয়ে পড়তো পার্শ্ববর্তী কৈয়ারবিল ইউনিয়ন এবং পৌরসভার বিশাল অংশেও। একবার ভয়াবহ বন্যা দেখা দিলে ভাটির দিকে পানি নামতে কয়েকদিন সময় পেরিয়ে যেত। এতে মানুষের দুর্ভোগের শেষ থাকত না।

চকরিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নূরুদ্দীন মুহাম্মদ শিবলী নোমান প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, সরেজমিনে মাতামুহুরী নদীর ভাঙন পরিদর্শন করে পানি উন্নয়ন বোর্ডের কাছে একটি প্রতিবেদন পাঠানো হয়েছে। শিগগিরই পজেটিভ কিছু একটা হবে বলে বিশ্বাস করি।

পানি উন্নয়ন বোর্ড কক্সবাজারের চিরিংগা শাখা কর্মকর্তা (এসও) তারেক বিন ছগির বলেন, মাতামহুরী নদীর ভাঙন নিয়ে একটি প্রতিবেদন মন্ত্রনালয়ে পাঠানো হয়েছে। ইতোমধ্যে তিনশ মিটারের একটি প্রকল্প অনুমোদন হয়েছে। এতে এক কোটি টাকার কাছাকাছি একটা বরাদ্দ হতে পারে। জিও ব্যাগ দিয়ে ভাঙন ঠেকানো হবে।

মাতামহুরী নদীর লোপকাটিং বা পাথরের ব্লক বসানো বাস্তবায়ন না হলে মানুষ প্রতিবারের মত আবারও বন্যায় ক্ষতির সম্মুখীন হবে। বন্যার কবল থেকে রক্ষা পেতে হলে লোপকাটিং ও নদী খননের মাধ্যমে গ্রামের হাজার হাজার পরিবার রক্ষা করা সম্ভব হবে বলে সচেতন মহল দাবি করেন।

পিডিএসও/অপূর্ব

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
মাতামুহুরী,ভাঙন,বিপর্যস্ত,জনপদ
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close