মাহাবুব চান্দু, মেহেরপুর

  ২৪ এপ্রিল, ২০১৮

আশার আলো দেখাবে মোমিনুলের উদ্ভাবিত আর্সেনিক মুক্ত ফিল্টার

নিজের আবিষ্কৃত ফিল্টারে পানি কিভাবে হচ্ছে দেখছেন মোমিনুল ইসলাম

মেহেরপুর জেলা শহর থেকে মাত্র ৫ কিলোমিটার দূরে উজলপুর গ্রাম। যে গ্রামে নিরাপদ পানি যেন দুঃষ্প্রাপ্য। অধিকাংশ বাড়ির টিউবওয়েলে রয়েছে আয়রণ ও আর্সেনিক। গ্রামের চার রাস্তার মোড়ে সেভ দ্য চিলড্রেনের বসানো আর্সেনিক রিমুভ্যাল প্লান্ট স্থাপন করা হয়েছে। অর্থের বিনিময়ে সেখান থেকে গ্রামের দুঃস্থ মানুষ পানি নিতে পারেনা। বাধ্য হয়ে গ্রামের দুঃস্থরা প্রায় এক কিলোমিটার দূরে কৃষি ব্যাংক পাড়া থেকে পানি সংগ্রহ করে। গ্রামের মানুষের ভোগান্তি দেখে ওই গ্রামেরই যুবক মোমিনুল ইসলাম আবিষ্কার করেন দূষণমুক্ত পানির ফিল্টার।

ফিল্টার আবিষ্কারের সময় মোমিনুল মাটির কলসের নিচে ছিদ্র করে তার মধ্যে বালি দিয়ে পানি ঢেলে শুরু করে ফিল্টার তৈরির কাজ। মোমিনুল তখন দশম শ্রেণির ছাত্র। পরবর্তীতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সম্মান ও স্নাতোকোত্তর শেষ করে ২০১৩ সালের দিকে বাড়ি ফিরেন তিনি।

বাড়ি ফিরে একইভাবে পানি নিরাপদ করার কাজ শুরু করেন। একদিন ওই পানি নিয়ে যান জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অফিসে। সেখানে পানি পরীক্ষা করার পর তিনি জানতে পারেন পানি আয়রণ মুক্ত হলেও আর্সেনিক মুক্ত হয়নি।

তখন নতুন করে তার মাথায় চিন্তা তৈরি হয়। আর্সেনিক কি? শুরু করেন ইন্টারনেটে লেখাপড়া। পরে সেখান থেকে জানতে পারেন কিভাবে আর্সেনিক মানুষের ক্ষতি করে। আর্সেনিক মুক্ত করতে কী প্রয়োজন। শুরু হয় তার ফিল্টার তৈরির নতুন পথচলা।

মোমিনুল ইসলাম জানান, ফিল্টারের প্রটোটাইপটি তৈরি করতে একটি টিনের ড্রাম ব্যবহার করা হয়েছে। ড্রামের মাঝখানে একটি ফিল্টার বসানো হয়েছে। তবে এতে বিদ্যুৎ ও কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয়নি। মধ্যাকর্ষণ শক্তিকে কৃত্রিম শক্তিতে রূপান্তর করে কাজ করা হয় ফিল্টারটিতে। ফিল্টারের মধ্যে বালি ও কাঠ কয়লা নির্দিষ্ট পরিমাণে ব্যবহার করা হয়েছে। ফিল্টারেশনের কারণে পানিতে যে ময়লা জমা হয় তা একটি পাইপের মাধ্যমে উপর দিয়ে বের হয়ে ডাস্ট পটে জমা হয়। তার পাশেই রয়েছে নিরাপদ পানি বের হওয়ার পাইপ। যার মাথায় দু’টি সুইচ ব্যবহার করা হয়েছে। সুইচের মাধ্যমে পানির প্রবাহকে বাড়ানো-কমানো যায়। একটি বড় পরিবারের রান্না ও খাবার পানির পরিপূর্ণ চাহিদা পূরণ করতে সক্ষম ফিল্টারটি। আয়রন ও অন্যান্য কারণে ফিল্টারটি কখনই বন্ধ হওয়ার সম্ভাবনা নেই। আর যদিও আয়রনের কারণে কখনো বন্ধ হয়ে যায় দুই থেকে দশ মিনিটের মধ্যে ফিল্টারটি যে কেউ পরিষ্কার করতে পারবেন। পানি শেষ হওয়ার পূর্ব মূহুর্তে টিউন সিগন্যাল দেবে ফিল্টারটি।

মোমিনুল ইসলাম আরো জানান, আর্সেনিকের পাশাপাশি আয়রন, ম্যাঙ্গানিজ, টারবেডিটি, রং দুর্গন্ধসহ অন্যান্য ক্ষতিকর উপাদান ও ব্যাকটিরিয়া দূর করতে সক্ষম তার আবিষ্কৃত ফিল্টারটি। সরকারি বা বেসরকারি সহযোগিতা পেলে ফিল্টারটি জনসাধারণের কাছে পৌঁছানো সম্ভব হবে।

তিনি আরো জানান, ইতোমধ্যে শিল্প ও বানিজ্য মন্ত্রণালয়ের প্যাটেন্ট অধিদপ্তরে আবেদন করা হয়েছে। জেলা প্রশাসক পরিমল সিংহ স্যার আবেদনের জন্য অর্থ সহযোগিতাসহ বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করেছেন। আশা করি প্যাটেন্ট অনুমোদন হয়ে যাবে। প্যাটেন্টটি অনুমোদন হলে যে কোনো কোম্পানির সাথে চুক্তি করে এটি বাজারজাত করা সম্ভব হবে।

ঝিনাইদহ জেলার আঞ্চলিক পানি গবেষণাগারে উদ্ভাবিত ফিল্টার ও প্রতিবেশীদের পানি পরীক্ষার রিপোর্ট থেকে জানা গেছে, প্রতিবেশীর নলকূপের পানিতে প্রতি লিটারে আর্সেনিকের মাত্রা ০.৩৯৬ মিলিগ্রাম, আয়রন ১৩.০৬ মিলিগ্রাম, ম্যাঙ্গানিজ ১.০২ মিলি গ্রাম পাওয়া যায়। অথচ ফিল্টার করার পরে ওই পানিতে আর্সেনিকের মাত্রা ০.০৬৯ মিলিগ্রাম, আয়রন ০.৭৪ মিলিগ্রাম, ম্যঙ্গানিজ ০.০৫ মিলি গ্রাম পাওয়া যায় । পরবর্তীতে প্রটোটাইপটি কিছুটা উন্নত করা হলে ওই আর্সেনিকের মাত্রা ০.৩৯৬ থেকে ০.০০৯ মিলিগ্রাম, আয়রন ১৩.০৬ থেকে ০.০০ মিলিগ্রাম পাওয়া যায় । কিছুদিন পর অন্য প্রতিবেশী মোঃ মোস্তাকিন শাহ্ এর নলকূপের পানি ও উক্ত পানি ফিল্টার করে পরীক্ষা করা হয়। এতে আর্সেনিকের মাত্রা আসে ০.১৮১ মিলিগ্রাম থেকে ০.০০৭ মিলিগ্রাম পাওয়া যায় ।

আর্সেনিক ও অন্যান্য সমস্যা দূরীকরনে এমন একটি ফিল্টার খুবই প্রয়োজন বলে মনে করছেন অনেকেই। তবে সরকারি, বেসরকারি, এনজিও ও দেশি বিদেশি কোম্পানিগুলোর সহযোগিতায় পনি দুষণমুক্ত করে সব শ্রেণির মানুষের সহজপ্রাপ্য করতে চায় মোমিনুল। মোমিনুলের এই ফিল্টার ২৪ ঘন্টায় ৯০ লিটার পানি দুষণমুক্ত করতে পারে।

মোমিনুলের প্রতিবেশী আব্দুর রশিদ জানান, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লেখাপড়া করার পর থেকে তার মাথায় ওই ফিল্টার ছাড়া আর কিছু নেই। সারাদিন সে ফিল্টার নিয়ে পড়ে থাকে। কয়েকটি চাকরি করেও ছেড়ে দিয়েছে। এলাকায় সকলে তাকে পাগল বলে ডাকে। তবে তার ফিল্টারটি যাতে মানুষের উপকারে আসে সেজন্য সরকারি সহযোগিতা দরকার।

কে এই মোমিনুল: মেহেরপুর সদর উপজেলার উজ্জলপুর শাহজী পাড়ার মৃত লুৎফর রহমানের বড় ছেলে মোমিনুল ইসলাম। ২০০৫ সালে পার্শ্ববর্তী কুলবাড়িয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের মানবিক বিভাগ থেকে এসএসসি, ২০০৭ সালে মেহেরপুর পৌর কলেজের মানবিক বিভাগ থেকে এইচএসসি এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ২০১২ সালে ইসলামের ইতিহাস ও সাংস্কৃতিক বিষয় নিয়ে সম্মান(অনার্স) এবং ২০১৩ সালে একই বিশ্ববিদ্যালয়ে মাষ্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন। শিক্ষাজীবনের প্রতিটিতেই তিনি প্রথম শ্রেণিতে উন্নীত হয়েছেন। দুই ভাইয়ের মধ্যে মোমিনুল বড়। সংসারের দায়িত্বও তার কাধে। ফিল্টারটিকে উন্নত রুপ দানের লক্ষ্যে বেশ কয়েকটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করার পরও ছেড়ে দিয়েছেন তিনি।

মেহেরপুর জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুল গফফার মোল্লা জানান, তিনি বিষয়টি সম্পর্কে অবগত হয়েছেন উদ্ভাবকের দাবি অনুযায়ী অল্প খরচে ফিল্টারটি বাজারজাত করা গেলে সাধারণ মানুষ উপকৃত হবে। আমরা দ্রুততম সময়ের মধ্যে তার উদ্ভাবনটি দেখার পর প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করবো।

মেহেরপুরের জেলা প্রশাসক পরিমল সিংহ বলেন, ইতোমধ্যে তার ফিল্টার নিয়ে জনস্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তাদের সাথে কথা হয়েছে। ফিল্টারটি বাজারজাত করতে তার কিছু অর্থ সহযোগিতা লাগবে। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তার ফিল্টারটি বাজারজাতকরণে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

পিডিএসও/রিহাব

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আশার আলো,মোমিনুল,আর্সেনিক মুক্ত ফিল্টার
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist