মামুন আহম্মেদ, বাগেরহাট

  ০৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮

বাংলাদেশের জলসীমায় ভারতীয় জেলেদের অবাধে মাছ শিকার

বিপর্যয়ের মুখে দুবলার শুঁটকিপল্লী

ভারতীয় জেলেরা বাংলাদেশের জলসীমায় অবৈধভাবে প্রবেশ করে অত্যাধুনিক ট্রলিং জাহাজ নিয়ে অবাধে মাছ শিকারের ফলে দেশিয় জেলেরা মাছ পাচ্ছেনা। ফলে, দুবলা জেলেপল্লী টহল ফাঁড়ির আওতাধীন শুঁটকি উৎপাদনকারী পাঁচটি চরে দেখা দিয়েছে ব্যাপক শুটকি সংকট। তাছাড়া, এবছর মৌসুমের শুরুতে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও প্রচন্ড শীতের কারণে আশানুরুপ মাছ ধরা পড়েনি। যে কারণে লাখ লাখ টাকা লোকসানে পড়ে হতাশায় ধুকছেন ব্যবসায়ীরা। বঙ্গোপসাগরের তীরে গড়ে ওঠা বাগেরহাটের পূর্ব সুন্দরবনের শরণখোলা রেঞ্জের ঐতিহ্যবাহী দুবলা শুঁটকিপল্লীতে একারণে এবার প্রাণচাঞ্চল্য নেই।

দুবলা মৎস্যপল্লীর বনবিভাগের কর্মকর্তা ও বহদ্দাররা (মহাজন) জানান, প্রতিবছর সরকার এ শুঁটকিপল্লী থেকে কোটি কোটি টাকা রাজস্ব আয় করে থাকে। এটিই সুন্দরবনের সর্বোচ্চ রাজস্ব আয়ের উৎস্য। বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের অংশে মাছের আধিক্য ভারতের অংশের চেয়ে বেশি থাকায় ভারতীয় জেলেরা অবৈধভাবে প্রবেশ করে ট্রলিং জাহাজ দিয়ে সমস্ত মাছ ছেঁকে (ছোট-বড় সকল মাছ ধরে নিয়ে যায়) নিয়ে যাওয়ায় দেশিয় জেলেরা মাছ পাচ্ছেনা। তাছাড়া, মৌসুমের শুরুতে কয়েক দফা প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং প্রচন্ড শীতে শুঁটকিপল্লী মাছশূণ্য হয়ে পড়েছে। খালি পড়ে রয়েছে মাছ শুকানোর কাজে ব্যবহৃত মাচান ও বাঁশের আলনাগুলো।

দুবলা ফিশারম্যান গ্রুপের ম্যানেজার মো. ফরিদ আহমেদ জানান, প্রায় ৪৫ বছর ধরে তিনি দুবলার চরে এ পেশার সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন। তার দেখামতে এবছরই শুঁটকি খাতে সবচেয়ে বেশি বিপর্যয় ঘটেছে। তিনি জানান, গত নভেম্বর মাসে ২-৩ দফা প্রাকৃতিক দুর্যোগে কম হলেও ১৫ কোটি টাকার মাছ পঁচে গেছে। তাছাড়া, বাংলাদেশের জলসীমায় ভারতীয় জেলেরা অত্যাধুনিক ট্রলিং জাহাজ নিয়ে মাছ ধরার কারণে তাদের জেলেরা জাল ফেলতে পারছেনা। সাগরে জাল ফেললেই ভারতীয় ট্রলিং জাহাজের জেলেরা মারধর করে জাল-মাছ লুট করে নিয়ে যাচ্ছে।

মাঝেরকিল্লার লেদু বহদ্দার জানান, গত ১ ফেব্রুয়ারি তার ও মুজাহার বহদ্দারের জেলেরা সাগরে মাছ ধরে ফেরার পথে ভারতীয় জেলেরা তাদের জেলেদের ওপর হামলা চালায়। ভারতীয়রা দুই ট্রলারের ১১ জেলেকে মারধর করে প্রায় ১৫ লাখ টাকার মাছ ও জাল লুট করে নিয়ে যায়। এভাবে প্রতিনিয়ত এমন ঘটনা ঘটলেও সরকার বা প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়না।

মাঝেরকিল্লা শুঁটকিপল্লীর সুকুমার বহদ্দার, মুজাহার বহদ্দার, সুধীর বহদ্দার ও আলোরকোল শুঁটকিপল্লীর শিব বিশ্বাসসহ অনেকেই অভিযোগ করে বলেন, ভারতীয় জেলেরা অবৈধভাবে বাংলাদেশের সীমানায় ঢুকে মাছ ধরে নিয়ে যাচ্ছে। অথচ আমাদের ব্যবসায়ীরা শুঁটকি মৌসুমে লাখ লাখ টাকা বিনিয়োগ করে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। ভারতীয় জেলেদের বাংলাদেশের জলসীমায় অবৈধ প্রবেশ বন্ধ না করলে অদুর ভভিষ্যতে শুঁটকি ব্যবসা বিলুপ্ত হয়ে যাবে। তারা বলেন, ভারতীয় অত্যাধুনিক ট্রলিং জাহাজে অবাধে মাছ শিকারের ফলে এবছর কোনো কোনো ব্যবসায়ী ১০ লাখ টাকা থেকে ৯০ লাখ টাকা পর্যন্ত লোকসানে রয়েছেন। মৌসুমের বাকি আছে আর মাত্র দুই (ফেব্রুয়ারি ও মার্চ) মাস। এ দুই মাসে এ লোকসান কোনোভাবেই পুরণ করা সম্ভব হবেনা। তাই ঐতিহ্যবাহী এ শুঁটকিপল্লী ও রাজস্ব আয়ের এ বিশেষ উৎস্যটি টিকিয়ে রাখার জন্য ভারতীয় জেলেদের বাংলাদেশের জলসীমায় অবৈধ অনুপ্রবেশ রোধে সরকারকে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহনের দাবি জানিয়েছেন তারা। দুবলা জেলেপল্লী টহল ফাঁড়ির ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ফরেস্ট রেঞ্জার) মো. মোকাম্মেল কবির বলেন, গত বছর শুঁটকিপল্লী থেকে রাজস্ব আয় হয়েছিলো ৩ কোটি ২ লাখ ২৭ হাজার ৮২৭ টাকা। তবে, মাছ সংকটের কারণে এবছর রাজস্ব অর্ধেকে নেমে আসতে পারে।

পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মাহমুদ হাসান বলেন, জেলেদের মাধ্যমে ঘটনাটি জানতে পেরেছি। তবে, দুর্গম সাগরে গিয়ে বনবিভাগের পক্ষে পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব নয়।

কোস্টগার্ড মোংলা পশ্চিম জোনের জোনাল কমান্ডার ক্যাপ্টেন এম মিনারুল হক বলেন, বিষয়টি জানতে পেরে ইতিমধ্যে কোস্টগার্ডের পক্ষ থেকে পদক্ষেপ গ্রহন করা হয়েছে। এছাড়া, বাংলাদেশ নৌ-বাহিনী ও ভারতীয় কোস্টগার্ডের সাথে আলোচনা করে বিষয়টি সমাধানের চেষ্টা করা হবে।

উল্লেখ্য, বঙ্গোপসাগরের তীরবর্তি শরণখোলা রেঞ্জের দুবলা জেলেপল্লী টহল ফাঁড়ির অধীনে মেহেরআলীর চর, মাঝেরকিল্লা, আলোকোল, শ্যালার চর ও নারকেলবাড়িয়াসহ পাঁচটি চরে শুঁকটি উদৎপাদন করা হয়ে থাকে। প্রতিবছর অক্টোবর মাসের শেষের দিকে চট্টগ্রাম, সাতক্ষীরা, মোংলা, রামপাল ও শরণখোলার সহ¯্রাধিক শুঁটকি ব্যবসায়ী এসব চরে এসে শুঁটকি প্রক্রিয়াজাতকরণের মাচান ও বাসা তৈরীর কাজ শুরু করেন। নভেম্বর মাস থেকেই শুরু হয় শুঁটকি আহরণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণের কাজ। চলে মার্চ মাস পর্যন্ত। প্রায় ৫০ বছরেরও অধিককাল ধরে দুবলার চরে শুঁটকি উৎপাদন হয়ে আসছে। সামুদ্রিক লইট্যা, ছুরি, রূপচাঁদা, পারসে, চিংড়িসহ বিভিন্ন প্রজাতির শুঁটকি উৎপাদন হয় এসব চরে। বঙ্গোপসাগরের নোনা (লবন) পানির এ শুঁটকি সুস্বাদু এবং দেশে-বিদেশে এর ব্যাপক সুনাম ও চাহিদা রয়েছে।

পিডিএসও/রানা

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
বিপর্যয়ের মুখে দুবলার শুঁটকিপল্লী
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist