গাজী শাহনেওয়াজ
স্মাটকার্ডে শতকোটি টাকার ক্ষতি
ফরাসি প্রতিষ্ঠান ওবারথুর টেকনোলজির ব্যর্থতায় স্মার্টকার্ড প্রকল্পটির এখন লেজেগোবরে অবস্থা। দেড় বছরের এই প্রকল্পের কাজ বিগত এক বছর আগে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও তা তো হয়ইনি, পরে আরো এক বছর সময় বাড়িয়ে নেওয়ার পরও কাজ শেষ করতে পারেনি প্রতিষ্ঠানটি। অবশেষে তাদের বাদ দিয়ে নিজস্ব তত্ত্বাবধানে স্মার্টকার্ডের কাজ শেষ করার ঘোষণা দিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দেশের নয় কোটি জাতীয় পরিচয়পত্রের কার্ড ছাপানোর জন্য ২০১৫ সালের শুরুতে ফ্রান্সের ওভারথুর কোম্পানির সঙ্গে ইসির চুক্তি হয়েছিল। চুক্তি অনুযায়ী, গত বছর জুন মাসের মধ্যে সব কার্ড ছাপানোর কথা ছিল। কিন্তু তা বাস্তবায়ন হয়নি। তাই ইসি আরো এক বছর সময় বাড়িয়ে এ বছরের জুন পর্যন্ত সময় দিয়েছিল ওই কোম্পানিকে। কিন্তু এ সময়ের মধ্যেও ফ্রান্সের কোম্পানিটি কাক্সিক্ষত কার্ড ছাপাতে ব্যর্থ হয়। পরে নতুন করে আবারও মেয়াদ বৃদ্ধির জন্য একাধিক বৈঠক হলেও দুই পক্ষের সমঝোতা না হওয়ায় তা ভেস্তে যায়। এ কারণে সরকারের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে কয়েক শ কোটি টাকা। ইনোভেশন ডিজাইন অ্যান্ড এনট্রাপ্রেনিউরশিপ অ্যাকাডেমি (আইডিয়া) প্রকল্পের আওতায় এই শুরু হয়েছিল।
এদিকে, চুক্তির শর্ত লঙ্ঘন, রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন, প্রতিষ্ঠানকে ইমেজ সংকটে ফেলে দেওয়া এবং আর্থিক ক্ষতি—এই চার কারণে ওবারথুরের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা করার বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে আইডিয়া প্রকল্প কর্তৃপক্ষ। এর জন্য সুপ্রিম কোর্টের আইন বিশেষজ্ঞ কিউ সি আজমালুল হককে আইনি পরামর্শক হিসেবে নিয়োগ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কর্তৃপক্ষ।
এ ছাড়া স্মার্টকার্ড প্রকল্পের কাজের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে সরকারি অর্থায়নে ভোটার নাগরিকদের হাতে এটি পৌঁছে দিতে রাত-দিন ২৪ ঘণ্টা তিনটি পালায় কাজ করার লক্ষ্য নিয়ে পরিকল্পনা সাজাচ্ছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা। এর জন্য আরো ৭০-৮০ জন ডাটা এন্ট্রি অপারেটর নিয়োগ করা হবে। প্রকল্পের মেয়াদ আগামী ডিসেম্বরে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও স্মাটকার্ড প্রিন্ট আপাতত বন্ধ থাকার কারণে সেটি আগামী বছরের জুন-জুলাই পর্যন্ত বাড়ানো হতে পারে। আর নির্বাচন কমিশনের (ইসি) অধীনে আসন্ন ঈদুল আজহার পর পুরোদমে এই কাজটি শুরু হবে।
জানতে চাইলে জাতীয় নিবন্ধন অনু বিভাগের মহাপরিচালক (ডিজি) এবং আইডিয়া প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক ব্রি. জে. মোহাম্মদ সাইদুল ইসলাম প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, ওবারথুর চুক্তি লঙ্ঘন করেছে, তাদের ব্যর্থতা আছে। সব কিছু মিলিয়ে এখন পর্যন্ত কাজ স্মার্ট প্রিন্ট (পারসোনালাইজেশন) হয়েছে মাত্র ১২.৪১ শতাংশ। তাদের যে ব্যর্থতা, তাতে কোনোভাবেই ওবারথুরকে ছাড় দেওয়ার সুযোগ নেই। চুক্তি ভঙ্গের কারণে রাষ্ট্রের সঙ্গে যে প্রতারণা করেছে সেজন্য তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। তিনি আরো বলেন, দেশের স্বার্থ রক্ষা করার জন্য প্রয়োজনে যেখানে যাওয়া দরকার সেখানে যাওয়া হবে। তবে, প্রতিষ্ঠানটি যদি সহজে মীমাংসায় আসে তাহলে ভালো, আর তারা যদি জটিল পথে যায় তখন প্রয়োজনে বিকল্প ব্যবস্থা।
ডিজি বলেন, স্মার্টকার্ড পারসোনালাইজেশনসহ সমস্ত কাজ এখন দেশেই করা হবে। এর জন্য কাজটি যেভাবে করা যায় সেভাবেই আমরা অগ্রসর হচ্ছি।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে স্মার্টকার্ড প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ করা হয় ১৩৭৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে স্মার্টকার্ড মুদ্রণ থেকে বিতরণ পর্যন্ত হিসাব ধরেই অর্থ বরাদ্দ করা হয়। আর ফ্রান্সের প্রতিষ্ঠান ওবারথুর টেকনোলজির সঙ্গে ব্লাংক কার্ড উৎপাদন, সাপ্লাই এবং মুদ্রণ ও বিতরণের বিষয়ে চুক্তি হয় ৮০৯টি কোটি টাকার। ২০১৫ সালের ১৪ জানুয়ারি চুক্তি অনুযায়ী, দেড় বছরের মধ্যে অর্থাৎ ২০১৬ সালের ৩০ জুলাইয়ের মধ্যে ‘ভিতরি ফ্রান্স’ থেকে নয় কোটি কার্ড উৎপাদন করে বাংলাদেশে আমদানিকরণ, ইসির পারসো সেন্টারে মুদ্রণ করে উপজেলা-থানা পর্যায়ে বিতরণ করা এবং সচিবালয়ের কর্মকর্তাদের এ সম্পর্কে প্রশিক্ষণ প্রদান ও ডকুমেন্টেশন হস্তান্তর করা।
কিন্তু ওবারথুর কার্যক্রম সম্পাদনে বিভিন্ন সমস্যা, অজুহাত উপস্থাপন করতে থাকে। এক পর্যায়ে কার্ডের হলোগ্রাম সমস্যার জন্য দীর্ঘ সময়ক্ষেপণ করে এবং দ্বিতীয় পক্ষের সঙ্গে চুক্তির নামে প্রকল্পের অনুমোদন গ্রহণ করে। চুক্তির মেয়াদের দেড় বছরে নয় কোটির মধ্যে ৩.১৪৪ মিলিয়ন (প্রায় সাড়ে ৩১ লাখ) যার হার ছিল মাত্র ৩.৪৯ শতাংশ, ব্লাংক কার্ড উৎপাদন ও সøাপাই বাকি ৯৬.৫০ শতাংশ যা পুরোপুরি ব্যর্থতার পরিচয় দেয়। একইভাবে, কার্ড মুদ্রণ হয় ১.৫১ শতাংশ। এ ক্ষেত্রেও ব্যর্থতা ৯৮.৪৯ শতাংশ এবং উপজেলা-থানা পর্যায়ে বিতরণ হয় মাত্র ১.১৩ শতাংশ এবং ব্যর্থতা ছিল সংস্থার ৯৮.৮৭ শতাংশ।
এত ব্যর্থতার পরও ফ্রান্সের ভিতরি থেকে ব্লাংক কার্ড উৎপাদন করে যথাসময়ে সরবরাহ সম্ভব হবে না—এ অজুহাত হাজির করে আরো এক বছর মেয়াদ বাড়িয়ে সময় নির্ধারণ হয় গত বছরের ৩০ জুন। হলোগ্রাম সমস্যার জন্য কার্ড উৎপাদন বন্ধ থাকায় যথাসময়ে কার্ড উৎপাদন ও পারসোনালাইজেশন নিশ্চিত করার স্বার্থে ফ্রান্সের ভিতরির পাশাপাশি চীনা প্রতিষ্ঠান শেনজেকে কার্ড উৎপাদনের অনুমতি দেওয়া হয়।
কিন্তু প্রকল্প কর্তৃক সকল প্রকার সহযোগিতা করার পরও ওবারথুর টেকনোলজি প্রকল্প শেষ করায় কোনো উদ্যোগ নেয়নি। উদ্যোগের মধ্যে ছিল পারসোনালাইজেশন মেশিনের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করা, সর্বোচ্চ থ্রু পুট অর্জিত হওয়া, অনসাইট মেইনটেন্যান্স টিমের মাধ্যমে টেকনিক্যাল সাপোর্ট নিশ্চিত করা, প্রয়োজনীয় জনবলের সংস্থান করা, ১৫ বার তাগিদ দেওয়ার পরও রিকভারি পরিকল্পনা পেশ না করা ও ট্রেনিং ও ডকুমেন্টেশন সম্পন্ন করা। এসব উদ্যোগের একটিও বাস্তবায়ন না করে চরম ব্যর্থতার পরিচয় দেয় প্রতিষ্ঠানটি। পাশাপাশি তাদের অপেশাদার আচরণের কারণে পরবর্তী মেয়াদ বাড়ানোর পরও গত বছরের নভেম্বর থেকে চলতি বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত মুদ্রণ বন্ধ ছিল। এতে উৎপাদন ক্ষমতা কমে এ বছর মধ্য এপ্রিলে ৩টি মেশিনে নেমে আসে।
প্রকল্পের এই নাজুক অবস্থা দেখে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠে ইসি। পরিস্থিতি উত্তরণে ফ্রান্সের রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে সিইসির সভাপতিত্বে কমিশন সচিব ও আইডিয়া প্রকল্প পরিচালক বৈঠক করে। পরবর্তীতে গত ২১ এপ্রিল সিইসি ওবারথুরের শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে আরেকটি বৈঠক করেন। সেখানেও রাষ্ট্রদূত উপস্থিত ছিলেন। এই বৈঠকের পর আরো কিছু পদক্ষেপ নেওয়ার অঙ্গীকার করে সংস্থাটি। যার মধ্যে ১০টি মেশিনে সর্বোচ্চ থ্রু পুট করা, অতিরিক্ত ১৫টি মেশিন আনা, অন সাইট সাপোর্ট সার্ভিস নিশ্চিত করা, মেইনটেন্যান্স টিম ও ইকুইপমেন্ট সরবরাহ, ৩টি শিফট চালু ও অতিরিক্ত জনবল নিয়োগ এবং ট্রেনিং ডকুমেন্টেশন সম্পন্ন করা। ইসির কাছে সংস্থাটির অঙ্গীকার ছিল গত ৩০ জুনের মধ্যে কাজ শেষ করা। এর আগে সংস্থাটিকে ১৫টি নোটিস ও তাগিদপত্র দেওয়া হলেও কোনোটিই আমলে নেয়নি তারা। আর প্রতিশ্রুত ১৫টি মেশিনের বদলে ৮টি আমদানির কথা থাকলেও সেটা পূরণ করেনি।
উল্টো ওবারথুর ই-মেইলের মাধ্যমে গত ১৩ মে ইসির তথ্যভা-ারে প্রবেশাধিকার ও অডিট করার বিষয়ে আগ্রহ দেখায় এবং পুনরায় চুক্তির মেয়াদ বাড়ানোর তাগিদ জানায়। ফলে ৩০ জুন তারিখের মধ্যে আশানুরূপ উন্নতি না করায় ওই সময়ই চুক্তি শেষ হয়।
দেখা গেছে, সর্বশেষ বাড়ানো এক বছর মেয়াদের মধ্যে কোনো উন্নতি ঘটেনি বরং অবনতির চিত্রই ফুটে ওঠে। গত ৩০ জুন পর্যন্ত স্মার্টকার্ড বাস্তবায়নের চিত্র পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ব্লাংক কার্ড উৎপাদন ও সরবরাহের পরিমাণ ছিল ৬৬.৩৬ মিলিয়ন, অগ্রগতির হার ৭৩.৭৪ শতাংশ; ব্লাংক কার্ড উৎপাদন ও সরবরাহ বাকি ছিল ২৩.৬৪ মিলিয়ন এ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানটির ব্যর্থতা ছিল ২৬.২৭ শতাংশ। একইভাবে, কার্ড মুদ্রণ মাত্র ১২.৪১ শতাংশ এবং ব্যর্থতা ৮৬.২১ শতাংশ এবং ওই সময়ে উপজেলা-থানা পর্যায়ে বিতরণে ব্যর্থতা ছিল সংস্থাটির ৮৭.৮০ শতাংশ।
এদিকে, ওবারথুরের এই ব্যর্থতা পুষিয়ে নিতে পদ্মা সেতু প্রকল্পের মতো এবার স্মার্টকার্ড মুদ্রণ ও বিতরণ কাজও দেশের অর্থায়ন এবং নিজস্ব উদ্যোগে সম্পন্ন করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইসি। ইসির ভারপ্রাপ্ত সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ গতকাল বৃহস্পতিবার এ তথ্য জানান।
হেলালুদ্দীন আহমদ বলেন, ‘ফ্রান্সের ওভারথুর কোম্পানির সঙ্গে চুক্তির মেয়াদ আর বাড়ানো হবে না। আমরা নিজেরাই জাতীয় পরিচয়পত্রের স্মার্টকার্ড তৈরি করব। আশা করছি, আগামী বছর জুনের মধ্যে আমাদের লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী, সব কার্ড ছাপিয়ে বিতরণ করতে পারব।’
চুক্তি বাতিল প্রসঙ্গে তিনি আরো বলেন, ‘তাদের নির্দিষ্ট সময় দেওয়া হয়েছিল। ওই সময়ের মধ্যে তারা কাজ শেষ করতে পারেনি। স্বাভাবিকভাবে তাদের মেয়াদ আর বাড়ানো হয়নি। এখন নিজেরাই স্মার্টকার্ড তৈরি করবে ইসি।’ ব্লাংক স্মার্টকার্ড বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরি (বিএমটিএফ)’র মাধ্যমে তৈরি করা হবে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
এর জন্য স্মার্টকার্ড প্রকল্পের অপারেটরসহ টেকনিক্যাল এক্সপার্ট ও সাপোর্ট কর্মকর্তা-কর্মচারী দিয়ে কাজটি শেষ করবে। মোট ১১৩০ জনবলের সঙ্গে আরো প্রায় ১০০ ডাটা এন্ট্রি অপারেটর নিয়োগের প্রস্তুতি নিচ্ছে আইডিয়া কর্তৃপক্ষ। পাশাপাশি, সংস্থাটির বিরুদ্ধে চুক্তি লঙ্ঘন ও রাষ্ট্রের সঙ্গে প্রতারণা ও প্রতিষ্ঠানের ইমেজ ও আর্থিক ক্ষতির কারণে আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা করার বিষয়ে চিন্তা করছে। এর জন্য আদালতের বন্ধু (এমিকাস কিউরি) এমন একজন আইনজীবী নিয়োগের বিষয়ও চূড়ান্ত হয়েছে।
পিডিএসও/হেলাল