পাবনা প্রতিনিধি
ভেজালের জাঁতাকলে দিশেহারা গো-খামারিরা
কোরবানিকে সামনে রেখে পাবনার সাঁথিয়া ও বেড়া গোখাদ্যের চাহিদা ব্যাপক বেড়েছে। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে অসাধু গোখাদ্য ব্যবসায়ীরা তৎপর হয়ে উঠেছে। তারা গোখদ্যে ভেজাল মেশানোর পাশাপাশি ওজনেও কারচুপি করছে। এছাড়া গবাদিপশুর ভেজাল ওষুধ তৈরি করে একটি চক্র বাজারে ছাড়ছে বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ অবস্থায় খামারিরা একদিকে যেমন প্রতারিত হচ্ছেন, অন্যদিকে তাঁদের গরুগুলোও অসুস্থ হয়ে পড়ছে।
খামারিরা জানান, কোরবানি ঈদের সামনে প্রতি বছরই গোখাদ্যের চাহিদা বেড়ে যায়। তবে এ বছর চাহিদা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে গোখাদ্যের দামও ব্যাপক বেড়ে গেছে। মাস তিনেক আগেও ৩৭ কেজি ওজনের প্রতি বস্তা ভুসি ৮৫০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। অথচ এখন বিক্রি হচ্ছে ১২৫০ টাকায়। ৩০০ টাকা মণ দরের খড় বিক্রি হচ্ছে ৪০০ টাকায়।
প্রতি বস্তায় ৩৭ কেজি করে ভুসি থাকার কথা থাকলেও এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী দুই থেকে চার কেজি করে ভুসি কম দিচ্ছে। এসব ব্যবসায়ীর দোকানে সেলাই মেশিন রয়েছে। তাঁরা ৩৭ কেজি ওজনের প্লাস্টিকের বস্তা থেকে দুই থেকে চার কেজি ভুসি বের করে তা নতুন করে সেলাই করে দেয়। আবার কোনো কোনো ব্যবসায়ী ওজন সঠিক দেখানোর জন্য বের করে নেওয়া ভুসির পরিবর্তে কাঠের গুঁড়ো, তুষ, পচা আটাসহ বিভিন্ন ধরনের ভেজাল মিশিয়ে দেয়। খামারিরা বস্তাগুলোতে নিখুঁত সেলাই ও লেবেল দেখে তা ভালো ভুসি মনে করে কিনে নিয়ে যান।
অন্যদিকে গরুর প্রধান খাদ্য খড় কিনতে গিয়েও খামারিরা প্রতারিত হচ্ছেন। খর বিক্রেতারা প্রতিমণ খরে ৫ থেকে ৮ কেজি করে ওজন কম দিচ্ছে বলে খামারিরা অভিযোগ করেছেন। সরেজমিনে সাঁথিয়া বেড়ার কয়েকটি খড় বিক্রির স্থান ঘুরে দেখা গেছে সেখানে খড় ওজন করার কোনো ব্যবস্থা নেই। অনুমানের ভিত্তিতে বিক্রেতারা খড়ের বোঝা তৈরি করে তা খামারিদের কাছে মণ হিসেবে বুঝিয়ে দিচ্ছেন।
সাঁথিয়া বাজারের খর বিক্রেতা হোসেন আলী ও বেড়া বাজারের বাজারের খর বিক্রেতা আব্দুল হক জানান, একসময় বিশেষ ধরণের দাঁড়ি-পাল্লার মাধ্যমে ওজন করে খর বিক্রি করা হলেও এখন অনুমানের ভিত্তিতেই তা বিক্রি করা হয়। এতে দুই-এক কেজি এদিক-ওদিক হলেও বড় ধরণের হেরফের হয় না বলে তাঁরা দাবি করেন।
বৃশালিখা মহল্লার খামারি মোমিন মোল্লা বলেন, ‘বাজার থেকে পাঁচ মণ খর কিইন্য বাড়ি আইন্য দেখি ওজনে চার মনেরও কম। আর বাজারে এখন ভালো ভুসি পাওয়াই মুশকিল। ভেজাল ভুসি খায়া গরুগুল্যা অসুস্থ হত্যাছে, দুধও কুইম্যা যাত্যাছে। এ অবস্থায় আমরা (খামারিরা) এখন চরম অসহায় অবস্থার মধ্যে আছি।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পাবনার সাঁথিয়া,বেড়া ও সুজানগর উপজেলায় ভেজাল গোখাদ্যের বিরুদ্ধে প্রশাসনের পক্ষ থেকে এর আগে বার বার অভিযান চালিয়ে অসাধু ব্যবসায়ীদের জরিমানা করা হয়েছে। কিন্তু তিন-চার বছর ধরে দুই উপজেলায় ভেজাল গোখাদ্য ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোনো অভিযানই আর দেখা যাচ্ছে না। এই সুযোগে ভেজালকারীরা সক্রিয় হয়ে উঠেছে। তবে প্রশাসনের পক্ষ অভিযান না থাকলেও বেড়ার নাকালিয়া বাজারে গত বছরের (২০১৭) ২২ আগস্ট বাজার পরিচালনা কমিটি ২২টি গোখাদ্যের দোকানে অভিযান চালিয়ে আটজন অসাধু গোখাদ্য ব্যবসায়ীর সন্ধান পায়। বাজার পরিচালনা কমিটি এসব ব্যবসায়ীর কাছ থেকে ৪৫ হাজার টাকা জরিমানা আদায় করে।
নাকালিয়া বাজার পরিচালনা কমিটির সভাপতি নজরুল ইসলাম বলেন, ‘গোখাদ্যে ভেজাল ও ওজনে কম দেওয়ার অভিযোগটি দীর্ঘদিনের। প্রশাসনের যে কাজ করা উচিত সেটি আমরা করে প্রশংসিত হয়েছিলাম। আবারও আমাদের এ বাজারসহ অন্যান্য বাজারে গোখাদ্যে ভেজাল ও ওজনে কম দেওয়া নিয়ে অভিযোগ পাচ্ছি। প্রশাসন পদক্ষেপ না নিলে আমরা আবারও এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নেব।’
এদিকে শুধু গোখাদ্যেই নয় গবাদিপশুর চিকিৎসায় (ভেটেরিনারি) ব্যবহৃত ওষুধও ভেজাল করা হচ্ছে অভিযোগ পাওয়া গেছে। গোপনে জেলার বিভিন্ন উপজেলার বিভিন্ন স্থানে কারাখানা বসিয়ে অসাধু ব্যক্তিরা চালু কোম্পানির নকল ভেটেরিনারি ওষুধ তৈরি করে ওষুধের দোকানে সরবরাহ করছে। এসব নকল ওষুধ কিনে প্রতারিত হচ্ছেন খামারিরা। চলতি বছরের ২৪ জানুয়ারি আমিনপুর থানা পুলিশ ওই এলাকায় এমনই একটি নকল ওষুধ কারখানার সন্ধান পেয়ে বিপুল নকল ওষুধ ও ওষুধ তৈরির উপকরণসহ এক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করে এবং ১ লক্ষ টাকা জরিমানা করেন ভ্রাম্যমান আদালত। খামারিদের অভিযোগ বেশি লাভের আশায় দুই উপজেলার কিছু কিছু ওষুধ ব্যবসায়ী নকল ওষুধ উৎপাদনকারীর সঙ্গে আঁতাত করে দোকানে ক্ষতিকর এসব নকল ওষুধ রেখে খামারিদের কাছে বিক্রি করছে। এদের বিরুদ্ধে প্রশাসনের অভিযান নেই বললেই চলে।
সাঁথিয়ার সমাসনারি গ্রামের খামারি রেজাউল হক বলেন, ‘কয়েকদিন আগে কাশীনাথপুর বাজারের একটি ওষুধের দোকান থেকে দুই বোতল ভিটামিন নিছিল্যাম। ওষুধ খাওয়ানোর পর গরু দুইট্যার কুনু উপকার দূরের কথা, উল্টো অসুস্থ হয়া গেছিল। পরে পরীক্ষা কইর্যা দেখল্যাম ভিটামিন দুইট্যা নকল।’
সাঁথিয়া ও বেড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) যথাক্রমে জাহাঙ্গীর আলম ও আসিফ আনাম সিদ্দিকী জানান, ভেজাল গোখাদ্যসহ নকল ওষুধের ব্যাপারে অভিযোগ পেয়ে তাঁরা উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তাদের খোঁজ নিতে বলেছেন। এ ব্যাপারে প্রমাণ পাওয়া গেলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
পিডিএসও/রানা