বিশেষ প্রতিনিধি

  ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৭

আজ থেকে খোলাবাজারে বিক্রি শুরু

চাল নিয়ে ভীষণ বিপাকে মানুষ

দেশে চালের মজুদ বাড়াতে তিন মাস ধরেই নানা উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বেসরকারি পর্যায়ে আমদানি বাড়াতে আমদানির ওপর শুল্ক ২৮ শতাংশ থেকে কমিয়ে মাত্র ২ শতাংশ করা হয়েছে। বাকিতে ঋণপত্র খোলার সুযোগ পেয়েছেন আমদানিকারকরা। অবৈধ মজুদ ঠেকাতে ১৩ শতাধিক চালকল মালিককে কালো তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। চাল আমদানিতেও মনোযোগ দিয়েছে সরকার। ভিয়েতনাম, ভারত, থাইল্যান্ড, মিয়ানমার ও কম্বোডিয়া থেকে চাল আনতে চুক্তি, স্মারক স্বাক্ষর ও দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। এর ফলে দেশে চালের মজুদ কিছুটা হলেও বেড়েছে।

গত দুই মাসে বেসরকারি পর্যায়ে আমদানি হয়েছে চার লাখ টন চাল। পাশাপাশি গত এক মাসে সরকারি চালের মজুদ বেড়েছে আড়াই গুণের বেশি। বোরো মৌসুমে গত জুলাইয়ে যেখানে চালের মজুদ ছিল এক লাখ ২৩ হাজার টন, এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে তিন লাখ ২১ হাজার টনে। তারপরও চালের বাজারে দেখা দেওয়া অস্থিরতা কমছে না। বরং দিন দিন বাড়ছে। সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে চালের দাম। প্রতিদিন বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। অবস্থা এমন পর্যায়ে গেছে, গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে সব ধরনের চালের দাম কেজিপ্রতি ১০ টাকা করে বেড়েছে। ভালো মানের নাজিরশাইল ও মিনিকেট চাল কেজিপ্রতি ৭০ টাকা করে বিক্রি হচ্ছে। মাত্র তিন-চার দিনের ব্যবধানে ১০ টাকা করে বেড়ে মোটা চাল বিআর-২৮ দাঁড়িয়েছে ৫৮-৬০ টাকায়।

একই সময়ে ৪০-৪২ টাকার স্বর্ণা ও পারিজা চাল বিক্রি হচ্ছে ৫২-৫৩ টাকা কেজি দরে। এমন পরিস্থিতিতে চাল নিয়ে ভীষণ কষ্টে আছে সাধারণ মানুষ। গত জানুয়ারি থেকেই চাল নিয়ে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে তাদের। চালের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে অন্যান্য ভোগ্যপণ্যের দামও। আয়ের সিংহভাগই ব্যয় হচ্ছে খাবারের পেছনে। টান পড়ছে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বিনোদনসহ জীবনযাপনে প্রয়োজনীয় অন্যান্য খরচে। বিশেষ করে নিম্ন আয়ের দরিদ্র মানুষ সীমিত আয়ে বাড়তি দাম দিয়ে চাল কিনতে গিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়ছে। নিম্ন মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্তরা এমন ঊর্ধ্বমূল্যে চাল কিনতে হিমশিম খাচ্ছেন বলে অভিযোগ করেছেন।

অথচ পরিস্থিতি শিগগির স্বাভাবিক হচ্ছে না বলে আশঙ্কা করছেন ব্যবসায়ীরা। শিগগির চালের দাম কমার কোনো আশা দেখছেন না তারা। উল্টো দাম আরো বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন। কারওয়ান বাজারের বিক্রেতারা বলছেন, এখন যে দামে তারা চাল বিক্রি করছেন, দু-এক দিন পরে তাদের আরো বেশি দামে বিক্রি করতে হবে। কেননা তাদের এখন কিনতে হচ্ছে বেশি দামে। আর আড়তদারদের অভিযোগ, বাড়তি দাম দিয়েও মিলারদের কাছে চাল পাওয়া যাচ্ছে না। আবার দামের অস্থিরতা দেখে নিজে থেকেই চাল কেনা বন্ধ রেখেছেন অনেক আড়তদার।

দেশে চালের মূল্যবৃদ্ধি এমন পরিস্থিতিতে উদ্বেগজনকÑবলছে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থাও (এফএও)। সতর্কবার্তা দিয়ে সংস্থাটি বলেছে, গত তিন মাসে দেশে চালের দাম অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ার পরিস্থিতি উদ্বেগজনক। এ সময়ে দেশে খাদ্যের দাম, খাদ্যের সহজলভ্য ও খাদ্যের মান—এই তিন ক্ষেত্রেই পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। খাবার পাওয়ার সুযোগ কমেছে ২ দশমিক ৮ শতাংশ। এবারই প্রথম বাংলাদেশের জন্য এমন সতর্কবার্তা দেওয়া হলো। গত মঙ্গলবার এফএও বিশ্বের খাদ্য পরিস্থিতি নিয়ে এই মূল্যায়ন প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এতে বলা হয়, গত এক মাসে বিশ্বের খাদ্য উৎপাদন বেড়েছে, দামও কমেছে। বিশেষ করে চাল-গম বা দানাদার খাবারের দাম কমতির দিকে। তবে বাংলাদেশসহ বিশ্বের আটটি দেশের বাজারে প্রধান খাদ্য চালের দাম অস্বাভাবিক বেড়ে গেছে। এই প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, বাংলাদেশে গত মে থেকে আগস্টের মধ্যে চালের মূল্যবৃদ্ধি (কেজিপ্রতি ৪৮ টাকা) সর্বকালের রেকর্ড ভাঙে। কিন্তু আগস্টে দাম কিছুটা কমলেও তা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ২৫ শতাংশ বেশি ছিল।

চালের দাম নিয়ন্ত্রণে আজ থেকে খোলাবাজারে (ওএমএস) স্বল্প আয়ের মানুষের জন্য চাল ও আটা বিক্রি শুরু করবে সরকার। প্রতি কেজি চাল ১৫ টাকা ও আটা ১৭ টাকায় বিক্রি করা হবে। প্রাথমিকভাবে দেশের বিভাগীয় ও জেলা শহরগুলোয় তা চালু হবে। খাদ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ওএমএসের পাশাপাশি আগামী বুধবার থেকে ১০ টাকা কেজি দরে চাল বিক্রির খাদ্যবান্ধব কর্মসূচিও চালু হবে। এ কর্মসূচিতে চলতি সেপ্টেম্বর থেকে আগামী তিন মাস ৫০ লাখ হতদরিদ্র পরিবার ১০ টাকা কেজি দরে চাল পাবে।

খাদ্য মন্ত্রণালয় বলছে, চালের দাম ৪০ টাকার ওপরে উঠলেই দেশের প্রায় আড়াই কোটি অতি দরিদ্র মানুষের খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে স্বল্পমূল্যে খোলাবাজারে চাল বিক্রি কার্যক্রম চালু করা হয়। কিন্তু সরকারি মজুদ পাঁচ মাস ধরে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় থাকার কারণে খাদ্য মন্ত্রণালয় এখনো ওএমএস চালু করতে পারেনি। নিয়মিত সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিগুলো চালাতেই তারা হিমশিম খাচ্ছে। গত ১ সেপ্টেম্বর থেকে এ কর্মসূচি চালু হওয়ার কথা থাকলেও প্রয়োজনীয় চালের মজুদ ও সরকারের সব গুদামে চালের সুষম বণ্টন না হওয়ায় এ কর্মসূচি শুরু করা যায়নি। বর্তমানে সরকারের গুদামে প্রায় সাড়ে চার লাখ টন খাদ্যশস্য মজুদ রয়েছে। এসব চালের বেশির ভাগ চট্টগ্রাম ও খুলনাকেন্দ্রিক খাদ্যগুদামগুলোয় ছিল। কারণ, ভিয়েতনামসহ বিভিন্ন দেশ থেকে চাল আমদানি করে তা চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দরে খালাস করে বন্দরকেন্দ্রিক গুদামগুলোতে রাখা হয়। পরে তা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এ জন্য দেরিতে শুরু হচ্ছে খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি।

এ প্রসঙ্গে খাদ্যমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম বলেন, চাল নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ও ভীতি সৃষ্টির চেষ্টা করা হচ্ছে। চালের দাম ৭০ থেকে ৮০ টাকা হওয়ার কোনো কারণ থাকতে পারে না। সরকারের কাছে চালের পর্যাপ্ত মজুদ রয়েছে। আজ রোববার থেকে সব বিভাগীয় ও জেলা শহরে ওএমএস চালু হবে। যত দিন পর্যন্ত প্রয়োজন ওএমএস চালু থাকবে। মন্ত্রী আরো বলেন, চালের বাজার অস্থিতিশীল করতে একটি সিন্ডিকেট কাজ করছে। সিন্ডিকেটটি ব্যবসায়ীদের মধ্যে অপপ্রচার চালাচ্ছে। তবে এর বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছে সরকার। ইতোমধ্যে চালের অবৈধ মজুদদারদের বিরুদ্ধে অভিযান চালাতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

সরকারের এসব উদ্যোগে চালের বাজার নিয়ে অতটা আশাবাদী হতে পারছেন না বাজার বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, চালের বাজারে স্থিতিশীলতা আনতে সরকারের নজরদারি বাড়াতে হবে। সরকারকে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার তাগিদ দিয়েছেন তারা। তাদের মতে, অবশ্যই সরকারি গুদামে চালের মজুদ বাড়াতে হবে। খাদ্য অধিদফতরের গুদামে যেখানে ন্যূনতম ছয় লাখ টন চাল থাকার কথা, সেখানে আছে মাত্র সোয়া তিন লাখ টন। দেশের চালকলমালিক ও কয়েকটি দেশের সঙ্গে একের পর এক চুক্তি করেও খাদ্য মন্ত্রণালয় মজুদ বাড়াতে পারেনি। বেসরকারি চালকলমালিক ও ব্যবসায়ীদের কাছে কত চাল আছে, তা জানার জন্য ২০১৩ সালে খাদ্য মজুদ নিয়ে একটি আইন করেছিল সরকার। ওই আইন অনুযায়ী প্রতি মাসে বেসরকারি খাতের মজুতের হিসাব খাদ্য অধিদফতরের মাধ্যমে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে থাকার কথা। কিন্তু চার বছরেও ওই হিসাব নিতে পারেনি তারা। খাদ্যমন্ত্রী ও খাদ্যসচিব বলেছেন, মজুদের পরিমাণ তারা জানেন না।

দেশের অর্থনীতিবিদ ও নাগরিক সংগঠনগুলো চালের মূল্যবৃদ্ধির জন্য খাদ্য মন্ত্রণালয়কে দায়ী করছে। তারা বলছে, সরকারের চালের মজুদ কমে গেলে ব্যবসায়ীরা দাম বাড়িয়ে দেবেন—এটাই সাধারণত ঘটে থাকে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে সরকারি মজুদ বাড়ানো সবচেয়ে জরুরি। এ ব্যাপারে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, সরকারের অক্ষমতাকে ব্যবসায়ীরা কাজে লাগিয়েছেন। তারা লাভের জন্য যেকোনো সুযোগের সদ্ব্যবহার করেন। সরকারের গুদামে চাল কমে যাওয়ার খবরে ব্যবসায়ীরা চালের দাম বাড়িয়েছেন। সরকার চালের জন্য কম্বোডিয়া, থাইল্যান্ড, মিয়ানমারসহ বিভিন্ন দেশে যাওয়ায় ব্যবসায়ীরা নিশ্চিত হয়েছেন যে সরকারের সরবরাহ বৃদ্ধি করার ক্ষমতা নেই। যত দিন সরকারের চালের মজুদ ১০ থেকে ১২ লাখ টন না হবে, ততদিন পর্যন্ত অধিক মুনাফার লোভে ব্যবসায়ীরা দাম বাড়াতেই থাকবেন।

দাম বাড়ার বিষয়ে কারওয়ান বাজার কিচেন মার্কেট দোকান মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও চাল ব্যবসায়ী হাজি লোকমান হোসেন বলেন, হাওর অঞ্চলে বন্যা ও উত্তরাঞ্চলে দ্বিতীয়বার বন্যা, মিলমালিক ও বড় কৃষকদের মজুদদারি মনোভাব এবং ধানের জমিতে পাট, অন্য ফসল ও মাছের ঘের তৈরির কারণে উৎপাদন কমে যাওয়ায় চালের দাম বাড়ছে। এ ছাড়া সরকার চালের শুল্ক কমিয়ে দিলেও ভারত, থাইল্যান্ডসহ অন্য দেশগুলো চালের দাম বাড়িয়েছে। ফলে বেশি দামেই আমদানি করতে হচ্ছে। আর একই বাজারের পাইকারি চাল ব্যবসায়ী আবদুল্লাহ কবির বলেন, দেশে চালের সংকট নেই। মিনিকেট চাল যে ধান দিয়ে তৈরি হয় সেই ধান মজুদ করেছেন মিলাররা। তা ছাড়া গ্রামে মিলের সংখ্যা বেড়েছে কিন্তু সেই তুলনায় ধানের উৎপাদন বাড়েনি। ফলে প্রতিযোগিতা বেশি হওয়ায় ধানের দাম বেড়েছে। তার প্রভাব পড়েছে চালের ক্ষেত্রে।

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
চাল,বাজার
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist